বিশ্বায়ন ও উন্নয়ন by ড. মিহির কুমার রায়
সম্প্রতি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশনের যৌথ উদ্যোগে এক লোকজ বক্তৃতা ঢাকাস্থ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত হলো।
এ অনুষ্ঠানে একক বক্তা হিসাবে মূল বিষয়ের ওপর উপস্থাপনা প্রদান করেন এক বাঙালী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদ ড. অশোক মিত্র। উপস্থাপক আলোচনার শুরুতেই উন্নয়নের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, কেবলই জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে উন্নয়ন বলা যাবে না যদি এই প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের সর্বস্তরের জনগণের মাঝে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে না পৌঁছায়। এখন প্রশ্নটা হলো উন্নয়ন সংজ্ঞায় কল্যাণমুখিতার কথা যা অনেকেই সেটাকে অনুশীলনে নৈতিকভাবে সমর্থন করতে চান না। অথচ সেই উন্নয়নের কল্যাণমুখিতা নিয়ে অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য কুমার সেন, ড. আনিসুর রহমান, অধ্যাপক রেহমান সোবানসহ অনেক সমাজ বিজ্ঞানী ও বিশেষভাবে স্বোচ্ছার দেশে-বিদেশে। কারণ এখন উন্নয়নের সাথে ব্যক্তি স্বাধীনতা, সুশাসন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আত্মসম্মানবোধ, নিরাপত্তা, নারীর ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র প্রভৃতি বিষয় সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে। ফলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশ বা উন্নয়শীল দেশ খুব কমেই পাওয়া যাবে যারা উন্নয়ন চিন্তার সব উপাদানকে অনুশীলন করে উন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এখন এই উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বিশ্বায়নের অবস্থান কোথায় সে সব দেশগুলোতে তা আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে চলে আসে উপস্থাপকের দ্বারা। বিশ্বায়ন হলো আঞ্চলিক অর্থনীতি, সমাজ ও কৃষ্টির সমন্বিতরূপ মাত্র যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে শিকড় গড়তে থাকে বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন দেশে। অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন হলো জাতীয় অর্থনীতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সংযোগ বিশেষত বাণিজ্য, বৈদেশিক বিনিয়োগ, মূলধনের চলন, অভিপ্রয়াণ, প্রযুক্তির প্রসার। উপস্থাপক তার আলোচনায় উৎপাদনের বিশ্বায়ন, মূলধনের বিশ্বায়ন ও মেহনতী মানুষের বিশ্বায়নের ওপর বিশেষভাবে আলোকপাত করেছেন এবং প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে যৌক্তিক নৈতিক মূল্যবোধ এর বিষয়টিকে সকলের দৃষ্টিতে আনার চেষ্টা করেছেন। বিশ্বায়নের ফলে অবাধে উৎপাদিত পণ্যের বিচরণ সারা পৃথিবীতে চলছে তা থেকে সবই তুলনামূলক বিচারে উপকৃত হচ্ছে সত্যি কিন্তু স্বল্প উন্নত দেশগুলো এই মানদ-ে অনেকটা পিছিয়ে আছে অনেক কারণে। তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রযুক্তিগত যার প্রভাব পড়ে উৎপাদনের মানের ওপর যা প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থায় খুবই প্রয়োজন। তাছাড়াও শুল্কমুক্ত পণ্যের প্রবেশাধিকার, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ব্যবস্থায় কোটা ব্যবস্থা ইত্যাদি অনেকাংশে রাজনৈতিক বিবেচনায় কৌশলগত কারণে গরিব দেশগুলোর পক্ষে যায় না। ফলে বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি স্থায়ীভাবে চেপে বসে যা দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ব্যবস্থায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে উৎপাদন বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু অনেক সময়ই উৎপাদন বাড়ানো যায় না। ফলে আমদানি করে অভ্যন্তরীণ বাজারের ঘাটতি পূরণ করতে হয়। আর এতে আর্থিক সম্পদের ওপর চাপ ক্রমাগতভাবে বেড়ে যায় এবং অভ্যন্তরীণ দেশীয় মুদ্রার বিপরীতে বিদেশী মুদ্রার বিনিময় হার উঠানামার কারণে অনেক সময়ই আমদানি বাণিজ্যে বেশি পরিশোধ করতে হয় আমদানিকারককে। এই অবস্থা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য কারণ এ দেশের উদ্যোগক্তারা বিদেশী বাজারে তাদের যে পরিমাণে ও যে মানের পণ্য উপস্থাপিত করতে সক্ষম হচ্ছে তার চেয়ে বাংলাদেশের বাজারে বিদেশী উদ্যোগক্তারা অনেক উন্নত মানের পণ্যের স্থান করে নিয়ে বেশি সুবিধা নিচ্ছে ভোক্তাদের কাছ থেকে।বাংলাদেশ বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে একটা অসম অবস্থার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে। এখন আসাযাক মূলধন বিশ্বায়ন প্রসঙ্গে এবং উপস্থাপক বলেছেন মূলধন এর কোন মাতৃভূমী নেই, যে দেশে যায় সেদেশেই মাতৃভূমি গড়ে তুলে। মূলধনের সফল বিনিয়োগ উন্নয়নের পূর্বশর্ত এবং বিশ্বায়নের ফলে একদেশ থেকে অন্য দেশে অবাধে বিচরণের সুযোগ পায়। ফলে যৌথ মালিকানায় অনেক শিল্পকারখানা গড়ে উঠে এবং প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে রফতানি বাণিজ্য জোরদার হয়। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ খুব একটা সুবিভাজনক অবস্থানে নেই যা বিভিন্ন উপাত্ত থেকে পাওয়া যায়। এর একটা প্রধান কারণ বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা। এছাড়াও রয়েছে নির্বাসিত সুশাসন, নীতির অধারাবাহিকতা, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য, সরকারী কাঠামোতে দুর্নীতি, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া, দুর্বল অবকাঠামো (রাস্তা, বন্দর সুবিধা), দক্ষ শ্রমিকের স্বল্পতা, বাণিজ্য নীতিতে অপরিপক্বতা এবং জ্বালানি (গ্যাস-বিদ্যুত) এর সংযোগ না পাওয়া। এই সকল পরিস্থিতির ওপর বেশ কিছু গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন তাদের এক গবেষণায় দেখিয়েছে যে বিদেশী বিনিয়োগে খরচ অনেক বেশি এবং সরকারী নীতি ও বাস্তবায়নের মধ্যে অনেক দূরত্ব রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে দুর্বল আইনের শাসন, সুশাসনের অকার্যকারিতা, নির্লিপ্ত পরিবীক্ষণ কাঠামো ইত্যাদি বিনিয়োগ পরিবেশকে প্রভাবিত করছে। উপস্থাপক ড. মিত্র তার আলোচনায় মেহনতী মানুষের বিশ্বায়নের কথা উল্লেখ করে বলেছেন এই প্রক্রিয়া বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের চিন্তা-ভাবনা/যোগাযোগকে একত্রিত করার সুযোগ করে দিয়েছে। আলোচনায় আসে বিশ্বের সামাজিক সংগঠন বিশেষত সমবায়ের কথা যা একসময় সামাজিক নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখন তা মূলত বিজনেস কোপারেটিভ মার্কেটিং সোসাইটিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এখন বিশ্বায়নের যুগে বাজার যেখানে অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এ সমস্ত সমবায় সংগঠন টিকে থাকবে কি না তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কারণ এখন অনেক বিকল্প ব্যবস্থা যেমন এমএলএম ব্যবস্থা বাজারে চালু আছে যেখানে মুনাফার কারণে ভোক্তাদের আকর্ষণ সমবায়ের চেয়ে অনেক বেশি।
উপস্থাপক বলেছেন বিশ্বায়ন এখন একটি বৈশ্বিক ইস্যু এবং এর মাধ্যমে যদি উন্নয়ন সম্ভব করতে হয় তবে বিশ্বায়নের উপাদানগুলোকে অনুশীলন করে সেভাবেই নিজেদের তৈরি করতে হবে যা অনেক দেশ এমনকি বাংলাদেশের পক্ষেও পুরোপুরি সম্ভব হয়ে উঠেনি বিভিন্ন কারণে। ফলে বিশ্বায়নের ফলাফল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে যার কুফলগুলোও সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে। যেমন আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনে দেশীয় সংস্কৃতি বিপন্ন, বিভিন্ন ধরনের রোগের আগমন, মেধা পাচার, অস্ত্রের আগমন ও ব্যবসা ইত্যাদি। এই প্রভাবগুলো বিভিন্ন আঙ্গিকে বাংলাদেশের উন্নয়নে স্থান করে নিয়েছে সময়ের আবর্তে।
বিশ্বায়নের ফলে নগর জীবনের চেয়ে গ্রামীণ জীবনের পরিবর্তন বেশি সাধিত হচ্ছে। যেমন সমাজভিত্তিক জীবন বিলুপ্তি ও এককভিত্তিক জীবন এর প্রাধান্য, যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবারের সৃষ্টি, সামাজিক আচার আচরণ এর জায়গায় ধার করা সংস্কৃতির প্রতি আসক্ত, খাদ্যাভাস পরিবর্তন ইত্যাদি। আমাদের কূটনীতি (ব্যবসায়, পরিবেশে, পানি চুক্তিতে, বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নে) অত্যন্ত দুর্বল এবং এতে করে অনেককিছু থেকে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে যা উন্নয়নের একটি বড় হাতিয়ার হতে পারত। সর্বশেষে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে উপস্থাপককে যখন শ্রোতারা প্রশ্ন করে বিভিন্ন আঙ্গিকে, তখন উত্তর আসে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের অবশ্যি প্রয়োজন রয়েছে এবং তার জন্য নৈতিকতাকে সামনে রেখে যৌক্তিক প্রত্যাশাগুলোকো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যাতে করে ফলাফল ইতিবাচক হয়। বিশ্বায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং বাজার অর্থনীতি এ ধারণাটিকে লালন করে এক বিচিত্র নতুন জগত সৃষ্টিতে। তাই প্রয়োজন আলোকিত ও উজ্জীবিত মানবসম্পদ।
লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক
সিটি ইউনিভার্সিটি
No comments