চলতি পথে- দুর্গাপুর অভিযাত্রার আনন্দ by দীপংকর চন্দ

কাছারিপাড়া থেকে বাগিচাপাড়া, উকিলপাড়া থেকে হাঁটতে হাঁটতে প্রবেশ করি আমলাপাড়ায়। দুর্গাপুর সাহিত্য সমাজের দ্বিতল ভবনের সামনে একটু দাঁড়াই আমরা। উল্টো দিকে তাকাই। একটি বাহুল্যবর্জিত প্রবেশ তোরণ আমাদের দৃষ্টিপ্রত্যক্ষে। ভেতরে সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত অতিদীর্ঘ উঠোন।


এদিক-ওদিক তাকাতেই মোক্তারপাড়া নিবাসী দীপক মজুমদার আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন, পরিচয়ের পালা শেষ হওয়ার পর তিনি জানালেন, ঘরগুলো সত্যিকার অর্থেই বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। কারণ, নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার বিখ্যাত রাজবংশের মধ্যমবাড়ি এটি।
মধ্যমবাড়িতে বসবাসকারী শেষ উত্তরাধিকারী ছিলেন দেবেশ চন্দ্র সিংহ, যিনি সবার কাছে পরিচিত ছিলেন মনি বাহাদুর নামে। ১৯৫২ সালে মনি বাহাদুর মধ্যমবাড়ি দেখাশোনার দায়িত্ব প্রদান করেন মধু দাসকে। মধু দাসের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরিরাই বর্তমানে বসবাস করছে মধ্যমবাড়িতে। দীপক মজুমদারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমরা প্রবেশ করি মধ্যমবাড়ির আঙিনায়। পরিচ্ছন্ন আঙিনার শেষ প্রান্তে দক্ষিণমুখী বসতঘর, ঠাকুরদালান ঘুরে দেখতে দেখতে অতীত স্মৃতিচারণায় মগ্ন হই আমরা। পুরোনো দিনের কথা ভাবি, ভাবি সুসং দুর্গাপুরের বিখ্যাত জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠালগ্নের কথা।
১২৮০ খ্রিষ্টাব্দ। গারো পাহাড়ের পাদদেশের এই দুর্গম অঞ্চল তখন শাসন করত বৈশা নামের একজন অত্যাচারী গারো রাজা। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল এলাকার নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠী। তারা এই দুঃশাসন থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজত। উপায় খুঁজত শান্তিতে বসবাসের। এমনই একসময় সোমনাথ পাঠক নামের একজন সুদর্শন ব্রাহ্মণ নীলাচল পাহাড়ের কামাখ্যা মন্দির পরিদর্শন শেষে একদল সঙ্গীসহ গারো পাহাড়ের পাদদেশে উপস্থিত হলেন। পাহাড় পাদদেশে একটি স্রোতস্বিনী নদী ছিল। সেই নদীর অপরূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত হলেন সোমনাথ পাঠক। সঙ্গীদের জ্ঞাতসারেই তিনি ধ্যানমগ্ন হলেন নদীতীরে।
কিছু স্থানীয় নিম্নবর্গীয় মানুষ তখন এদিক দিয়েই যাচ্ছিলেন। সোমনাথ পাঠকের ধ্যানমগ্ন অবয়বে তারা নিজেদের পরিত্রাতাকে খুঁজে পেলেন। করজোড়ে সোমনাথ পাঠকের কাছে অত্যাচার থেকে মুক্তির প্রার্থনা করলেন তাঁরা। নিম্নবর্গীয় মানুষের প্রার্থনায় সোমনাথ পাঠকের মন বিচলিত হলো। তিনি স্থানীয় অধিবাসীদের সহায়তায় অত্যাচারী গারো রাজাকে পরাস্ত করলেন এবং গারো পাহাড়ের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকাসহ পাহাড় সমতলের এক বিরাট অংশ নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন নতুন রাজ্য। সামন্ততান্ত্রিক এই নতুন রাজ্যের নাম দিলেন তিনি ‘সু-সঙ্গ’ অর্থাৎ ‘ভালো সঙ্গ’। সু-সঙ্গ রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ভীষণ আনন্দিত হলো স্থানীয় জনগণ। সোমনাথ পাঠকের নামানুসারে গারো পাহাড়ের পাদদেশের নদীটির নাম রাখলেন তাঁরা ‘সোমেশ্বরী’।
সুসঙ্গ রাজ্যের গোড়াপত্তন ঘটিয়ে রাজা সোমনাথ পাঠক নিজস্ব বাহিনীকে শক্তিশালী করার কাজে মন দিলেন। তিনি সুদূর আসাম থেকে কামাখ্যা দেবীর অনুসারী হাজংদের নিজ রাজ্যে নিয়ে এলেন। তারপর শুরু করলেন রাজ্যবিস্তার। সোমনাথ পাঠকের রাজত্বকালে সুসঙ্গ রাজ্যের সীমা উত্তরে নেংজা পর্বতমালা থেকে পূর্বে মহেষখলার মহেশ্বরী নদী, পশ্চিমে নিতাই নদী থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত সমতল ভূমি পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।
৭১৪ বঙ্গাব্দে সোমনাথ পাঠকের দেহত্যাগের পর সুসঙ্গ রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন তাঁর একমাত্র পুত্র গুণাকর। তারপর রাজ্য শাসন করেন গুণাকরের জ্যেষ্ঠ পুত্র কামাই হাজরা। এরপর সুসঙ্গ রাজ্য শাসন করেন যথাক্রমে বাসুদেব খাঁ, জগদানন্দ খাঁ ও জানকীনাথ মল্লিক।
জানকীনাথ আততায়ীর হাতে নিহত হলে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রঘুনাথ গ্রহণ করেন সুসঙ্গ রাজ্যের শাসনক্ষমতা। সুসঙ্গরাজ রঘুনাথ মোগল সম্রাটের পক্ষ নিয়ে সুবাদার ঈশা খাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার লক্ষ্যে এগারসিন্দুর অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু পথে রঘুনাথের বিরুদ্ধ পক্ষ তাঁকে বন্দী করলে হাজং ও গারো বাহিনীর সহায়তায় তিনি মুক্ত হন এবং এগারসিন্দুর থেকে পালিয়ে আসার সময় একটি অষ্টধাতুর দুর্গা প্রতিমা নিয়ে আসেন। রঘুনাথ দুর্গা প্রতিমাটি সুসঙ্গ রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করার পর থেকেই এলাকাটি দুর্গাপুর নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীকালে দুর্গাপুরের অগ্রে প্রাচীন সুসঙ্গ নামটি যুক্ত হয়ে এলাকার নাম লোকমুখে প্রচলিত হয় সুসঙ্গ দুর্গাপুর।
সুসঙ্গ রাজাদের উল্লেখযোগ্য কিছু নিদর্শন আজও রয়েছে দুর্গাপুর উপজেলা সদরে। এই মধ্যমবাড়ি ছাড়াও রয়েছে বড়বাড়ি, দু-আনিবাড়ি, ছোট তরফের জমিদার বাড়ি এবং দশভুজার মন্দির। এই দশভুজার মন্দিরেই রাজা রঘু স্থাপন করেন অষ্টধাতুর দুর্গা প্রতিমা, জানালেন দীপক মজুমদার। তবে আদি দুর্গা প্রতিমাটি এখন আর নেই এখানে। ১৯৬৫ সালে চুরি হয়ে যায় অনিন্দ্যসুন্দর সেই বিগ্রহটি।
বড়বাড়ি, মধ্যমবাড়ি, দু-আনিবাড়ি এবং ছোট তরফের জমিদার বাড়ির অবস্থা বর্তমানে ভীষণ করুণ। প্রভাবশালী বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান দখল করেছে এসব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার সিংহভাগ। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিবর্তন করেছে সম্পত্তির মালিকানা। এই অনিয়মতান্ত্রিক পরিবর্তন প্রক্রিয়ার শেষ কোথায়?
সদুত্তরের সম্ভাবনাহীন প্রশ্নটাকে পথেই ফেলে আসি আমরা। সঙ্গে শুধু আনি অভিযাত্রার আনন্দকে।
দীপংকর চন্দ

No comments

Powered by Blogger.