স্টল বরাদ্দ শেষ ॥ অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে- বর্ণাঢ্য সাজে ময়নামতির চর- বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল, বনবীথি by মোরসালিন মিজান
প্রতীক্ষার শেষ হচ্ছে। আর মাত্র কয়েক দিন পর শুরু হবে বাঙালীর প্রাণের উৎসব অমর একুশে গ্রন্থমেলা। মেলাকে কেন্দ্র করে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে ঢল নামবে পাঠকের।
লেখক, প্রকাশকরা হাজির হবেন নিজেদের সৃষ্টি নিয়ে। বহুল প্রতীক্ষিত মেলাকে আরও সুন্দর করতে এবার শুধু প্রকাশকদের নিয়ে মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। গত কয়েক বছর একাডেমী চত্বর ছাড়াও এর বাইরের রাস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল মেলা। তবে এবার শক্ত অবস্থানে বাংলা একাডেমী। প্রচ- চাপ উপেক্ষা করে একাডেমী চত্বরে মেলা সীমাবদ্ধ রাখার সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে মেলার নামে অপ্রকাশকদের এক মাসের দোকানদারি বন্ধ হবে। সেই সঙ্গে উটকো অনেক ঝামেলা থেকে মুক্ত হবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ও বাংলা একাডেমী। বরাবরের মতো এবারও মেলায় বাংলাদেশের বাইরের প্রকাশকদের বই না রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধÑ কোন কোন মহলের এমন প্রচারণাকে হাস্যকর বলেও মনে করে বাংলা একাডেমী। মাসব্যাপী মেলা উৎসর্গ করা হয়েছে প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের নামে।প্রায় প্রতিবছরই মেলা ঘিরে সক্রিয় হয়ে ওঠে একটি অসাধু চক্র। মেলার লোক সমাগম কাজে লাগিয়ে এক ধরনের মনিহারি ব্যবসা শুরু করে তারা। অন্যায় প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন একাধিক স্টল নেয়। বিভিন্ন নামে নেয়া এসব স্টল পরে বিক্রি করে দেয়া হয় বই দোকানিদের কাছে। এসব স্টলে সৃজনশীল বইয়ের বদলে মানহীন চটুল বই বিক্রি শুরু হয়। এসব স্টল দখল ও পাল্টা দখলের ঘটনাও ঘটে প্রতিবছর। সন্ত্রাসী কার্যকলাপ অমর একুশে গ্রন্থমেলার সৌন্দর্য নষ্ট করে মারাত্মকভাবে। বিষয়গুলো তুলে ধরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক জনকণ্ঠ। পরে পুরো অবস্থা বিবেচনা করে বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ মেলায় অপ্রকাশকদের স্টল না দেয়ার ঘোষণা দেয়। তবে সে ঘোষণা কার্যকর করাও সহজ কাজ ছিল না। জানা যায়, এবারও নানা হুমকি ধমকি শুনতে হয়েছে বাংলা একাডেমীকে। তবে শক্ত অবস্থানে ছিলেন আয়োজকরা। ফলে একাডেমীর ভেতরেই থাকছে মেলা।
বাংলা একাডেমীর কার্যনির্বাহী পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বইমেলায় যেসব প্রকাশক ও প্রকাশনা সংস্থা স্টল বরাদ্দ পায়নি, তাদের বই প্রদর্শন ও বিক্রি করা যাবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টোলে। এ ছাড়াও প্রবাসী বাঙালী লেখকদের বই প্রদর্শন ও বিক্রির জন্য পরবাসী অথবা প্রবাসী নামে একটি স্টল বরাদ্দ থাকবে। মেলায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে ডোরেমন, বারবি, পোকেমন ও মি. বিনের মতো পাইরেটেড বই।
মেলায় এবারও থাকছে না বিদেশী প্রকাশকদের কোন বই। দেশীয় প্রকাশকরা এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে কেউ কেউ যে বিরোধিতা করছেন না তা নয়। তাঁদের মতে, এ সিদ্ধান্তের ফলে এমনকি রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে বাংলা একাডেমীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এমন কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বিভিন্নজনের কথা বলে জানা গেছে, এটি ছিল নিতান্তই অপপ্রচার। ফলে কেউ সচেতন মহলে এর কোন প্রভাব পড়েনি।
বাংলা একাডেমী সূত্র জানায়, এবারের মেলায় জমা পড়া ৩৫১টি আবেদনের বিপরীতে ২৩৬টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ৪০৭ ইউনিট স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১১০টি প্রতিষ্ঠানকে এক ইউনিট, ৮১টি প্রতিষ্ঠানকে দুই ইউনিট এবং তিন ইউনিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৪৫টি প্রতিষ্ঠানকে। এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরকে ৪ ইউনিট, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে ২ ইউনিটসহ ২০টি সরকারী প্রতিষ্ঠানকে ৩০ ইউনিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও ৮টি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে ১৯ ইউনিট স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বরাবরের মতো একাডেমীর বহেরাতলায় শিল্প-সাহিত্যের ৪২টি ছোট কাগজ নিয়ে থাকছে লিটলম্যাগ চত্বর। গত ২৪ জানুয়ারি লটারির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়। ২৫ জানুয়ারি মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের স্টল বুঝিয়ে দেয়। এরপর থেকে পুরোদমে চলছে সাজসজ্জার কাজ। প্রকাশকরা নিজেদের মনের মতো করে গড়ে নিচ্ছেন সবকিছু। শনিবার মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, মূল কাঠামোটি দাঁড়িয়ে গেছে। এখানে ওখানে এলোমেলো পড়ে আছে বাঁশ, কাঠ, প্লাইউড। প্রায় সর্বত্রই করাতের শব্দ। হাতুড়ির ঠুকাঠুকি। হ্যাঁ, শ্রমিকরা বেদম কাজ করছে। মালিকরা ব্যস্ত তদারকিতে। প্রায় প্রতিটি স্টলের সামনেই এক চিত্র। সকাল থেকে শুরু হয়ে অনেক রাত অবদি স্টল সাজানোর কাজ চলছে। মেলা শুরুর আগের দিন পর্যন্ত চলবে এ অবস্থা।
মাসব্যাপী আয়োজনকে সফল করে তুলতে একই রকম ব্যস্ত সময় পার করছে আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কাজ করছেন দিন রাত। কারও কারও সাপ্তাহিক ছুটিও বাদ হয়েছে ইতোমধ্যে। আগামী পহেলা ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে ৩টায় বাঙালীর এই প্রাণের মেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। একাডেমীর সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে স্বাগত ভাষণ দেবেন একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। মেলার পৃষ্ঠপোষকতা করছে ব্র্যাক ব্যাংক। সহযোগিতায় রয়েছে বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল ‘চ্যানেল আই’। এবার মেলার সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে স্টেপ মিডিয়া।
অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রস্তুতি সম্পর্কে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, বরাবরের মতোই অনেক আগে থেকে কাজ শুরু করেছিলাম আমরা। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজ করছেন একাডেমীর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সবই মেলাকে সুন্দর করার স্বার্থে। একই কারণে এবার মেলায় শুধু প্রকাশকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, গত বছরই সিদ্ধান্তটি নেয়া ছিল। এ বছর ব্যাপক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আমরা সিদ্ধান্তে অটল থেকেছি। ইতোমধ্যে লটারির মাধ্যমে প্রকৃত প্রকাশকদের স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, অনেকেই মেলাকে একাডেমীর বাইরে করার কথাও বলেছিলেন। এ বিষয়ে একাডেমীর পক্ষ থেকে লেখক, প্রকাশক, সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। তারই ভিত্তিতে আমরা শুধু একাডেমী প্রাঙ্গণেই মেলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ও যুব সংগঠনের কোন চাপ ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুরুতে কিছুটা চেষ্টা হয়েছে। তবে আমার ছাড় দিইনি। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর আর কেউ কোন ঝামেলা করেননি বলে জানান তিনি। মেলায় রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধÑ এমন কথাকে উড়িয়ে দিয়ে একাডেমীর মহাপরিচালক বলেন, এটি ভুল প্রচারণা। রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার সাধ্য কারও নেই। তা ছাড়া তিনি শুধু ভারতের নন, তিনি আমাদেরও। আমরা রবীন্দ্র চর্চায় অনেক এগিয়েও বটে। সুতরাং আমাদের কোন সিদ্ধান্তই রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধের পর্যায়ে যেতে পারে না, যায়নি। মেলাকে সফল করতে সব মহলের সহযোগিতাও কামনা করেছেন মহাপরিচালক।
No comments