ঠিকাদারের স্বার্থে প্রকল্প ব্যয় বাড়ল ১২০০ কোটি টাকা by হামিদ সরকার

সরকারের শেষ সময়ে এসে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারি বিধিবিধানের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। একনেকে ব্যয় সংশোধন অনুমোদনের আগেই ঠিকাদারকে কাজ দেয়া হয়েছে।
ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কমিশন লাভের স্বার্থে প্রকল্পের ব্যয় কয়েক গুণ বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছে। এলেঙ্গা ও আশুগঞ্জে গ্যাস কম্প্রেসার স্টেশন স্থাপনে প্রকল্প ব্যয় দরদাতার কারণে ৩০৪ কোটি টাকা থেকে ৩৯১.৩৫ শতাংশ বা এক হাজার ১৯০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পটিতে বিধি লঙ্ঘন করে ঠিকাদারকে ১০ শতাংশ অর্থ অগ্রিম প্রদান করা হয়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে। এখন দরদাতার দর অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ঋণদানকারী সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সাথে চুক্তিকৃত অর্থ বাড়ানো হয়েছে। আর অর্থনীতিবিদদের ধারণা প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে কমিশন বাণিজ্য রয়েছে।

জানা গেছে, দেশের বিদ্যমান গ্যাস সরবরাহ ও বিতরণ পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং গ্যাসের চাপ বৃদ্ধির মাধ্যমে সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য কম্প্রেসার স্টেশন করা দরকার। এ জন্য আশুগঞ্জ ও এলেঙ্গায় চারটি কম্প্রেসার স্টেশন স্থাপন প্রকল্প অনুমোদন পায় ২০০৬ সালে। আশুগঞ্জে এক হাজার ৫০০ এমএমসিডিএফ এবং এলেঙ্গায় ৫০০ এমএমসিডিএফ ক্ষমতাসম্পন্ন কম্প্রেসার স্টেশন স্থাপন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৩০৪ কোটি আট লাখ ৪৮ হাজার টাকা। যার মধ্যে প্রকল্পসহায়তা হলো ২০৯ কোটি ২৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। কিন্তু সাত বছর পর কম্প্রেসার স্টেশনের সংখ্যা কমিয়ে দুু’টি করা হলেও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৩৯২.৩৫ শতাংশ।

প্রাক-একনেক কমিটি (পিইসি) সূত্র জানায়, প্রকল্পটি নিয়ে ২০১২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পিইসি সভায় পর্যালোচনা করা হয়। তাতে বলা হয় প্রকল্পটি ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে শুরু করে ২০০৮ সালের জুনে শেষ করা কথা। এরই মধ্যে মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়। মুচাই ও আশুগঞ্জে কম্প্রেসার স্টেশন স্থাপনের জন্য পরপর দুই দফা টেন্ডার আহ্বান করা হয়। ২০০৬ সালের ১৬ এপ্রিল এবং ২০০৮ সালের ২৩ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেও তেমন সাড়া পায়নি বাস্তবায়নকারী সংস্থা জিটিসিএল। তবে সর্বনিম্ন দরপত্র প্রক্রিয়ার বিপরীতে সর্বনিম্নœ দরদাতার উদ্ধৃত দর দাতাসংস্থা এডিবির সংস্থানকৃত পাঁচ কোটি ৫০ লাখ ডলার অপেক্ষা ১৫৩ শতাংশ বেশি। ফলে কম্প্রেসার স্টেশনগুলো স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এডিবির চেয়ে বেশি দরে কাজ দিয়ে ঠিকাদারের সাথে চুক্তি হয় ২০১১ সালের ২১ অক্টোবর। এমনকি ঠিকাদারের অনুকূলে ১০ শতাংশ অগ্রিম অর্থ প্রদান করার ফলে গত ৭ ফেব্রুয়ারি চুক্তি কার্যকর হয়েছে। ইতোমধ্যে পেট্রোবাংলা প্রস্তাবিত উৎপাদন-বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) আওতায় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি শেভরন মুচাইয়ে কম্প্রেসার স্টেশন স্থাপন করেছে। এমতাবস্থায় এডিবির নতুন ঋণের আওতায় মুচাই ব্যতীত অবশিষ্ট দু’টি স্থানে অর্থাৎ আশুগঞ্জ (দক্ষিণ ও পশ্চিমে কম্প্রেসার স্টেশনদ্বয়কে একীভূত করে) এবং এলেঙ্গায় প্রতিটিতে একটি করে মোট দু’টি কম্প্রেসার স্টেশন স্থাপনের লক্ষ্যে সংশোধিত ডিপিপি একনেক অনুমোদন করেছে।

প্রকল্পের সময় দুই বছর তিন মাস বাড়ানোর সাথে সাথে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে এক হাজার ৪৯৪ কোটি ১৩ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে সরকারের অর্থ হলো ৫৪৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা এবং এডিবির সহায়তা ৯১৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। আর সংস্থার নিজস্ব তহবিল ব্যয় হবে ৩০ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এই ব্যয় অনুমোদিত ডিপিপি অপেক্ষা ৩৯১.৩৫ শতাংশ বেশি। এ দিকে কম্প্রেসার স্টেশন স্থাপনের জন্য কোনো যুক্তিসঙ্গত কারিগরি বিশ্লেষণ উপস্থাপিত হয়নি। ২০০৬ সালের সমীক্ষার ভিত্তিতে এখন এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কম্প্রেসার স্টেশন স্থাপনের বিকল্প হলো পাইপ লাইনগুলোর লুপলাইন স্থাপন। কিন্তু এই দু’টির মধ্যে কম্প্রেসার স্টেশন স্থাপন ব্যয় বিবেচনায় সর্বনিম্ন। কিন্তু ডিপিপিতে এর কোনো বিশ্লেষণ প্রকাশ করা হয়নি। বেশি মূল্যের দরপত্রে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়েছে আগেই। কোত আর্থিক বিধান বলে এই কাজ দেয়া হলো তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে।

আর পরিকল্পনা কমিশন বলছে, বর্তমান চুক্তি অনুযায়ী দাতাসংস্থার ঋণের পরিমাণ হলো ১০ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। কিন্তু প্রকল্পের ঠিকাদারের সাথে সম্পাদিত চুক্তির মূল্য হলো ১২ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার। এ ক্ষেত্রে আলোচিত চুক্তি আওতায় অবরাদ্দকৃত অর্থ থেকে অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে এডিবিকে বলতে হবে। কমিশন থেকে আরো বলা হয়েছে, প্রকল্পের জন্য এডিবির এই ঋণটি সাধারণ মূলধনী সম্পদ (ওসিআর) বিধায় সুদহার তুলনামূলক বেশি। তাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করতে হ্েব। আর এ জন্য কঠোরভাবে পরিবীক্ষণ করতে হবে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, কম্প্রেসার স্টেশন দু’টি গ্যাসভিত্তিক হওয়ায় এটি পরিচালনায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস লাগবে। এতে সাধারণ ভোক্তাপর্যায়ে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। দেশে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণও বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। আর গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পেলে বিদ্যুতের মূল্যও বৃদ্ধি পাবে। ফলে সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হবে। আর এক লাফে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয় কেন বাড়ানো হলো সেটাও উদ্বেগের বিষয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, জ্বালানি খাতের প্রকল্পগুলো নিয়ে আমরা সব সময়ই এই ধরনের আশঙ্কা করি। এখানে অস্বচ্ছতা এবং কমিশন বাণিজ্য বেশি থাকে। আর এই কাজগুলো পূর্ব নির্ধারিত। অর্থ ব্যয় করে পরে সংশোধিত বাজেট অনুমোদন করা হয়। কারণ এই কাজে দুর্নীতির ব্যাপার থাকে। প্রথমপর্যায়ে যে ব্যয় ধরা হয় তা সম্পর্কে দেশের সাধারণ জনগণ জানলেও পরে যা করা হয় তা সম্পর্কে দেশের মানুষ আর জানে না। এখানে দুর্নীতির একটা জাল বিস্তার করে রাখা হয়েছে।
       


No comments

Powered by Blogger.