অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন শ্রমবাজার by মোঃ আরিফুর রহমান
বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির যে ধারাবাহিকতা বিগত কয়েক বছর ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা অসম্ভব নয়।
মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। আর এর সঙ্গে বাড়ছে জীবনযাত্রার মান। বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতির মাঝেও দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও সুসংহত অবস্থানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে অন্যতম থ্রার্স্ট সেক্টর হিসেবে বিবেচিত জনশক্তি রফতানি খাত। দেশের অর্থনৈতিক সেক্টরগুলোতে মন্দা বিরাজ করলেও এই সেক্টরটি দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দিন দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ছে। এর বড় কারণ প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স। জনশক্তি রফতানি শুধু আর্থিক সমৃদ্ধিই বৃদ্ধি করেনি, করেছে বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান। সামাজিক অস্থিরতা হ্রাসে জনশক্তি রফতানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে । দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে জনশক্তি রফতানি খাতের বিকল্প খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু দুভার্গ্যরে বিষয় হচ্ছে, অন্যান্য সেক্টরের মতো এই সেক্টরও হুমকির সম্মুখীন। বিদ্যমান শ্রমবাজারগুলো নানা সমস্যার কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বমন্দা পরিস্থিতি, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি,অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা হ্রাস, শ্রমিক আন্দোলন, শ্রমিকদের অসাধুতা, প্রতিযোগী রাষ্ট্রের অপপ্রচার, সরকারী উদ্যোগের ঘাটতি, দূতাবাসের অবহেলাসহ বিভিন্ন কারণেই বাংলাদেশের জনশক্তির বাজার সংকুচিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে বিদেশফেরত শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। যে পরিমাণ শ্রমিক বিদেশ যেতে সক্ষম হচ্ছে তার থেকে বেশি পরিমাণ শ্রমিক দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। আর এর ফলে জনশক্তি রফতানি খাতে দেখা দিচ্ছে ভারসাম্যহীন অবস্থা। এমতাবস্থায় দেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে জনশক্তি খাতকে অধিক গুরুত্ব যেমন দিতে হবে তেমনি বিশ্বব্যাপী নতুন নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান করে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে জনশক্তি রফতানির প্রবাহকে সচল রাখা অতি জরুরী হয়ে পড়েছে।আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার মধ্যপ্রাচ্যর এই অচল অবস্থা দূর করার চেষ্টা করছে। ওমান, কাতার, বাহরাইন, লেবাননসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। ধুঁকতে থাকা শ্রমবাজারের জন্য বড় আশীর্বাদ হতে পারে কাতার। বাংলাদেশ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ দক্ষ জনশক্তি নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এই বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। মালয়েশিয়াও অচলাবস্থার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ লোক নিতে রাজি হয়েছে। ইরাকে পুনর্গঠন কার্যক্রম চলছে। সরকারী-আধাসরকারী, বেসরকারী প্রকল্পগুলোতে প্রচুর বিদেশী শ্রমিক নিয়োগ হচ্ছে। বাংলাদেশ ও ইরাকের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি ইতোমধ্যে স্বাক্ষর হয়ে গেছে। এর ফলে ইরাকে আমাদের জনশক্তি রফতানির সম্ভাবনা রয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ায় পুনর্গঠনের কাজ চলছে। এর ফলে এই দেশটিতে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন রয়েছে। লিবিয়ায় জনশক্তি রফতানির সুযোগ সৃষ্টি করতে মন্ত্রণালয় বিশেষ কিছু পরিকল্পনা ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারপরও শুধু মধ্যপ্রাচ্য জনশক্তি রফতানির ওপর নির্ভর করলেই হবে না। সরকার ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে খুঁজতে হবে বিশ্বব্যাপী নতুন বাজার।
উন্নত দেশগুলোতে তুলনামূলকভাবে অনেক কম বাংলাদেশী শ্রমিক আছে। এর জন্য দায়ী শ্রমিকদের অদক্ষতা, ভাষাগত জ্ঞানের অভাব, কূটনৈতিক সম্পর্কে ঘাটতিসহ বহুবিধ কারণ। আমেরিকা, ইউরোপের দেশগুলো এবং অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশীদের জন্য বেশি অর্থ উপার্জনের হাতছানি দিলেও এই দেশগুলোতে স্টুডেন্ট ভিসা ছাড়া যাওয়া অনেক কষ্টের। এই দেশগুলোতে যেতে অনেক টাকার প্রয়োজন হয় আর অনেক জটিল প্রক্রিয়া মোকাবেলা করতে হয়। ১০-২০ লাখ টাকা খরচ করে এসব দেশে যেতে হয় বিধায় এসব দেশে জনশক্তি রফতানির হার খুবই কম। এক্ষেত্রে সরকারকে অভিবাসন ফিসহ অন্যান্য খরচ যাতে কমিয়ে বেশিসংখ্যক লোক দেশগুলোতে প্রেরণ করা যায় তার জন্য প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো উচিত। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ইতোমধ্যে সরকার কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। আর তারাও বাংলাদেশ থেকে লোক নেয়ার ব্যাপারে আশা দিয়েছে।
সুইডেন,আলজিরিয়া, এ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো, দক্ষিণআফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা,সুদান, গ্রিস, লাইবেরিয়া, তানজানিয়া, এস্তোনিয়া,আজারবাইজান, নাইজিরিয়া, বোতসোয়ানা, সিয়েরালিয়ন,পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে ভাল শ্রমবাজার রয়েছে। এসব বাজার ধরতে পারলে বর্তমানে যতসংখ্যক জনশক্তি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছে তার থেকে বহুগুণ বেশি জনশক্তি রফতানি করা সম্ভব। সরকার ইতোমধ্যে এই সব দেশে জনশক্তি রফতানি বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করছে। যদিও এখনও তেমন আশার কথা শোনা যায়নি। এক্ষেত্রে সরকার ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে আরও বেশি উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে এগুতে হবে। থাইল্যান্ড ও মরিশাসে কর্মী পাঠানোর সুযোগ থাকলেও মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তেমন কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি। মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ শুধু ফাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। এই বিষয়টি জনশক্তি মন্ত্রণালয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। চীন বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশ। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হলেও এই দেশের ক্রমবর্ধমান শিল্পের জন্য দরকার দক্ষ শ্রমিক। বাংলাদেশের দক্ষ শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের জন্য চীন বিশাল জনশক্তির বাজারে পরিণত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে এই দেশে আমাদের অবস্থান তেমন ভাল না। এর কারণ চীনের সঙ্গে এই ব্যাপারে জোরালো পদক্ষেপ না নেয়া। জনশক্তি রফতানির বিশাল ক্ষেত্র হিসেবে চীন অন্যতম দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। এক্ষেত্রে ঐ দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে জনশক্তি রফতানির পথ মসৃণ করতে হবে। এবার আসা যাক, জাপানের কথায়। বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির জন্য জাপান একটি আদর্শ দেশ। এই দেশে যে সকল বাংলাদেশী শ্রমিক রয়েছেন তারা প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হচ্ছেন। কিন্তু জনশক্তি রফতানির হার এই দেশটিতেও খুব কম। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে এই দেশটিতে জনশক্তি যাতে বেশি পরিমাণ রফতানি করা যায় সেই বিষয়টি আমাদেরকে প্রাধান্য দিতে হবে। এক্ষেত্রে শ্রমিকদের জাপানী ভাষা শিক্ষাসহ অন্যান্য দক্ষতা বৃদ্ধি অতীব জরুরী। এশিয়ার আরেকটি জনশক্তি রফতানির সম্ভাবনাময় দেশ হলো দক্ষিণ কোরিয়া। এই দেশটিতেও শ্রমিকরা প্রচুর অর্থ উপার্জনের সুযোগ পায় কিন্তু দেশটিতেও জনশক্তি রফতানি হার নিতান্তই কম। কিছুদিন আগে অবশ্য দক্ষিণ কোরিয়ায় বেশি পরিমাণ লোক নেয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার বাংলাদেশ থেকে লোক নেয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারকে তাদের চাহিদা মাফিক লোক সরবরাহ করতে পারলে এই দেশে আরও জনশক্তি রফতানির সম্ভাবনা রয়েছে। মোদ্দা কথা, বাংলাদেশীদের জন্য বিশ্বব্যাপীই জনশক্তি রফতানির সুযোগ আছে। সুযোগটা তৈরি করে দিয়েছে বিশ্বায়ন নামক ধারণাটি। আমাদের জনশক্তি রফতানি খাতকে সচল রাখার জন্য ও শ্রমবাজার সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে শ্রমিকদের বিদেশী ভাষায় পারদর্শিতা, প্রশিক্ষণের মান উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক এ্যাক্রিডিটেশন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ্যাফিলিয়েশন করা, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন এবং নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া, আন্তর্জাতিক চাহিদার আলোকে বিদ্যমান কোর্স কারিকুলামকে নিয়মিত আপগ্রেড করা, বেসরকারী প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত প্রশিক্ষণের মান গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রাখার জন্য নিয়মিতভাবে মনিটরিং ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া প্রতিবছর দেশে বিদেশী নিয়োগকারীদের সমন্বয়ে শ্রম মেলার আয়োজন করা অত্যন্ত জরুরী। শ্রম মেলা নতুন নতুন শ্রম বাজার সৃষ্টির ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহায়ক হবে। মেলা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সর্ম্পকে বিদেশী নিয়োগকারীরা ধারণা অর্জন করতে সক্ষম হবে। এবং তাদের আগ্রহী করে তোলাও সম্ভব হবে। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে বিকল্প শ্রমবাজার অনুসন্ধানের জন্য একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। এই কমিটি যেসব দেশে শ্রমবাজার রয়েছে সেসব দেশ ঘুরে ঘুরে সরকারী পর্যায়ে সুসম্পর্ক স্থাপন করবে। সরকারী পর্যায়ে সম্পর্ক স্থাপিত হলে শ্রমবাজার সম্প্রসারিত হবে। একটা কথা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে যে, নতুন নতুন শ্রমবাজারের ব্যবস্থা যদি না করা যায় তবে অর্থনীতির অন্যান্য সেক্টরের মতো এ খাতটিকেও দুর্ভাগ্য বরণ করে নিতে হতে পারে। বিদ্যমান বাজারগুলোতে যে অচলাবস্থা বিরাজ করছে তার সমাধান করার জন্য সরকার ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যেমন একযোগে কাজ করতে হবে তেমনি নতুন নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি ও তা ধরে রাখার জন্য সমন্বিতভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
No comments