জীবনের গতিময়তা by তৌফিক অপু
কলিং বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গেই দৌড়ে এসে দরজা খুলে দেয় বিন্তু। দরজায় দাঁড়িয়েই সজোরে নিশ্বাস ছেড়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল রাহাত। দেখে মনে হয় নগরের সকল ক্লান্তি যেন ভর করেছে তার ওপর। ঘরে ঢুকেই ধপাস করে বসে পড়ল সোফার ওপর। রাত তখন ন’টার মতো।
পাশের ঘর থেকে ছয় বছরের আরাফ দৌড়ে এসে একটি ছবি বাবাকে দেখাল অতি উৎসাহ নিয়ে। তাতেও যেন ক্লান্তি দূর হচ্ছিল না রাহাতের। বিন্তুকে ডেকে কিছু নাস্তা দেয়ার জন্য বলে রাহাত। প্রত্যুত্তরে রাহাত শুনতে পায় একবারে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খাওয়ার আহ্বান। এতে মেজাজ যেন চড়ে যায় রাহাতের। হালকা তর্ক-বিতর্কও শুরু হয়ে যায় দু’জনের মধ্যে। বিন্তুর যুক্তি, অফিস থেকে ফিরে এসে রাতের খাবার ছাড়া অন্যকিছু প্রস্তুত করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। রাহাত বাইরের সব খাবার পছন্দ করে না, আবার রাতের খাবার পর্যন্ত অপেক্ষা করাও যেন সম্ভব নয়। একরকম মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। যার রেশ সারা রাতই থাকে। কেউ কারও সামনে ইজি হতে পারে না। এভাবেই পরদিন আবার অফিস, বাড়ি ফেরা। জীবনটা যেন রূপ নেয় যান্ত্রিকতায়। এই যান্ত্রিকতায় না মিশেও যেন উপায় নেই। উন্নত বিশ্বের মানুষদের লাইফ স্টাইলের দিকে তাকালে দেখা যায় তারা প্রত্যেকেই কাজকে ভালবেসে যান্ত্রিকময় জীবনে অভ্যস্ত। অবশ্য ছুটির দিনগুলোতে তারা তাদের সারা সপ্তাহের অবসাদ ভুলে যাবার চেষ্টা করে। প্রতিযোগিতাময় বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আমাদেরও এর ব্যতিক্রম হওয়ার সুযোগ নেই। তবে একটা বড় ধরনের পার্থক্য বরাবরই লক্ষণীয়। উন্নত বিশ্বের যান্ত্রিক জীবন গুছিয়ে পরিচালনার বেশ কিছু সাপোর্টও তারা পেয়ে থাকে। যা আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। যে কারণে যান্ত্রিক জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। যেমন যানবাহনের সহজলভ্যতা, কাজের ফাঁকে দ্রুত সেরে নেয়ার মতো খাবার, সন্তানকে টেক কেয়ার করার মতো বিশ্বস্ত ডে কেয়ার ইত্যাদি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে দ্রুত স্বাস্থ্যসম্মত খাবার সেরে নেয়াটা যেন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জয়েন ফ্যামিলির ট্র্র্যাডিশন খুব একটা চোখে পড়ে না। বেশিরভাগই সিঙ্গেল ফ্যামিলি। এই ঢাকায় স্বামী-স্ত্রী এবং একটি কিংবা দুটি বাচ্চার পরিবারের সংখ্যাই বেশি। এই সিঙ্গেল ফ্যামিলির মধ্যে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই চাকরি করে এমন পরিসংখ্যান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একজনের চাকরির টাকায় যেন সংসারটা ভালভাবে সাজানো যায় না। তাছাড়া শিক্ষিত মেয়েরা আজকাল নিজেদের মেধাকে অলসভাবে পড়ে থাকতে দিতে নারাজ। এটা অবশ্যই সমাজ এবং দেশের জন্য ইতিবাচক দিক। তবে বিপত্তি ঘটে নিজ সংসারে। কারণ উন্নত বিশ্বে নিজের সংসারের ভার অনায়াসেই অন্যের ওপর দিয়ে কর্মক্ষেত্রে বেরিয়ে পড়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশে সেই পরিবেশ এখনও গড়ে ওঠেনি। যুদ্ধটা যেন সকাল বেলা থেকেই শুরু হয়ে যায়। বাচ্চাকে স্কুলের জন্য তৈরি করা, নাস্তা বানানো, টিফিন তৈরি করা, নিজেদের খাবার প্রস্তুত করা যেন বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। আবার রাতে এসে রাতের খাবারের ঝামেলা। যা রীতিমতো এক যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তার মধ্যে বাচ্চার টেনশন তো আছেই। অথচ খাবার প্রস্তুতের এ ঝামেলা থেকে যদি একটু নিস্তার পাওয়া যেত তাহলে কাজে একটু বেশি মনোযোগী হওয়া সম্ভব হতো। যা থেকে উন্নত বিশ্বের মানুষেরা অনেকটাই মুক্ত। যে কারণে তাদের কাজের গতিও বেশি। তবে আমাদের দেশেও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান কর্মজীবী মানুষদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক কিছুই এখন প্যাকেজ আইটেমের আওতায় চলে এসেছে। খাবার-দাবারেও এসেছে বৈচিত্র্যতা। চালু হয়েছে হোম ফুড ডেলিভারি সার্ভিস। তবে এখনও তা নিয়মিত হয়ে ওঠেনি। অথচ মানুষ কাজের চাপ কমানোর জন্য বিকল্প কিছু খুঁজছে। যেমন কোন প্রতিষ্ঠান যদি সকালের নাস্তার প্যাকেজ অফার করে এবং তা বাড়ি পর্যন্ত সময় মতো পৌঁছে দেয় তাহলে অনেকেই তা সানন্দে গ্রহণ করবে। দুপুরের খাবারের ক্ষেত্রে অফিসগুলোতে এখন ভিন্নতা দেখা যায়। অনেক ক্যাটারিং প্রতিষ্ঠান সুলভমূল্যে অফিস স্টাফদের জন্য দুপুরের খাবার সরবরাহ করে। এ চিত্র এখন প্রায় প্রতিটি অফিসেই দেখা যায়। খাবারটা যদি স্বাস্থ্যসম্মত হয় তাহলে বাড়ি থেকে খাবার বয়ে আনার ঝামেল পোহাতে হবে না। প্রাইভেট সেক্টরের অফিসগুলোর কাজের সীমা পরিসীমা নেই। দেখা যায়, অনেক সময় কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়। তখন বাসায় ফিরে রান্না করতে ইচ্ছে হয় না। এ ঝামেলা থেকে মুক্ত করতে কিছু ক্যাটারিং প্রতি বেলার মানসম্মত খাবার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে থাকে। ফলে ইচ্ছে হলেই যে কেউ এ ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে পারবে। তবে যান্ত্রিকতার এ যুগে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান আরও বেশি হওয়া প্রয়োজন। কল করা মাত্রই যদি হাতের কাছে পছন্দসই স্বাস্থ্যসম্মত খাবারটি পাওয়া যায়, তাহলে সময় বাঁচানো সম্ভব। যা অন্যান্য জরুরী কাজে লাগানো যায়। বেড়ে যাবে কর্ম-উদ্দীপনা। হাতে হাত রেখে তাল মেলানো সম্ভব হবে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে।
ছবি : আরিফ আহমেদ
মডেল : নাদিয়া নদী ও আনিসুজ্জামান
ছবি : আরিফ আহমেদ
মডেল : নাদিয়া নদী ও আনিসুজ্জামান
No comments