শিক্ষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি শিক্ষা দিবস থেকে ‘জাতীয় শিক্ষা দিবস’ by অধ্যক্ষ কাজী ফারুক

আজ ১৭ সেপ্টেম্বর বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তির দিন। শিক্ষা দিবস। আজ থেকে অর্ধশত বছর আগে শিক্ষা কোন্ পর্যায়ে ছিল এবং আজ তার অবস্থান কোথায় তা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা দরকার। সাক্ষরতার হার, শিক্ষার গুণগত মান, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের উন্নয়নে কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, প্রচলিত ধারায় শিক্ষার্থীর অধীত বিষয়গুলো


কতটা কর্মসংস্থান নিশ্চিত করছে, নৈতিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকাশে সহায়ক হচ্ছে, সর্বোপরি আমাদের শিক্ষা কতটা বিশ্বমানের তার মূল্যায়নও প্রয়োজন। দলীয় বিবেচনার উর্ধে রেখে শিক্ষায় জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি অংশের আন্তরিকতা কিভাবে বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে পরীক্ষা চলাকালে ও শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন কার্যক্রমের সময় প্রশ্নবিদ্ধ হয় তারও নিরাসক্ত পর্যালোচনা দরকার।
যে ক’টি মোটা দাগের ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে ও আমাদের রক্তমূল্যে স্বাধীনতার লাল সবুজ পতাকা অর্জনে অবদান রেখেছে, তার মধ্যে রয়েছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও সত্তরের সাধারণ নির্বাচন।
আমি শিক্ষা জগতের মানুষ। শিক্ষা নিয়ে পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় সাধ্যমতো কাজ করতে চেষ্টা করেছি। কখনও শিক্ষার্থী হিসেবে কখনও শিক্ষার্থীর শিক্ষকের ভূমিকায়। আজ ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের অর্ধশতক পূর্তিতে কলম ধরতে গিয়ে দেখি অনেক স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে। তবে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়, তার প্রেক্ষিত এখনও অম্লান রয়েছে। এর মধ্যে উনিশ শ’ বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন একটি। সম্ভবত ব্যক্তিগত প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এর কারণ।

আন্দোলনের সূচনা
বাষট্টির আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা, গণমুখী শিক্ষা প্রসার, শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য-বঞ্চনা নিরসন, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পাকিস্তানের পূর্ব অংশের জনগণ শিক্ষা, অর্থনীতি, সামরিক-বেসামরিক চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য সকল ক্ষেত্রে চরম বিমাতা সুলভ, বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন, রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চায় নিষেধাজ্ঞা, নজরুলের কবিতার বিকৃতি শিক্ষাবিদ সংস্কৃতিসেবীদের ক্ষুব্ধ করে। নজরুলের ‘নব নবীনের গাহিয়া গান, সজীব করিব মহাশ্মশান’ সংশোধন করে লেখা হয় ‘সজীব করিব গোরস্থান’। ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি’ হয়ে যায় ‘ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি সারাদিন যেন আমি নেক হয়ে চলি’। এ প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতিসেবী, শিল্পী, সাহিত্যিকদের গণজাগরণমূলক বিভিন্ন কর্মসূচীর ধারাবাহিকতায় উপস্থাপিত হয় বাঙালী অর্থনীতিবিদদের পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের জন্য ‘দুই অর্থনীতি তত্ত্ব’। এ প্রেক্ষিতে ১৯৬২ সনে প্রকাশিত হয় শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট। ছাত্র সমাজ এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলন শুরু হয় ঢাকা কলেজ থেকে তিন বছর মেয়াদী ডিগ্রী পাস কোর্স প্রবর্তনের বিরুদ্ধে।
প্রতিবন্ধী ছাত্র এন. আই. চৌধুরী আন্দোলনের সূচনা করে। উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে অতিরিক্ত ইংরেজীকে বোঝা মনে করে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর পরীক্ষার্থীরাও এতে যুক্ত হয়। প্রথমে স্নাতক শ্রেণীর ছাত্রদের লাগাতার ধর্মঘট এবং উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর ছাত্রদের ইংরেজী ক্লাস বর্জনের মধ্যে আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ‘ডিগ্রী স্টুডেন্টস ফোরাম’ ‘ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফোরাম’, নামে রূপান্তরিত হয়ে আন্দোলন চালাতে থাকে। এর যুগ্ম আহ্বায়ক হন ছাত্রলীগের আব্দুল্লাহ ওয়ারেস ইমাম ও ছাত্র ইউনিয়নের কাজী ফারুক আহমেদ। নেতৃত্ব দেন ইডেন কলেজ ছাত্রী সংসদের সহ-সভাপতি মতিয়া চৌধুরী, কায়েদে আজম কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আরেফিন খান, তোলারাম কলেজের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আজিজ বাগমার। ‘বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে ড. মোহাম্মদ হাননান লিখেছেন, “তবে আন্দোলনের গুণগত পরির্তন ঘটে ১০ আগস্ট ১৯৬২ বিকেলে ঢাকা কলেজ ক্যান্টিনে স্নাতক ও উচ্চ মাধ্যমিক উভয় শ্রেণীর ছাত্রদের এক সমাবেশে। এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা কাজী ফারুক আহমেদ। সে তার বক্তৃতায় উপস্থিত ছাত্রদের এ কথা বোঝাতে সক্ষম হয় যে, শিক্ষার আন্দোলন ও গণতন্ত্রের আন্দোলন এক সূত্রে গাঁথা। এই সভার পূর্ব পর্যন্ত ছাত্র সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনের কোন যোগসূত্র ছিল না। কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করতেন, শুধুমাত্র শিক্ষা সংক্রান্ত দাবি-দাওয়া নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা অসম্ভব।”

আন্দোলনের কর্মসূচী
১০ আগস্টের সভায় ১৫ আগস্ট প্রদেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয়। ছাত্র সমাজের কাছে তা ব্যাপক সাড়া জাগায়। পববর্তী কর্মসূচী হিসেবে ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ের সামনে ছাত্রদের অবস্থান ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয়। ১৫ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় বেশ কয়েকটি ছাত্রসভা ও বিক্ষোভ মিছিল হয়। স্কুল কলেজের প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী এতে অংশ নেয়। ১০ সেপ্টেম্বরের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় কাফেটারিয়ায় সকল প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের এক সভা হয়। ডাকসুর পক্ষে এনায়েতুর রহমান, জামাল আনোয়ার বাসু, ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক কাজী ফারুক, জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ ওয়ারেস ইমাম, ইডেন কলেজ সংসদের সহ-সভানেত্রী মতিয়া চৌধুরী, নাজমা বেগম, কায়দে আযম কলেজ সংসদের সহ-সভাপতি নূরুল আরেফীন খান, তোলারাম কলেজ (নারায়ণগঞ্জ) সংসদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আজিজ বাগমার প্রমুখ এতে যোগদান করে। আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু এতদিন ছিল স্কুল কলেজগুলো। এখন তা চলে এলো বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায়। এ অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে শিক্ষার্থীদের অবস্থান ধর্মঘট থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায়। অন্যথায় মারাত্মক পরিস্থিতির হুমকি দেয়া হয়। এমতাবস্থায় ১০ সেপ্টেম্বরের কর্মসূচী প্রত্যাহার করা হলেও ছাত্ররা ১৭ সেপ্টেম্বর হরতালের ডাক দেয়া হয়। ব্যাপক প্রচারের সাথে চলতে থাকে পথসভা, খ-মিছিল। ব্যবসায়ী সমিতি, কর্মচারী সমিতি, রিকশা ইউনিয়ন, শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

বাষট্টির ১৭ সেপ্টেম্বর
১৭ সেপ্টেম্বর ভোর থেকেই ছাত্ররা পিকেটিং শুরু করে। এর আওতায় পড়ে মোনায়েম মন্ত্রিসভার সদস্য হাসান আসকারীর মার্সিডিজ গাড়ি ভস্মীভূত হয়। জ্বলতে থাকে দু’তিনটি জীপও। সার্জেন্ট হাফিজের নেতৃত্বে পুলিশ নবাবপুর রেলক্রসিং থেকে সদরঘাট পর্যন্ত বিক্ষোভকারী ছাত্র-জনতাকে ধাওয়া ও গ্রেফতার করে। এদিকে সকাল ৯টা না বাজতেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা লোকে-লোকারণ্য হয়ে যায়। এ সময় খবর আসে নবাবপুরে গুলি হয়েছে এবং কয়েকজন শহীদ হয়েছেন। এতে এক অগ্নিশিখার ঢেউ বয়ে যায়। বের হয় জঙ্গী মিছিল। নেতৃত্ব দেন সিরাজুল আলম খান, মহিউদ্দীন আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রণো, আইয়ুব রেজা চৌধুরী, রেজা আলী প্রমুখ। মিছিল যখন হাইকোর্ট পার হয়ে আব্দুল গণি রোডে প্রবেশ করছিল তখন মিছিলের পেছনে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। নিহত হয় বাবুল এবং গোলাম মোস্তফা (সরকারী বাসের কন্ডাকটর) একই সঙ্গে আহত হয় ওয়াজিউল্লাহ (গৃহকর্মী)। সে হাসপাতালে পরের দিন মারা যায়। আহত হয় অনেকে। ১৭ সেপ্টেম্বরের কর্মসূচীতে জনগণের অংশগ্রহণ কত ব্যাপক ছিল তার একটি দৃষ্টান্ত। বুড়িগঙ্গার ওপার থেকে নৌকার মাঝিদেরও সেদিন বৈঠা হাতে মিছিল নিয়ে আসতে দেখা গেছে। ছাত্র-ছাত্রী ও ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণে এভাবে চলমান আন্দোলনের শেষভাগে শহীদ সোহরাওয়ার্দী করাচী থেকে ঢাকায় এসে প্রাদেশিক গবর্নর গোলাম ফারুকের সাথে বৈঠক করেন। এরপর শরীফ কমিশন রিপোর্টের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চালানো হবে না মর্মে সরকারী ঘোষণা এলে এক পর্যায়ে আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

চলমান শিক্ষক আন্দোলন ও শিক্ষা দিবস
আজ যখন বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে তখন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আটানব্বই ভাগ দায়িত্ব পালনকারী বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মিগণ আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচী পালন নিয়ে ব্যস্ত। জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্টের আহ্বানে শিক্ষা জাতীয়করণের লক্ষ্যে ৮ দফা দাবি ও শিক্ষার উন্নয়নে ৭ সুপারিশ বাস্তবায়নের আন্দোলনে প্রাথমিক পরবর্তী বেসরকারী স্কুল-কলেজ, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করছেন। সরকার ইতোমধ্যে ২৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষক প্রতিনিধিদের সাথে শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি নিয়ে আলোচনা করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এদিকে ফ্রন্টও জানিয়ে দিয়েছে, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে যৌক্তিক দাবিগুলো সরকার মেনে না নিলে অবিরাম ধর্মঘটসহ নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে। এ প্রেক্ষিতে শিক্ষা দিবসে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মিগণ একদিকে যেমন পেশাগত প্রত্যাশা পূরণের আকাক্সক্ষা পোষণ করবেন একই সাথে শিক্ষার মান উন্নয়নে, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতে, শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি প্রদান বন্ধে প্রত্যয় ব্যক্ত করবেন। মতাদর্শ নির্বিশেষে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি শিক্ষাকে দলীয় বিবেচনার উর্ধে রাখার আহ্বান জানাবেন। গত বছর শিক্ষা দিবসের আলোচনায় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, পেশাজীবী সকলে দিনটিকে ‘জাতীয় শিক্ষা দিবস’ ঘোষণার দাবি জানান। আজ শিক্ষা দিবসের অর্ধশতক পূর্তি উপলক্ষে দেশের শিক্ষক সমাজ ও শিক্ষাকর্মিগণও একই ভাবে এর সাথে অভিন্ন মত ও পূর্ণ একাত্মতা প্রকাশ করবেন। শিক্ষা দিবসের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে সরকার এ দাবি মেনে নিলে তা হবে বিজ্ঞতার পরিচায়ক ও একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত।

লেখক : বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের সংগঠক, শিক্ষক নেতা principalqfahmed@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.