ভাঙল মিলনমেলা, ২৮ দিনে ৩৩৫৪ নতুন বই
বাঙালীর সার্বজনীন উৎসব অমর একুশের বইমেলা শেষ হলো রবিবার। সেই সঙ্গে থেমে গেল প্রাণের কোলাহল। ভাঙল মিলনমেলা। আজ সোমবার থেকে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে আর পড়বে না হাজারো মানুষের সরব পদচারণা।
দেখা যাবে না পাঠক-লেখক, তরুণ-তরুণী ও বন্ধুদের জমজমাট আড্ডা। ৫২'র শহীদদের স্মরণে আয়োজিত এই বইমেলা এখন সংস্কৃতি বিকাশের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সাংস্কৃতিক জাগরণকে ক্রমাগত সংহত ও শাণিত করে তুলছে। আর জ্ঞানের বাহন বইয়ের রাজ্যে টেনে আনছে শিশু থেকে বুড়ো সবাইকে। সেই জ্ঞানের বাজারেই আনুষ্ঠানিকভাবে পর্দা নামল রবিবার। এ জন্য একাডেমীর মূলমঞ্চে আয়োজন করা হয়েছিল সমাপনী অনুষ্ঠানের। প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। সভাপতিত্ব করেন একাডেমীর সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। শুভেচ্ছা বক্তৃতা দেন একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। মেলার প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন মেলা কমিটির সদস্য সচিব ও একাডেমীর পরিচালক সাহিদা খাতুন। প্রতিবেদনে তিনি জানান, এবার সর্বাধিক ৩৩৫৪টি বই এসেছে মেলায়। গত বছর (২০০৯ সাল) এ সংখ্যা ছিল ২৭৪১টি। এবারের মেলায় বাংলা একাডেমীর স্টলসহ (২৭ ফেব্রম্নয়ারি পর্যনত্ম) মোট বিক্রির পরিমাণ প্রায় ২০ কোটি টাকা। শুধু বাংলা একাডেমী বিক্রি করেছে ৬৫ লাখ ৭৪ হাজার ৯০৬ টাকা।এদিন সমাপনী অনুষ্ঠানে সেরা গ্রন্থ 'মেঘমলস্নার' জন্য বিজয় প্রকাশ, 'মুক্তিযুদ্ধ সমগ্র-১' এর জন্য সুবর্ণ এবং 'শহীদুল জহির স্মারক গ্রন্থ'-এর জন্য পাঠক সমাবেশকে প্রদান করা হয় চিত্তরঞ্জন সাহা পুরস্কার। স্টল অঙ্গসজ্জার জন্য মাওলা, কথা প্রকাশ ও টইটুম্বরকে প্রদান করা হয় জয়েনউদ্দীন স্মৃতি পুরস্কার। সর্বাধিক গ্রন্থ ক্রয়ের জন্য নজরম্নল ইসলাম ও ডা. ফাতেমা আমীনকে প্রদান করা হয় পলান সরকার পুরস্কার। আর বইমেলা প্রতিদিন বুলেটিনের জন্য আনন্দ আলোকে প্রদান করা হয় মোহাম্মদ নূরম্নল হক গ্রন্থ সুহৃদ পুরম্নস্কার।
মেলার শেষ দিন মাসব্যাপী মেলার শেষ দিন ছিল রবিবার। এদিন ছিল না কোন সরকারী ছুটি। তারপরও নেমেছিল মানুষের ঢল। এদিন বই ছাড়া আর কাউকে দেখা যায়নি। নিছক ঘুরতে বা আড্ডা দিতে এসেছেন এমন লোক ছিল না বললেই চলে। কারণ যাকেই চলে যেতে দেখেছি, তাঁর হাতেই ছিল এক বা একাধিক বই। মেলার শেষ দিন হওয়ায় বিকেল তিনটায় গেট খোলার সঙ্গে সঙ্গেই নামে পাঠক ও ক্রেতার ঢল। শেষদিন হওয়ায় রাত দশটা পর্যনত্ম চলে বই বিকিকিনি। শোভা প্রকাশের স্বত্বাধিকারী মিজানুর রহমান বলেন, মেলার শেষদিন এমনই যায়। তিনি আরও বলেন, এবার বিক্রি ভাল হয়েছে। প্রথম দিন থেকেই জমে গিয়েছিল মেলা। শুধু বৃষ্টি হলো যেদিন, সেদিন বিক্রি হয়নি। বরং ৰতি হয়েছে বেশ। শেষদিনে বই এসেছে ৯৪টি। তবে শেষদিন সবচেয়ে বেশি এসেছে গল্পের বই, ২৫টি। কবিতা ২৩টি, প্রবন্ধ ১১টি, আর উপন্যাস ৮টি। এছাড়া বাকিগুলো অন্যান্য বই।
কবিতা শীর্ষে মাসব্যাপী মেলায় এবার বই এসেছে মোট ৩৩৫৪টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে কবিতার বই, ৮০৭টি। এর পরেই আছে উপন্যাস, ৫৮১টি। এমনই ধারাবাহিকতায় আছে গল্প ৩৭৮টি, প্রবন্ধ ২৫৫টি ছড়া ১৩২টি, শিশুসাহিত্য ১২৯টি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ১১০টি, বিজ্ঞান বিষয়ক ৬৪টি, ভ্রমণ ৫৭টি, ইতিহাস ও রম্য ৫৪টি করে এবং সায়েন্সফিকশন ৫২টি উলেস্নখযোগ্য।
শনিবারের মেলা অমর একুশের বইমেলার ২৭তম দিন ছিল শনিবার। এদিন সরকারী ছুটি থাকায় 'প্রতিদিনের বইমেলার রিপোর্ট হয়নি। তবে এদিন মেলা ছিল সবচেয়ে প্রাণবনত্ম। কারণ সরকারী-বেসরকারী সব অফিস বন্ধ থাকায় এদিন ভিড় ছিল উপচেপড়া। জনমানবের কোলাহলে গমগম করছিল মেলা প্রাঙ্গণ। বিক্রিও হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ। এদিন মেলায় এসেছিল ১৩২টি বই। মূলমঞ্চে প্রদান করা হয় বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার। তবে মেলার শেষ কয়েক দিন বাইরে ছিল বারোয়ারি মেলার আয়োজন। এখানে পাওয়া যেত না, এমন কিছু ছিল না। সংসারের ব্যবহার্য তৈজসপত্র থেকে শুরম্ন করে মহিলাদের ব্যাগ ও স্যান্ডেল, শিশুদের খেলনা, নকল বই, নেট বই, বাহারি স্বাদের খাবারের দোকান, ঘর সাজানোর শো-পিসসহ নানা পণ্যসামগ্রী।
বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার এদিন (শনিবার) ২০০৯ সালের 'বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার' প্রদান করে একাডেমী। গত ১৯ ফেব্রম্নয়ারি এই পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করেছিল একাডেমী। পুরস্কৃতরা হলেন_কবিতায় কবি অরম্নণাভ সরকার ও কবি রবিউল হুসাইন। উপন্যাসে আনোয়ারা সৈয়দ হক ও সুশাসত্ম মজুমদার। গবেষণায় ড. আবুল আহসান চৌধুরী ও শিশুসাহিত্যে ছড়াকার রফিকুল হক দাদুভাই। পুরস্কার বাবদ বাংলা একাডেমী প্রত্যেককে এক লাখ টাকা, একটি ক্রেস্ট ও একটি সনদপত্র প্রদান করে। গত শনিবার মূলমঞ্চে এই গুণী ব্যক্তিত্বদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কবীর চৌধুরী।
হুমায়ুন আজাদ বাংলা সাহিত্যের প্রথাবিরোধী লেখক ও কবি অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদের ওপর ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের চাপাতি হামলার ষষ্ঠ বার্ষিকী ছিল গত শনিবার (২৭ ফেব্রম্নয়ারি)। এ উপলৰে মেলার ভিতরে ও বাইরে বিভিন্ন সংগঠন আয়োজন করেছিল নানা অনুষ্ঠানের। হুমায়ুন আজাদের বই প্রকাশকারী প্রতিষ্ঠান আগামীর ডাকে এদিন লেখক, প্রকাশক, মুক্তচিনত্মার পাঠক ও সাংবাদিকরা কালো ব্যাজ ধারণ করে। উলেস্নখ্য, ২০০৪ সালে বইমেলা থেকে বাড়ি ফেরার পথে মৌলবাদী জঙ্গীদের নিষ্ঠুর চাপাতির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ। কোন রকমে প্রাণে বেঁচে গেলেও তাঁর মুখ বেঁকে গিয়েছিল কিছুটা। তারপরও তিনি মাথা নত করেননি মৌলবাদী এসব সংগঠনের কাছে। কিন্তু এই হায়েনার দলের কালো থাবা সুদূর জার্মানিতে যায় তাঁকে অনুসরণ করে এবং সেখানেই হত্যা করা হয় তাঁকে। যার সুষ্ঠু তদনত্ম ও বিচার আজও হয়নি। তাঁকে নিয়ে আয়োজিত নানা অনুষ্ঠানে তাঁর হত্যার সুষ্ঠু তদনত্ম ও বিচার দাবি করে বিশিষ্টজনেরা।
মোড়ক উন্মোচন গত শনিবার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তিনটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। বিশেষ অতিথি ছিলেন শহীদ মাতা সালেমা বেগম। সভাপতিত্ব করেন প্রত্নতত্ত্ববিদ আ কা ম যাকারিয়া। যে বইগুলোর মোড়ক উন্মোচিত হয় সেগুলো হলো_'৭১-এর মেঘে ঢাকা ইতিহাস', '৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ' এবং 'অনুরদ্ধ ঈশ্বর ও গীতমঞ্জরী'। এদিন মেলার নজরম্নল মঞ্চে মোড়ক উন্মোচিত হয় নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব) এম শাখাওয়াত হোসেনের 'কত জনপদ কত ইতিহাস' বইটির। মোড়ক উন্মোচন করেন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। আরও বক্তৃতা করেন সাংবাদিক কাওসার রহমান ও প্রকাশক ফোরকান আহমদ।
No comments