নিতাইদার কাছে চিঠি by মাজহারুল হক তপন

অসীম শূন্যতার মাঝে এ খোলা চিঠি আমার। এ চিঠি কোথায় গিয়ে পেঁৗছাবে, আদৌ কি পেঁৗছাবে কোথাও, নাকি মহাশূন্যের শূন্যতায় হারিয়ে যাবে আমরা কেউ তা জানি না। দু'যুগেরও বেশি সময়ের পরিচয়ে আপনাকে কখনও চিঠি লিখেছি কিনা মনে পড়ে না। চিঠি লেখার প্রয়োজনও হয়নি কখনও।


আপনি তো সবসময় ছিলেন আমার আদর্শিক গুরু হয়ে। আপনি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যের স্বার্থ রক্ষা করতে হয়। আজ আপনাকে চিঠি লিখতে গিয়ে কলম বারবার থেমে যাচ্ছে, চোখ ভারি হয়ে আসছে। এ রকমভাবে আপনাকে কিছু লিখব কখনও ভাবিনি। প্রায় প্রতিদিন কথা হতো আমাদের, দেখাও হতো নিয়মিত। আলাদা কর্মক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ততা, কোনো কিছুই আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে পারেনি। আমি মাঝে মধ্যে ভুলে গেলেও আপনি তো আমাকে ভুলে যেতে দেননি, দূরে যেতে দেননি আমাকে। পরিচয়ের প্রথম দিন থেকে শুরু করে ছোট ছোট কত শত ঘটনা এই মুহূর্তে ভেসে উঠছে চোখের সামনে। আমাদের মাঝে যে স্বপ্ন আপনি সৃষ্টি করেছেন, যে ভালোবাসা আমাদের দেখিয়েছেন তা কী করে শুকনো অক্ষরে তুলে আনব!
১৯৯৯ সালের ৭ ডিসেম্বর। এই দিনটির কথা কি আপনার মনে আছে দাদা? হয়তো আছে, হয়তো নেই। কিন্তু ওই দিনটির কথা আমি কখনোই ভুলব না। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের মাওনায় একই গাড়িতে ছিলাম আমরা। সড়ক দুর্ঘটনায় সবাই আমরা আহত হই। আমি মাথায় আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। গাড়ির ভেতর থেকে টেনে বের করেন এই আপনি। অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে অনেক কষ্টে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। পাকা তিনদিন পর আমার জ্ঞান ফেরে। দাদা, ওইদিনই হয়তোবা আমার জীবনের শেষ দিন হতে পারত। তা হয়নি। আমি আজও দিব্যি ঘুরছি-ফিরছি, খাচ্ছি-দাচ্ছি, আলো-বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছি। কিন্তু আপনি নেই। আমি তো আপনাকে ধরে রাখতে পারলাম না। আমি নতুন জীবন ফিরে পেয়েছিলাম আপনার সাহায্যে। আর আমি আপনার লাশের ওপর কয়েক ফোঁটা চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করতে পারলাম না। আপনার মৃত্যু আমাদের বড্ড অপরাধী করে গেল।
এক জীবনে অনেক ভুল করেছি, আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। অনেক সময় মতের অমিল হয়েছে, মিছে তর্কাতর্কি করেছি, বেয়াদবিও হয়তো করেছি। সব ক্ষমা করে দিয়েছেন আমি ক্ষমা না চাইতেও। কিন্তু দাদা আমি এখন অন্তত একটিবার সুযোগ পেতে চাই আপনার কাছে ক্ষমা চাওয়ার। আগে কখনও মনেই হয়নি কোনো ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেব, কিংবা তার প্রয়োজনও হতো না। নিজগুণে আপনিই ক্ষমা করে দিতেন সব। দাদা, আজ অন্তত একটিবার আত্মশুদ্ধির সুযোগ দিন, আমাকে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে বিনীত ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ দিন।
ভয়ঙ্কর খুনিরা রাতের অন্ধকারে আপনার শোবার ঘরে আপনাকে নৃশংসভাবে হত্যা করল। বক্ষব্যাধি হাসপাতাল প্রাঙ্গণে সেদিন ঢল নামল মানুষের, আপনার প্রিয়জনদের। চোখের জল ফেলতে ফেলতে আমার কেবলই মনে হয়েছে, এত মানুষের কান্না, এত মানুষের ভালোবাসার টান আপনি ছিন্ন করতে পারেন না। ফিরে আসুন দাদা আমাদের মাঝে। আমরা যে এখনও আপনার অপেক্ষায়। মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে আমি হঠাৎ করে দেখি আপনার ফোন... পরক্ষণেই ভুল ভাঙে, দেখি শূন্য স্ক্রিন। ঘোরের ভেতর আমার মাথায় শুধু একটা ভাবনাই ঘুরেফিরে আসে, ঘুম থেকে উঠে হয়তো দেখব ক্যালেন্ডারের পাতায় ২৩ আগস্টই নেই; আপনিও আছেন আমাদের মাঝে।

ডা. মাজহারুল হক তপন :সহকারী অধ্যাপক, বল্গাড ট্রান্সফিউশন বিভাগ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
 

No comments

Powered by Blogger.