অর্থনীতি- মুদ্রানীতি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি by মাহফুজ কবীর
দেশের অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও অন্য স্টেকহোল্ডারদের মধ্যকার সাম্প্রতিক প্রধান বিতর্কগুলোর একটি হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ, বিশেষ করে ঋণের প্রবৃদ্ধির মধ্যকার আন্তসম্পর্ক। আমরা নিঃসন্দেহে উঁচু প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চাই।
আর এই প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশিত হার চলতি অর্থবছরে ৭.২ শতাংশ এবং ‘দৃশ্যকল্প ২০২১’ অনুসারে আমরা কয়েক বছরের মধ্যেই দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রত্যাশা করছি। কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের এই লক্ষ্যের পথ নিশ্চয় মসৃণ নয়। এ ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো: সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিরতা, রক্ষণশীল মুদ্রানীতি পরিচালিত হওয়া সত্ত্বেও গত কয়েক মাসে মূল্যস্ফীতির উত্থান, গত বছর বৈদেশিক বাণিজ্যের হতাশাজনক গতি-প্রকৃতি, ব্যবসায়ে আস্থার অভাব, অবকাঠামো ও জ্বালানির ঘাটতি ইত্যাদি। এই প্রেক্ষাপটে বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক জানুয়ারি-জুনের জন্য একটি ‘অংশগ্রহণমূলক’ মুদ্রানীতি তৈরি করছে। এই মুদ্রানীতি কি প্রত্যাশিত উঁচু প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে?
আরেকটি প্রশ্ন হলো: আমাদের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা কত? মুদ্রানীতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শসভায় ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের যথেষ্ট আশাবাদী মনে হয়েছে। তাঁরা মনে করেন, উদার মুদ্রানীতির পরিবেশে এখনই ৮-৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব। অবশ্য হল-মার্ক কেলেঙ্কারির পর ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ-প্রবাহের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বিস্তর। তবে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ মনে করে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এখন অত্যন্ত ইতিবাচক অর্থনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে এবং ব্যাংকিং খাত থেকে বর্তমানে প্রবাহিত অর্জনের পরিমাণ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কিছুদিন ধরে প্রচলিত রক্ষণশীল মুদ্রানীতির প্রতি পরোক্ষ সমালোচনাই প্রকাশ পায় এবং তারা মনে করে যে প্রত্যাশিত উঁচু প্রবৃদ্ধি সহজেই অর্জন সম্ভব, যদি এসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ‘প্রয়োজনীয়’ পরিমাণে ঋণ-প্রবাহ থাকে। অবশ্য ব্যাংক থেকে ‘প্রয়োজনীয়’ ঋণের ‘অভাব’ কি সত্যিই ‘সম্ভাব্য’ প্রবৃদ্ধি অর্জনে বড় বাধা? তাহলে কেন আমাদের বিশালাকার অব্যবহূত জাতীয় সঞ্চয়ের কারণে উঁচু সঞ্চয়-বিনিয়োগে ব্যবধান বিরাজ করছে? ঋণের ব্যাপক চাহিদা থাকলে কি ঋণের বিকল্প বাজার সৃষ্টি হয়ে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি হবে না? দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের প্রবৃদ্ধি কিন্তু মোটামুটি হলেও স্থিতিশীল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুসারে, আগামী মুদ্রানীতির ওপর উপস্থাপনায় চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৬.০৯ থেকে ৬.৩৬ শতাংশ হবে বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। অবশ্য অনুমান করা যায় যে এই হার বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো বহুজাতিক সংস্থার পূর্বাভাস দ্বারা অনেকটাই প্রভাবিত।
বাংলাদেশ একটি সামাজিক গবেষণাগার এবং অপার সম্ভাবনার একটি উর্বর ভূমি, যা কিনা ‘টেস্ট কেস হাইপোথিসিস’কে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। এটা সত্যি যে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রধান অর্থনৈতিক নির্দেশক ও প্রবৃদ্ধির নিয়ামকগুলোর গতিপ্রকৃতি ছিল অনেকটাই হতাশাব্যঞ্জক। অবশ্য বিরাট আকারের রেমিট্যান্স-প্রবাহ এবং গত দুই মাসে রপ্তানি খাতে ইতিবাচক পরিবর্তনের কারণে অর্থনীতি সামনের দিনগুলোতে অনেক খানি ঘুরে দাঁড়াতে পারে। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি ‘ফিসক্যাল ক্লিফ’ এড়াতে পারার কারণে এটি যুক্তরাষ্ট্র ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারেও ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে। কেননা, মার্কিন অর্থনীতিকে এখনো বিশ্ব অর্থনীতির চালক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে চলতি অর্থবছরের সামনের দিনগুলোতে বৈদেশিক বাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে অনেকখানি গতি সঞ্চার হতে পারে। আমাদের এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। অবশ্য সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে জিএসপি-সুবিধা রক্ষা করতে শ্রমমান, শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও তাঁদের কর্মপরিবেশ উন্নত করার বিকল্প নেই। এটা মনে রেখেই আগামী মুদ্রানীতি ৬.৫ থেকে ৬.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সহজেই তৈরি এবং সে অনুযায়ী আর্থিক সূচকগুলো সংশোধন করতে পারে। অবশ্য আগামী মুদ্রানীতি উপস্থাপনার শেষ দিকে এ রকম একটি সপ্রতিভ ইঙ্গিতও দেওয়া আছে। পূর্বাভাসের তুলনায় আরও বেশি প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হলে তা অর্জনে একটি নমনীয় আর্থিক কর্মসূচিও গ্রহণ করা হতে পারে।
মূল্যস্ফীতি আবার উদ্বেগ নিয়ে ফিরে আসছে এবং আগামী মুদ্রানীতিতে একে ৭.৫ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার অঙ্গীকার করা হয়েছে। অবশ্য অনেক বিদগ্ধজনের মতে, অর্থ-প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে মূল্যস্ফীতি প্রশমন করা একটি কার্যকর উপায় না-ও হতে পারে। গত ক্যালেন্ডার বছরে ব্যাপক অর্থের প্রবৃদ্ধি এবং সাধারণ ভোক্তা মূল্যস্ফীতির মধ্যে সম্পর্ক ছিল নেতিবাচক। এখন অবশ্য বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ বিরাট রেমিট্যান্স এবং রাশিয়ার সঙ্গে ঋণ-সহযোগিতায় অস্ত্র ক্রয় ও পারমাণবিক চুক্তির কারণে সম্ভাব্য মূল্যস্ফীতি নিয়ে চিন্তিত। কেননা, এর কারণে অর্থনীতিতে অনেকখানি ছাপানো টাকার প্রবাহ বাড়বে। একে যদি স্টোরিলাইজ করা না হয়, তাহলে মূল্যস্ফীতি অনেকখানি বেড়ে যেতে পারে, আর করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর চাপ বাড়বে। অন্যদিকে বিনিময় হার ঊর্ধ্বমূল্যায়নের চাপ ক্রমশ বাড়ছে, যা রপ্তানি খাতে নিরুৎসাহ সৃষ্টি করবে। সরকার নিশ্চয়ই এই ঊর্ধ্বমূল্যায়নের পথে হাঁটবে না এবং স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ ব্যাংককে বাজার থেকে ডলার কিনতে হবে, যা কিনা অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বাড়িয়ে দেবে।
বুঝতে অসুবিধা নেই যে চলতি অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি ৬.১ থেকে ৬.৪ শতাংশ হতে পারে, অনুমান করে নেওয়ার কারণে আগামী মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি সংযত মাত্রায় হবে। এখন অবশ্য বিশেষজ্ঞরা প্রবৃদ্ধির উঁচু হারের চেয়ে এর উঁচু মান ও স্থায়িত্বশীলতা নিয়েই বেশি চিন্তিত। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ প্রবৃদ্ধির হারের যে পরিকল্পনা করছে, তা ভারতের চেয়ে বেশি; অথচ ভারত আমাদের চেয়ে বেশি হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণের উৎপাদনশীল ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে। কেননা, উৎপাদনশীল সম্পদের মূল্যবৃদ্ধির হার অনুৎপাদনশীল সম্পদের মূল্যবৃদ্ধির হারের চেয়ে কম এবং অতিরিক্ত ঋণ যে পরবর্তী ধরনের সম্পদের বাজারে বুদ্বুদ তৈরি করতে পারে, সে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। এ কারণে ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের ‘ঋণ বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি’র প্রত্যাশার প্রতি প্রশ্নবোধক চিহ্নও তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব হবে ঋণ-প্রবাহের সঙ্গে প্রবৃদ্ধির সম্পর্কের বিষয়ের একটি বিশুদ্ধ গবেষণা পরিচালনা করা, যাতে করে এর ফলাফলকে মুদ্রানীতি প্রস্তুত করতে ব্যবহার করা যায়।
বাংলাদেশের যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, তা আন্তর্জাতিক মহল প্রায়শই স্বীকার করে। কিন্তু প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বাস্তবায়ন বেশ কিছু ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’র ওপর নির্ভরশীল, যেমন: জ্বালানি ও সমস্যা, ব্যবসায়ের উঁচু খরচ, ব্যবসায়ে আস্থার অভাব, তৈরি পোশাক খাতে শ্রমমান ও অস্থিরতা, অপ্রতুল পরিবহন ও বাজারজাতকরণ সুবিধা এবং সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিরতা। অবশ্য এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগী সংস্থাগুলো পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর বিষয়ে আশাবাদী। তাই আগামী মুদ্রানীতিতে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের জন্য একটি প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন।
ড. মাহফুজ কবীর: অর্থনীতিবিদ, ঊর্ধ্বতন গবেষণা ফেলো, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ, ঢাকা।
mahfuzkabir@yahoo.com
আরেকটি প্রশ্ন হলো: আমাদের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা কত? মুদ্রানীতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শসভায় ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের যথেষ্ট আশাবাদী মনে হয়েছে। তাঁরা মনে করেন, উদার মুদ্রানীতির পরিবেশে এখনই ৮-৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব। অবশ্য হল-মার্ক কেলেঙ্কারির পর ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ-প্রবাহের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বিস্তর। তবে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ মনে করে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এখন অত্যন্ত ইতিবাচক অর্থনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে এবং ব্যাংকিং খাত থেকে বর্তমানে প্রবাহিত অর্জনের পরিমাণ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কিছুদিন ধরে প্রচলিত রক্ষণশীল মুদ্রানীতির প্রতি পরোক্ষ সমালোচনাই প্রকাশ পায় এবং তারা মনে করে যে প্রত্যাশিত উঁচু প্রবৃদ্ধি সহজেই অর্জন সম্ভব, যদি এসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ‘প্রয়োজনীয়’ পরিমাণে ঋণ-প্রবাহ থাকে। অবশ্য ব্যাংক থেকে ‘প্রয়োজনীয়’ ঋণের ‘অভাব’ কি সত্যিই ‘সম্ভাব্য’ প্রবৃদ্ধি অর্জনে বড় বাধা? তাহলে কেন আমাদের বিশালাকার অব্যবহূত জাতীয় সঞ্চয়ের কারণে উঁচু সঞ্চয়-বিনিয়োগে ব্যবধান বিরাজ করছে? ঋণের ব্যাপক চাহিদা থাকলে কি ঋণের বিকল্প বাজার সৃষ্টি হয়ে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি হবে না? দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের প্রবৃদ্ধি কিন্তু মোটামুটি হলেও স্থিতিশীল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুসারে, আগামী মুদ্রানীতির ওপর উপস্থাপনায় চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৬.০৯ থেকে ৬.৩৬ শতাংশ হবে বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। অবশ্য অনুমান করা যায় যে এই হার বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো বহুজাতিক সংস্থার পূর্বাভাস দ্বারা অনেকটাই প্রভাবিত।
বাংলাদেশ একটি সামাজিক গবেষণাগার এবং অপার সম্ভাবনার একটি উর্বর ভূমি, যা কিনা ‘টেস্ট কেস হাইপোথিসিস’কে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। এটা সত্যি যে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রধান অর্থনৈতিক নির্দেশক ও প্রবৃদ্ধির নিয়ামকগুলোর গতিপ্রকৃতি ছিল অনেকটাই হতাশাব্যঞ্জক। অবশ্য বিরাট আকারের রেমিট্যান্স-প্রবাহ এবং গত দুই মাসে রপ্তানি খাতে ইতিবাচক পরিবর্তনের কারণে অর্থনীতি সামনের দিনগুলোতে অনেক খানি ঘুরে দাঁড়াতে পারে। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি ‘ফিসক্যাল ক্লিফ’ এড়াতে পারার কারণে এটি যুক্তরাষ্ট্র ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারেও ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে। কেননা, মার্কিন অর্থনীতিকে এখনো বিশ্ব অর্থনীতির চালক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে চলতি অর্থবছরের সামনের দিনগুলোতে বৈদেশিক বাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে অনেকখানি গতি সঞ্চার হতে পারে। আমাদের এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। অবশ্য সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে জিএসপি-সুবিধা রক্ষা করতে শ্রমমান, শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও তাঁদের কর্মপরিবেশ উন্নত করার বিকল্প নেই। এটা মনে রেখেই আগামী মুদ্রানীতি ৬.৫ থেকে ৬.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সহজেই তৈরি এবং সে অনুযায়ী আর্থিক সূচকগুলো সংশোধন করতে পারে। অবশ্য আগামী মুদ্রানীতি উপস্থাপনার শেষ দিকে এ রকম একটি সপ্রতিভ ইঙ্গিতও দেওয়া আছে। পূর্বাভাসের তুলনায় আরও বেশি প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হলে তা অর্জনে একটি নমনীয় আর্থিক কর্মসূচিও গ্রহণ করা হতে পারে।
মূল্যস্ফীতি আবার উদ্বেগ নিয়ে ফিরে আসছে এবং আগামী মুদ্রানীতিতে একে ৭.৫ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার অঙ্গীকার করা হয়েছে। অবশ্য অনেক বিদগ্ধজনের মতে, অর্থ-প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে মূল্যস্ফীতি প্রশমন করা একটি কার্যকর উপায় না-ও হতে পারে। গত ক্যালেন্ডার বছরে ব্যাপক অর্থের প্রবৃদ্ধি এবং সাধারণ ভোক্তা মূল্যস্ফীতির মধ্যে সম্পর্ক ছিল নেতিবাচক। এখন অবশ্য বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ বিরাট রেমিট্যান্স এবং রাশিয়ার সঙ্গে ঋণ-সহযোগিতায় অস্ত্র ক্রয় ও পারমাণবিক চুক্তির কারণে সম্ভাব্য মূল্যস্ফীতি নিয়ে চিন্তিত। কেননা, এর কারণে অর্থনীতিতে অনেকখানি ছাপানো টাকার প্রবাহ বাড়বে। একে যদি স্টোরিলাইজ করা না হয়, তাহলে মূল্যস্ফীতি অনেকখানি বেড়ে যেতে পারে, আর করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর চাপ বাড়বে। অন্যদিকে বিনিময় হার ঊর্ধ্বমূল্যায়নের চাপ ক্রমশ বাড়ছে, যা রপ্তানি খাতে নিরুৎসাহ সৃষ্টি করবে। সরকার নিশ্চয়ই এই ঊর্ধ্বমূল্যায়নের পথে হাঁটবে না এবং স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ ব্যাংককে বাজার থেকে ডলার কিনতে হবে, যা কিনা অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বাড়িয়ে দেবে।
বুঝতে অসুবিধা নেই যে চলতি অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি ৬.১ থেকে ৬.৪ শতাংশ হতে পারে, অনুমান করে নেওয়ার কারণে আগামী মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি সংযত মাত্রায় হবে। এখন অবশ্য বিশেষজ্ঞরা প্রবৃদ্ধির উঁচু হারের চেয়ে এর উঁচু মান ও স্থায়িত্বশীলতা নিয়েই বেশি চিন্তিত। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ প্রবৃদ্ধির হারের যে পরিকল্পনা করছে, তা ভারতের চেয়ে বেশি; অথচ ভারত আমাদের চেয়ে বেশি হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণের উৎপাদনশীল ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে। কেননা, উৎপাদনশীল সম্পদের মূল্যবৃদ্ধির হার অনুৎপাদনশীল সম্পদের মূল্যবৃদ্ধির হারের চেয়ে কম এবং অতিরিক্ত ঋণ যে পরবর্তী ধরনের সম্পদের বাজারে বুদ্বুদ তৈরি করতে পারে, সে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। এ কারণে ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের ‘ঋণ বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি’র প্রত্যাশার প্রতি প্রশ্নবোধক চিহ্নও তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব হবে ঋণ-প্রবাহের সঙ্গে প্রবৃদ্ধির সম্পর্কের বিষয়ের একটি বিশুদ্ধ গবেষণা পরিচালনা করা, যাতে করে এর ফলাফলকে মুদ্রানীতি প্রস্তুত করতে ব্যবহার করা যায়।
বাংলাদেশের যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, তা আন্তর্জাতিক মহল প্রায়শই স্বীকার করে। কিন্তু প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বাস্তবায়ন বেশ কিছু ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’র ওপর নির্ভরশীল, যেমন: জ্বালানি ও সমস্যা, ব্যবসায়ের উঁচু খরচ, ব্যবসায়ে আস্থার অভাব, তৈরি পোশাক খাতে শ্রমমান ও অস্থিরতা, অপ্রতুল পরিবহন ও বাজারজাতকরণ সুবিধা এবং সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিরতা। অবশ্য এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগী সংস্থাগুলো পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর বিষয়ে আশাবাদী। তাই আগামী মুদ্রানীতিতে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের জন্য একটি প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন।
ড. মাহফুজ কবীর: অর্থনীতিবিদ, ঊর্ধ্বতন গবেষণা ফেলো, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ, ঢাকা।
mahfuzkabir@yahoo.com
No comments