পোকামাকড়ের উৎপাত থেকে বাঁচতে

বাড়িতে পোকামাকড়ের ঘরবসতি হলে নানা যন্ত্রণা। কেউ চায়না বাড়িতে পোকা মাকড়ের আনাগোনা হোক। কিন্তু অবাঞ্ছিত অতিথি হিসাবে বাড়িতে নানা ধরনের পোকামাকড়ের আনাগোনা চলে বছরজুড়ে। পোকামাকড় ছাড়া কোন ঘরবাড়ি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ঘর থাকলে সেখানে পোকামাকড়ও আপনার সঙ্গী হতে চাইবে সর্বক্ষণ।


একটু সুযোগ দিলে, ওরা জেঁকে বসতে চাইবে আপনার ঘরবাড়িতে। আর পোকামাকড় বাড়িতে আস্তানা করার সুযোগ পায় ময়লা আবর্জনা থেকে। আপনার ঘরের ভেতরে এবং সংলগ্ন জায়গায় যদি ময়লা আবর্জনা জমে যায় তবে তার সঙ্গে আপনার বাড়তি পাওনা হিসাবে আরও যোগ হবে পোকামাকড়। সুতরাং আপনার ঘরদোর সবমময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ময়লা আবর্জনামুক্ত রাখার ব্যাপারে যতœবান ও মনোযোগী হতে হবে। ঘরের জানালা দরজা খুলে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ঢুকতে দেয়া উচিত। সম্ভব হলে ঘরের দেয়ালের রঙ রাখুন সাদা, অব হোয়াইট অথবা হালকা কোন আলোতে আবছা আলো আঁধারিতে ঘরে মশা মাছি, মাকড়সার বংশবৃদ্ধি ঘটে। উজ্জ্বল আলোয় পোকামাকড় কম হয়।
ঘরে পিঁপড়ার বিচরণ সর্বত্রই। ঘরের ভেতরে জেঁকে বসতে এরা সদাতৎপর। মিষ্টি কিছুর সন্ধান পেলে দলে দলে ভিড় করে পিঁপড়া। যেমন মিষ্টি খাবার, জ্যাম, জেলি, সন্দেশ, চিনি, কেক, বিস্কুট ইত্যাদি খোলা রাখলে সেখানে দলে দলে পিঁপড়া চলে আসে। পিঁপড়ার কবল থেকে রক্ষা পেতে কৌটার ঢাকনা শক্ত করে বন্ধ করবেন। কোনভাবেই যেন তারা ভেতরে ঢোকার সুযোগ না পায়। কৌটার গায়ে মিষ্টি জাতীয় কিছু যদি লেগে থাকে তাহলে ভেজা কাপড় দিয়ে তা ভালভাবে মুছে নেবেন। কৌটা রাখার তাক পরিষ্কার রাখুন, সেখানে কয়েকটি তেজপাতা ছড়িয়ে দিন। পিঁপড়ার উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন এবং সেটা ভালভাবে বন্ধ করে দিন। পিঁপড়ার উৎস খুঁজে বের করে তাদের গর্তে ফুটন্ত গরম পানি ঢালুন। তাহলে পিঁপড়ার বংশ ধ্বংস হবে। প্যারাফিনে তুলা ভিজিয়ে পিঁপড়ার গতে কিংবা যাতায়াতের পথে রাখুন, পিঁপড়া আর আসবে না।
বাড়িতে মাছির উপদ্রব হলে ভীষণ অস্বস্তি লাগে। খাবার দাবারে মাছি বসলে জীবাণুর সংক্রমণের মাধ্যমে রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। মাছির হাত থেকে রেহাই পেতে হলে পুদিনা পাতা বেটে বাটিতে রাখুন। এরপর বাটিটা খাবার জায়গা, রান্নাঘর বা যেখানে মাছির আনাগোনা বেশি সেখানে রাখুন। মাছি আর আসবে না।
রাতে মশা আর দিনে মাছি এই নিয়ে মহাযন্ত্রণায় আছি এ কথাগুলো বলেন অনেকেই। মশার যন্ত্রণা এখন সর্বত্রই। বড় শহরগুলোতে ঘনবসতিপূর্ণ নিচু ডোবাযুক্ত এলাকায় মশার দাপটে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়। মশার যন্ত্রণায় অস্থির হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শুধু যন্ত্রণা নয়, মশা অনেক দুরারোগ্য অসুখ ছড়ায়। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়াা, ফাইলেরিয়া ইত্যাদি রোগ হয় মশার কারণেই। অতএব মশার কবল থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হলে বাড়ির জানালা দরজায় জাল বা নেট লাগান। চেষ্টা করবেন সর্ব সময় মশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমোতে। ঘর মোছার সময় ইউক্যালিপটাস তেল দু’ফোঁটা পানিতে মিশিয়ে মুছুন। মশা কমবে। প্রতিদিন বাড়িতে বিকালে ধূপ ধুনা দিলে মশার প্রকোপ কমবে। প্রয়োজনে মশা তাড়াতে এ্যারোসল স্প্রে করতে পারেন। মশার কয়েলও আপনাকে কিছু সময়ের জন্য মশার কামড়ের যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করতে পারে। বাড়ির আরেকটি মহাবিরক্তিকর জিনিস হলো তেলাপোকা। এর বিচরণ সব ঘরের সবখানে। এরা সবখানে ঘুরে বেড়ায় বলে বেশ নোংরা হয়ে থাকে। আরশোলা বা তেলাপোকার যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে নিমপাতা পুড়িয়ে বাড়ির চারদিকে ধুলো দেয়ার মতো করে দিন। মশা, মাছি, আরশোলা তো যাবেই সাতে সাথে অন্যান্য পোকামাকড়ও কমবে। বাড়ির বিভিন্ন গর্ত, নর্দমা, পাইপের মুখে সামান্য করে কেরোসিন ছড়িয়ে রাখুন। ওখান থেকে যে সব পোকামাকড় বেয়ে ওঠে তাদের আনাগোনা কমবে। শসার খোসা দেয়ালের ধার দিয়ে ছড়িয়ে দিন, আরশোলা আসবে না। একটা প্লেটে দুধ চিনি গুলিয়ে তাতে বোরিক পাউডার দিন। রান্নাঘরের সব আলো নিভিয়ে রাখুন। পর পর কয়েকবার করুন। তবে একই জায়গায় প্লেট রাখবেন না। দেখবেন, আরশোলার বংশ হয়ে গেছে ধ্বংস। ঘরের অন্ধকার কোণগুলো শুকনো করে মুছে তাতে হলুদের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিন। আরশোলা আসবে না, রান্নাঘর বা বাথরুম যতটা পারেন শুকনো রাখার চেষ্টা করুন। বাড়িঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করুন। পানির পাইপ লিক হলে সেটা ঠিক করে ফেলুন। প্রতিদিনের ময়লা আবর্জনা প্রতিদিনই ফেলে দেবেন। জমিয়ে স্তূপ করে রাখবেন না। জমিয়ে রাখলেই তেলাপোকার উপদ্রব হবে। বোরিক পাউডার প্রতিটি নালার চারদিকে, গর্তে, কোনায় ছড়িয়ে দিন। এরপর গর্তে, নালায়, কোনায় কোনায় তেলাপোকা মারার ওষুধ স্প্রে করুন।
স্যাঁতসেতে আবহাওয়ার কােেণ মাছির প্রকোপ বাড়ে। মাছির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এটা রোগ ছড়ায়। তাই খাবার দাবার ভালভাবে ঢেকে রাখুন যাতে তার ওপর মাছি বসতে না পারে। শিশি বোতল, তাক, কাউন্টার ভাল করে মুছে রাখবেন। বাড়িতে ময়লা বেশি সময় ধরে জমিয়ে রাখবেন না, ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করবেন। প্রয়োজনে জানালায় নেট লাগানোর ব্যবস্থা করবেন। বাড়িতে কোন পোষা জন্তু থাকলে লক্ষ্য রাখবেন যেন যেখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ না করে।
ইঁদুরের যন্ত্রণায় কেউ কেউ অস্থির আছেন। বাড়িতে সব কেটে কুটে শেষ করে ইঁদুর। যা সামনে পাবে তা কেটে শেষ করাই যেন তার কাজ। বই, জামা-কাপড়, ব্যাগ, বস্তা, প্লাস্টিক এমনকি ইলেক্ট্রিক তার, রবার যাই হোক কেন তা কেটে সাবাড় করাতেই যেন ইঁদুরের শান্তি। ইঁদুরের কবল থেকে রক্ষা পেতে হ্যামিলনে বংশীবাদককে নিয়োজিত করা হয়েছিল। আপনার পক্ষে তেমন কোন বংশীবাদকের ব্যবস্থা করা সম্ভব না হলেও বাড়ির সব গর্ত বন্ধ করে দিন। ইঁদুর মারার বিষ দিলে সতর্ক থাকুন। যাতে তা শিশুদের নাগালের বাইরে থাকে। বাড়িতে ইঁদুরের উপদ্রব বেড়ে গেলে বিড়াল আনতে পারেন। কারণ বিড়ালের ভয়ে বাড়ির সব ইঁদুর পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। এতে ইঁদুরের উৎপাত অনেক কমে যায়। আজকাল ইঁদুর মারার বিষ পাওয়া যায় যা খেলে ইঁদুর বাড়ির মধ্য থেকে বাইরে বেরিয়ে যায় কিংবা ঘরের কোনায় মরে পড়ে থাকে। শেষে তা পঁচে গলে দুর্গন্ধ ছড়ায়। অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃস্টি করে।
ছারপোকার কামড় যে খেয়েছে সেই জানে এর জ্বালা কতটা। মেরুন রঙের আকারে ছোট কিন্তু এরা মারাত্মক। এ কথা সবাই স্বীকার করবেন। সাধারণত অন্ধকার হলে ছারপোকারা বের হয় এবং কামড়াতে শুরু করে। চুলকানি ছাড়াও ছারপোকারা সারা ঘরে এক অদ্ভুত গন্ধ ছড়ায়। ঘরে ছারপোকার উৎপাত বেশি হলে সেখানে ম্যালাথিয়ান ছড়িয়ে দিন ভালভাবে। এই ওষুধ ছড়ানোর সময় কাউকে চারদিকে যেতে দেবেন না, বিশেষ করে ছোট্ট শিশুদের। নাকেমুখে কাপড় বেঁধে স্প্রে করবেন ওষুধ। ওষুধ দেয়ার পর চার ঘণ্টা ঘর বন্ধ রাখবেন। ঘণ্টা দুয়েক ধরে আলো বাতাস ঢুকতে দেবেন। তারপর ঘর ব্যবহার উপযোগী হবে।
বই থাকে র‌্যাকে বা শেলফে। আমরা যারা বইয়ের একনিষ্ঠ পাঠক তাদেরকে বইয়ের পোকা বলে থাকি। তবে সত্যিকারের বইয়ের পোকা রয়েছে। এরা হাল্কা ধুসর বর্ণের ডানাহীন পোকা। এরা বই না কাটলেও বইয়ের বাঁধন এবং টেকসইয়ের জন্য ক্ষতিকর অবশ্যই। জাম্প, স্যাঁতসেতে আবহাওয়ার জন্য বইয়ের পোকার বংশবৃদ্ধি হয়, তাই মাঝে মধ্যে র‌্যাক বা শেলফে রাখা বইগুলোকে রোদে দিন, আলোবাতাস লাগানোর ব্যবস্থা করুন। নিয়ম করে নিয়মিত রোদে দিন বই। বইয়ের পোকা দূর হয়ে যাবে এভাবেই। এছাড়াও বইয়ে ম্যালাথিয়ান অল্প করে স্প্রে করে নিতে পারেন।
বাড়িতে কার্পেট থাকলে সেখানেও এক ধরনের পোকার উপদ্রব হয়, কার্পেটের পোকারা ছোট ছোট কালো, গাঢ় বাদামি কিংবা সাদা রঙের হয়, সাধারণত এরা বর্ষাকালে বেশি হয়। এই পোকার ডিমেই কার্পেটের ক্ষতি হয় বেশি। কার্পেটের পোকা থেকে বাঁচতে নিয়মিতভাবে কার্পেট রোদে দিতে হবে। পোকার বাসা খুঁজে বের করে তা নষ্ট করে দিন। কার্পেট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন। নিয়মিত ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহারে পোকা কমে যায়। ম্যালাথিয়ান ও মেথোক্সিক্লোর মিশিয়ে স্প্রে করবেন, পোকা হবে না, সব ধ্বংস হয়ে যাবে, সামান্য গ্যামক্সিন পাউডার ছড়িয়ে কার্পেট পাতবেন তাহলে আর পোকা হবে না।
আপনি যদি নিচতলার বাসিন্দা হন তাহলে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়ের পাশাপাশি কেঁচো, শামুক, শুয়াপোকার উপদ্রবের শিকার হতে পারেন। ঘরে কেঁচো বা শামুক বা শুয়াপোকা আসা বন্ধ করতে হলে পেঁয়াজের রসে এক চিমটে কর্পূর দিন, যে জায়গা দিয়ে এগুলো ঢোকে লক্ষ্য করে সেই জায়গায় এই রস মাখিয়ে রাখুন। পোকামাকড় ঢোকা বন্ধ হবে।
তাহমিনা মিলি

No comments

Powered by Blogger.