খাদ্যশস্য বৃদ্ধি ও উপকরণের ব্যবহার by এ এম এম শওকত আলী
বর্তমান মৌসুমে বোরো উৎপাদন সম্পর্কে অনেকেই কিছুটা হলেও সন্দিহান। কিছুদিন পূর্বে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক সামষ্টিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিয়ে প্রথমে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করে।
ব্যাংকের প্রৰেপণমতে, সার্বিকভাবে জিডিপির নির্ধারিত হার কমবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা ব্যাংকের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। বোরো ধানসহ যে কোন শস্যের উৎপাদন নির্ভর করে সরবরাহ ও প্রাপ্তির ওপর। অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলেও প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধানের প্রধান প্রতিবন্ধক হয়।বর্তমান মৌসুমে ইতোপূর্বে যে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল তা ছিল মূলত বৃষ্টির অভাব। আমন চাষ বৃষ্টিনির্ভর। তবে এর মোট উৎপাদন জাতীয় উৎপাদনে চালের ৰেত্রে দ্বিতীয় স্থানে। উচ্চ ফলনশীল বীজসহ সার সরবরাহ ও প্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে মোট ফলন। বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতীয় সারের ব্যবহারের মাত্রা সর্বাধিক হয় বোরো মৌসুমে এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাসমূহে। সংশিস্নষ্ট কর্তৃপক্ষের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মৌসুমভিত্তিক চাহিদা সর্বাধিক হয় নভেম্বর-মার্চ মাসে। এ সময়ে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সারের চাহিদা হয় যথাক্রমে শতকরা ৬১, ৬০ এবং ৬০ ভাগ। অর্থাৎ বোরো মৌসুমেই সর্বাধিক সার ব্যবহার করা হয়।
পত্রিকানত্মরে দেখা যায়, ভৈরবে ইউরিয়া সারের বিক্রি নেই, মজুদ বাড়ছে। এ নিয়ে ডিলাররা বিপাকে। কারণ তাঁরা এহেন অবস্থায় আর্থিক ৰতির সম্মুখীন হবেন। চাহিদার মাত্রা কম হলেও ডিলারদের সারাবছরে নূ্যনতম দুই বার সার উত্তোলন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ নিয়ম লঙ্ঘিত হলে তাদের নাম ডিলার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে। অর্থাৎ সংশিস্নষ্ট ডিলার সার ব্যবসা করার সুযোগ হারাবেন। কিশোরগঞ্জ জেলা সার সমিতির সভাপতির মতে, এমন অবস্থা ইতোপূর্বে কখনও হয়নি।
ঐ জেলার কৃষি উপ-পরিচালকের মতে, ইউরিয়া সারের চাহিদা কম হওয়ার কারণ প্রধানত দু'টি। এক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সার সঙ্কটের আশঙ্কায় কৃষকরা অধিক সার মজুদ করেছেন। দুই, বর্তমান সরকার টিএসপি ও এমওপি সারের দাম শতকরা চার ভাগের একভাগ কমানোর ফলে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহারের প্রবণতা নেই। বরং কৃষকরা সুষম সার ব্যবহার করছেন।
প্রথমোক্ত যুক্তিটি সঠিক নয়। কৃষকরা কোন দিনই নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী সার মজুদ করেন না। কারণ এতে অর্থের প্রয়োজন হয়। এছাড়া রয়েছে আরেকটি কারণ। ২০০৭-০৮ সালের সার ২০১০ সালের ফেব্রম্নয়ারি পর্যনত্ম মজুদ হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। দ্বিতীয় যুক্তিটি অনেকাংশে সঠিক। তবে এর সাথে যোগ করতে হয় আরেকটি কারণ। ইউরিয়া সার ব্যবহারের নতুন প্রযুক্তি। প্রচলিত নাম গুটি ইউরিয়া।
সর্বমোট বোরো আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ হলো ৪৮-৫০ লৰ হেক্টর। এ পর্যনত্ম গুটি ইউরিয়া ব্যবহার হয় মোট ৫,৪০,০০০ হেক্টর জমিতে। এর পুরোটাই বোরো মৌসুমে হয়। গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে সনাতনি প্রথায় ব্যবহৃত ইউরিয়া সারের সাশ্রয় হয় একাধিক কারণে। প্রধান কারণ হচ্ছে গুটি ইউরিয়া প্রয়োজন অনুযায়ী ধানের চারার শেকড়ের অংশে পুঁতে দেয়া হয়। এর ফলে ব্যবহৃত ইউরিয়ার বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বিনষ্ট হওয়ার কোন আশঙ্কা থাকে না।
কিশোরগঞ্জ জেলায় ইউরিয়া বিক্রি কম হওয়ার জন্য সার্বিক বোরো উৎপাদন ব্যাহত হবে_ এমনটি চিনত্মা করা উচিত নয়। কারণ একটি জেলার ভিত্তিতে এ ধরনের আশঙ্কার কোন কারণ নেই। সারের চাহিদা হ্রাসের অন্যতম প্রধান কারণ হলো এ বছর বোরো চাষ শুরম্ন হয়েছে কিছুটা দেরিতে। বোরো ধান রোপণের সার্বিক অগ্রগতি যদি সনত্মোষজনক হয় তাহলে আশঙ্কার কোন কারণ নেই। উত্তরাঞ্চলের কয়েকজন কৃষি উপ-পরিচালক এর মধ্যেই দাবি করেছেন, বোরো ধানের নির্ধারিত লৰ্যমাত্রা অতিক্রম করা সম্ভব হবে।
আশানুরূপ বোরো উৎপাদনের জন্য বর্তমান মৌসুমে দু'টি উপকরণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এক, চাহিদা অনুযায়ী সেচের পানি সরবরাহ। দুই, এ লৰ্যে বিদু্যতচালিত সেচযন্ত্রের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী বিদু্যত সরবরাহ। এ ৰেত্রে ডিজেল সরবরাহও নিশ্চিত করতে হবে। শেষোক্তটি সম্পর্কে কোন সমস্যা থাকার কথা নয়। কারণ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে আসন্ন গরমের মৌসুমে অধিকতর লোডশেডিংয়ের জন্য নাগরিকদের প্রস্তুত থাকতে বলেছে। কারণ, এ সময়ে প্রয়োজনীয় বিদু্যত সেচ কাজে ব্যবহার করার সুযোগ দিতে হবে। বিদু্যত প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, সেচের চাহিদার জন্য শতকরা ৮৫ ভাগ বিদু্যত সরবরাহ নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হবে।
তবে ভূগর্ভস্থ পানির প্রাপ্যতা সম্পর্কে শঙ্কার কারণ রয়েছে। শীত মৌসুমে বিভিন্ন নদ-নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে বিগত দুই দশকের অধিককাল সময়ে এ কারণে ভূগর্ভস্থ পানিই সেচ কাজে অধিকতর মাত্রায় ব্যবহার হচ্ছে। ফলে যে সমসত্ম এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারের মাত্রা অধিকতর, সে সমসত্ম অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির সত্মর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। বিগত ২২ ফেব্রম্নয়ারি তারিখের এক সংবাদে দৰিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দশটি জেলায় এ বিষয়টি প্রকট হয়েছে মর্মে কিছু পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে। এ সংবাদে অপ্রতুল বিদু্যত সরবরাহের বিষয়টিও উলেস্নখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, সারের কোন সঙ্কট না থাকলেও সেচ সঙ্কটের কারণে কৃষকরা দিশেহারা। এ বছর বৃষ্টিপাতের হারও আশানুরূপ নয়।
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিষয়ে এখনও কোন তথ্য এ বিষয়ে প্রকাশিত হয়নি। সুতরাং অনুমান করা যায় যে, ঐ অঞ্চলে সেচ সংক্রানত্ম সঙ্কট খুব একটা প্রকট নয়। তবে এ অনুমান সঠিক নাও হতে পারে। কারণ প্রধানত দুইটি। এক, এ অঞ্চলে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অগভীরসহ গভীর নলকূপের সংখ্যা অধিকতর। দুই, ১৯৮২ সালে সর্বপ্রথম এ অঞ্চলের কিছু কিছু উপজেলায় পানির সত্মর নেমে যাওয়ার কারণে কৃষকরা সর্বপ্রথম মাটির গর্ত গভীর করে অগভীর নলকূপ স্থাপন করে পানি ব্যবহার করার পদ্ধতি গ্রহণ করে। এ পদ্ধতি দেশের প্রায় সব জেলায় কমবেশি চালু রয়েছে।
নব্বই-এর দশকে ব্যক্তিখাতে সেচযন্ত্র সরাসরি উৎসাহিত করার লৰ্যে বিএডিসির মাধ্যমে পরিচালিত সেচ কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। অপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে সেচযন্ত্র স্থাপনের প্রক্রিয়া তখনই শুরম্ন হয় এবং পানির সত্মর নেমে যাওয়ার সমস্যা প্রকট হতে থাকে। এ সমস্যা যে এককালে জটিল আকার ধারণ করবে সে বিষয়টি চিনত্মা করেই ১৯৮৫ সালে বিভিন্ন ধরনের সেচযন্ত্রের পারস্পরিক দূরত্বের নিশ্চয়তা বিধানে একটি অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু দাতাদের চাপে ঐ আইন কার্যকর করা হয়নি।
পরবর্তীতে ২০০৬ সালে বিষয়টি কারিগরি কমিটির মাধ্যমে পরীৰা-নিরীৰা করে দূরত্ব সম্পর্কে প্রজ্ঞাপন জারি করা সত্ত্বেও কোন ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি। নব্বই-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে তৎকালীন সরকার জাতীয় পানি নীতি প্রণয়ন করে। এ নীতিতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানোর নির্দেশনা রয়েছে। আজ পর্যনত্ম খুব একটা সুফল পাওয়া যায়নি। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় বর্তমানে এ ধরনের ব্যবস্থা জোরদার করার লৰ্যে কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এ ব্যবস্থার মূল্যায়নের সময় এখনও আসেনি। তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ভূউপরিস্থ পানির অধিকতর ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে কৃষি পরিবেশসহ কৃষকদের জন্য এটা মঙ্গলদায়ক হবে। কারণ, ভূগর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহারের ফলে অনেক বিশেষজ্ঞ পানিতে আর্সেনিক দূষণের বিষয়টিও উলেস্নখ করেন। অন্যদিকে ভূউপরিস্থ পানির ব্যবহারে সেচ খরচ কমবে।
খাদ্যশস্য বৃদ্ধির লৰ্যে প্রধান তিনটি উপকরণ যথা বীজ, সার ও সেচের সুষম ব্যবহারের গুরম্নত্ব অনস্বীকার্য। এ বিষয়টি নিবিড় পরিবীৰণের মাধ্যমে কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের তারতম্য অনুযায়ী কর্মসূচী গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। কিছু উদ্যোগ কৃষি মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে। এ সংক্রানত্ম কর্মসূচী সম্পাদনের প্রয়োজনও রয়েছে। অর্থাৎ বীজ, সেচ ও সার ব্যবহারের মাত্রা যেসব অঞ্চলে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কম, সেসব অঞ্চলেই নিবিড় কর্মসূচী বাসত্মবায়ন করা উচিত।
সরকার বর্তমানে চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণে উদ্বিগ্ন। চিরাচরিত প্রথায় অদৃশ্য সিন্ডিকেটকেই দায়ী করা হচ্ছে। আজ পর্যনত্ম সব ধরনের সিন্ডিকেটের কথা বললেও সরকার এ সিন্ডিকেটকে খুঁজে পায়নি। সরকারী খাদ্য ব্যবস্থাপনা একটি জটিল বিষয়। চাহিদা মোতাবেক খাদ্যশস্য উৎপাদন ও সরবরাহের বিষয়টিই মুখ্য। এ জন্য প্রয়োজন কৃষকদের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি ভোক্তাদের জন্যও, যাতে ক্রয়মূল্য সহনশীল থাকে। জটিলতা এখানেই। কারণ বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী। তবে এর সমাধান অসম্ভব কিছু নয়।
সব ধরনের চালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। চিরাচরিত প্রথায় সরকার খোলাবাজারে ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রির কর্মসূচী চালু করেছে। এ বিষয়ে সর্তকতার সাথে অগ্রসর হওয়া বাঞ্ছনীয় হবে। কারণ, এ বছর আমন ধান সংগ্রহের মাত্রা অতীতের তুলনায় অনেক কম ছিল। অন্যদিকে, সরকারী বা বেসরকারী আমদানি একেবারেই হয়নি। কারণ, ভারতেও চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে বাজারে এর প্রভাব স্বভাবতই দৃশ্যমান। বোরো ধান বাজারে না আসা পর্যনত্ম চালের দাম কমার কোন সম্ভাবনা সাধারণত থাকে না। এ জন্যই সরকারী মজুদ ও ব্যবহারের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা অত্যনত্ম প্রয়োজন।
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments