‘যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি আজ কবিতার’- জাতীয় কবিতা উসবের প্রস্তুতি by মোরসালিন মিজান
একটি মস্তবড় উৎসব। শুধু কবিতার। কবি এবং কবিতাপ্রেমীদের। তবে আর দশটা উৎসবের মতো নয়। এর কিছুটা ভিন্নতা আছে। গর্ব করার মতো ইতিহাস আছে।
বলা চলে, সে ইতিহাসই এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছে উৎসবটিকে। আর এ উৎসবের নামÑ জাতীয় কবিতা উৎসব। ১৯৮৭ সালে স্বৈরাচার এরশাদ যখন গিলে খাচ্ছে সোনার বাংলা, বাঙালী সংস্কৃতি যখন সকাল বিকাল আক্রান্ত হচ্ছে, যখন সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিনের মতো কবিরা স্বৈরাচারের বন্ধু, বন্দুকের সঙ্গে যখন ঠিক পেরে উঠছেন না রাজনৈতিক শক্তিগুলো, তখন কবিতার শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে যান একদল সাহসী মানুষ। সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে বিখ্যাত, অল্প বিখ্যাত সকলেই ছিলেন এ যাত্রায়। এরশাদের তথাকথিত কবিতা উৎসবের বিপরীতে টিএসসির সড়ক দ্বীপে তাঁরা আয়োজন করেন জাতীয় কবিতা উৎসবের। বিরুদ্ধ সময়ে দাঁড়িয়ে তারা সেøাগান তুলেনÑ শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা। এ সেøাগান নতুন মাত্রা যোগ করে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে। নব্বইয়ে এরশাদমুক্ত হয় দেশ। তবে উৎসবের আবশ্যকতা থেকে যায়। নতুন নতুন বাস্তবতায় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে কবিতা উৎসব। এখনও চলছে আদর্শের সংগ্রাম।এবার আসা যাক চলতি বছরের আয়োজনটি প্রসঙ্গে। হ্যাঁ, আর মাত্র কয়েক দিন পর শুরু হবে জাতীয় কবিতা উৎসব ২০১৩। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। জানুয়ারির প্রথম দিন থেকে টিএসসির দ্বিতীয় তলায় খোলা হয়েছে কবিতা পরিষদের অস্থায়ী দফতর। এখানে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বসছেন কর্মীরা। সময় সুযোগ মতো আসছেন নেতারাও। কাজ করছেন। আড্ডা জমাচ্ছেন। সব মিলিয়ে উৎসবের আমেজ। রবিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, লম্বা টেবিল পেতে এর দুই পাশে বসেছেন আয়োজকরা। একেকজন একেক কাজে ব্যস্ত। কেউ কবিতা পাঠে আগ্রহী কবিদের নিবন্ধনের কাজ করছেন। কেউ লিখছেন আমন্ত্রণ পত্র। উৎসবের পোস্টারও বিতরণ করা হচ্ছে এখান থেকে। সন্ধ্যা নামার কিছু আগে দফতরে আসেন কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, উৎসব আহ্বায়ক কবি মুহাম্মদ সামাদ, শিহাব সরকার, আসলাম সানী, কাজী রোজী, তারিক সুজাতসহ আরও অনেকে। হাবীবুল্লাহ সিরাজী জানান, একটি উৎসব শেষ হওয়ার পর থেকেই পরবর্তী উৎসবের কাজ শুরু হয়ে যায়। এবারও তাই হয়েছে। জানুয়ারির প্রথম দিন থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে কাজ শুরু করেছে কবিতা পরিষদ। সে অনুযায়ী এক মাসের মতো হয়ে গেছে। ফলে যথেষ্ট এগিয়েছে কাজ। বাকিটুকু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে জোর প্রচেষ্টা চলছে এখন। আয়োজকরা জানান, এবারও ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বরে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। দুই দিনব্যাপী উৎসবের উদ্বোধন করবেন খ্যাতিমান কবি সৈয়দ শামসুল হক। উৎসবের সেøাগানÑ যুদ্ধাপরাধের বিচার/ দাবি আজ কবিতার। এ দাবিতে এবার অনুষ্ঠেয় উৎসবে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কয়েক শ’ কবি কবিতা পাঠ করতে আসবেন বলে আশা করা হচ্ছে। মাঝে বন্ধ থাকলেও এবার উৎসবে বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষার কবিদের জন্য বিশেষ একটি সেশন রাখা হয়েছে। তবে বিদেশী কবিদের সংখ্যা কমছে দিনদিন। এবারও বিদেশ বলতে কেবলই ভারত। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আসছেন ৩০ জনের মতো কবি। এর বাইরে একজন কবি আসার কথা রয়েছে নেপাল থেকে। ফলে দেশী-বিদেশী কবিদের মিলনমেলা কথাটি অতটা খাটবে না এবারও।
তবে বিশেষ বেদনার সঙ্গে বলতে হবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। পশ্চিমবঙ্গের বিপুল জনপ্রিয় এই কবি বাংলাদেশের বন্ধু হয়ে ছিলেন। প্রায় প্রতিবছরই তিনি আসতেন জাতীয় কবিতা উৎসবে। নিজের ভেবে আসতেন। উৎসবের যেন অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাঁর উপস্থিতি উজ্জ্বলতা বাড়াত উৎসবের। আভিজাত্যের ছোঁয়া এনে দিত। তারচেয়ে বড় কথা, আয়োজকদের যে কোন সমস্যায় পাশে থাকতেন ‘সুনীলদা।’ কিন্তু আর তা হবে না। কারণ তাঁর কবিতা লেখার খাতাটি ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছেন তিনি। খুব অনুমেয়, জাতীয় কবিতা উৎসব এই সুহৃদকে এবার মিস করবে। একটি শূন্যতা থেকে যাবে সব সময়। এ প্রসঙ্গে উৎসবের আহ্বায়ক কবি মুহাম্মদ সামাদ বলেন, সুস্থ অবস্থায় সুনীলদা এই উৎসব কোনদিন মিস করেননি। তাঁর অনুপস্থিতি আমরা বার বার অনুভব করছি। এবারের উৎসব প্রয়াত কবির নামে উৎসর্গ করা হবে বলে জানান তিনি। ঐতিহ্যবাহী এ উৎসব দিন দিন বিবর্ণ হচ্ছে বলে মনে করেন অনেকে। এ ব্যাপারে আয়োজকদের ভাবনাটি কী? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে এক সময় অনেক বড় বড় কবি এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারকা খ্যাতি ছিল তাঁদের। আমরা তাঁদের অধিকাংশকেই হারিয়েছি। সে কারণেই হয়ত কিছুটা বিবর্ণ মনে হতে পারে। এখন আমরা কিছু ক্ষুদ্র মানুষ উৎসবটি আয়োজন করছি। অবশ্য পরের কথাটি এক কথায় চমৎকার। ড. সামাদ বলেন, যত বিবর্ণই আমাদের মনে হোক না কেন, মূল আদর্শ থেকে আমরা এক চুল সরে আসিনি। ধর্মান্ধতা, যুদ্ধাপরাধ, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদসহ সব ধরনের অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমরা একই রকম সরব। প্রতিবাদী। এখানেই স্বার্থকতা আমাদের। আর আমাদের সফলতা মানে বাংলা কবিতার সাফল্য। কবিতা উৎসবের সাফল্য।
No comments