বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৫১৪ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবুল বাশার, বীর প্রতীক সাহসী এক যোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়। কয়েক দিন ধরে আবুল বাশার (আবুল বশার) ও তাঁর সহযোদ্ধারা যুদ্ধ-উন্মাদনায়। একটানা বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেছেন। দু-তিন দিন যুদ্ধের দামামা নেই।
যেকোনো সময় আবার দামামা বেজে উঠবে। তাঁদের অবস্থান এক জঙ্গলের ভেতরে। কয়েক কিলোমিটার দূরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা। সেখানে তাঁরা আক্রমণ করবেন। সে জন্য তাঁরা সমবেত হয়েছেন।
শীতকাল। কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে চারদিক সুমসাম। জঙ্গলে শুধু ঝিঁঝি পোকার ডাক। আর অন্ধকারে জোনাকি পোকার আনাগোনা। জঙ্গলের ভেতরে আবুল বাশাররা বিশ্রামে। তবে সতর্ক অবস্থায়। কেউ ঘুমিয়ে, কেউ জেগে। সবাই একসঙ্গে ঘুমাননি। পালা করে ঘুমাচ্ছেন।
ভোর হয়-হয়। এমন সময় আবুল বাশারদের অবস্থানে আকস্মিক আক্রমণ চালায় একদল পাকিস্তানি সেনা। শান্ত এলাকা হঠাৎ তীব্র গোলাগুলিতে প্রকম্পিত। শত্রুর আকস্মিক আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা হকচকিত। তবে দ্রুত তাঁরা নিজেদের সামলিয়ে নেন। যে যেভাবে পারেন পাকিস্তানি আক্রমণ মোকাবিলা শুরু করেন।
আক্রমণকারী পাকিস্তানি সেনারা ছিল বেপরোয়া ও অপ্রতিরোধ্য। জীবনের মায়া তাদের ছিল না। মরিয়া মনোভাব নিয়ে তারা আক্রমণ করে। এ রকম অবস্থায় সম্মুখযুদ্ধ ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না। আবুল বাশারসহ মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে আক্রমণ প্রতিরোধ করেন। কিন্তু বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করেও পাকিস্তানিদের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে ব্যর্থ হন। ফলে তাঁরা চরম নাজুক অবস্থায় পড়েন।
শহীদ ও আহত হন আবুল বাশারের কয়েকজন সহযোদ্ধা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান (মরণোত্তর বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত) শহীদ হন। পরবর্তী অধিনায়কও (লিয়াকত আলী খান বীর উত্তম) গুরুতর আহত হন। এতে বাশার দমে যাননি। জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। একপর্যায়ে তিনিও গুরুতর আহত হন।
পরে লেফটেন্যান্ট ওয়াকার হাসানের (বীর প্রতীক, পরে মেজর) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের অপর দল এসে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর তীব্র পাল্টা আক্রমণ চালায়। তখন যুদ্ধের গতি ক্রমশ মুক্তিযোদ্ধাদের আয়ত্তে আসে। শেষে পাকিস্তানি সেনারা সেখান থেকে হটে তাদের মূল অবস্থানে ফিরে যায়।
এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বরের। কানাইঘাটের গৌরীপুরে। সিলেট জেলার অন্তর্গত কানাইঘাট। সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষা। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে সিলেট অভিমুখে অভিযান শুরু করেন। তাঁরা প্রথমে চারগ্রাম দখল করেন। এরপর জকিগঞ্জ দখল করে কানাইঘাট দখলের জন্য ২৩-২৪ নভেম্বর গৌরীপুরে সমবেত হন। এর দুই মাইল দূরে কানাইঘাট ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা।
২৬ নভেম্বর ভোরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী (৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট) তাদের মূল ডিফেনসিভ পজিশন ছেড়ে পূর্ণ শক্তিতে অগ্রসর হয়ে হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের আলফা কোম্পানি নাজুক অবস্থায় পড়ে যায়। এই কোম্পানিতে ছিলেন আবুল বাশার।
আবুল বাশার চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। তখন তাঁর পদবি ছিল ল্যান্স নায়েক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৯ মার্চ ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবুল বাশারকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১১৭। তাঁর প্রকৃত নাম আবুল বশার।
আবুল বাশার ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। ২০০০ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি গোপালগঞ্জের সদর উপজেলার চন্দ্রদিঘলিয়া গ্রামে। বাবার নাম আবদুর রাজ্জাক, মা আঞ্জুমান নেছা। স্ত্রী সাহেদা বেগম। তাঁদের এক ছেলে ও তিন মেয়ে।
সূত্র: প্রথম আলোর গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি সুব্রত সাহা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info
শীতকাল। কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে চারদিক সুমসাম। জঙ্গলে শুধু ঝিঁঝি পোকার ডাক। আর অন্ধকারে জোনাকি পোকার আনাগোনা। জঙ্গলের ভেতরে আবুল বাশাররা বিশ্রামে। তবে সতর্ক অবস্থায়। কেউ ঘুমিয়ে, কেউ জেগে। সবাই একসঙ্গে ঘুমাননি। পালা করে ঘুমাচ্ছেন।
ভোর হয়-হয়। এমন সময় আবুল বাশারদের অবস্থানে আকস্মিক আক্রমণ চালায় একদল পাকিস্তানি সেনা। শান্ত এলাকা হঠাৎ তীব্র গোলাগুলিতে প্রকম্পিত। শত্রুর আকস্মিক আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা হকচকিত। তবে দ্রুত তাঁরা নিজেদের সামলিয়ে নেন। যে যেভাবে পারেন পাকিস্তানি আক্রমণ মোকাবিলা শুরু করেন।
আক্রমণকারী পাকিস্তানি সেনারা ছিল বেপরোয়া ও অপ্রতিরোধ্য। জীবনের মায়া তাদের ছিল না। মরিয়া মনোভাব নিয়ে তারা আক্রমণ করে। এ রকম অবস্থায় সম্মুখযুদ্ধ ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না। আবুল বাশারসহ মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে আক্রমণ প্রতিরোধ করেন। কিন্তু বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করেও পাকিস্তানিদের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে ব্যর্থ হন। ফলে তাঁরা চরম নাজুক অবস্থায় পড়েন।
শহীদ ও আহত হন আবুল বাশারের কয়েকজন সহযোদ্ধা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান (মরণোত্তর বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত) শহীদ হন। পরবর্তী অধিনায়কও (লিয়াকত আলী খান বীর উত্তম) গুরুতর আহত হন। এতে বাশার দমে যাননি। জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। একপর্যায়ে তিনিও গুরুতর আহত হন।
পরে লেফটেন্যান্ট ওয়াকার হাসানের (বীর প্রতীক, পরে মেজর) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের অপর দল এসে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর তীব্র পাল্টা আক্রমণ চালায়। তখন যুদ্ধের গতি ক্রমশ মুক্তিযোদ্ধাদের আয়ত্তে আসে। শেষে পাকিস্তানি সেনারা সেখান থেকে হটে তাদের মূল অবস্থানে ফিরে যায়।
এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বরের। কানাইঘাটের গৌরীপুরে। সিলেট জেলার অন্তর্গত কানাইঘাট। সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষা। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে সিলেট অভিমুখে অভিযান শুরু করেন। তাঁরা প্রথমে চারগ্রাম দখল করেন। এরপর জকিগঞ্জ দখল করে কানাইঘাট দখলের জন্য ২৩-২৪ নভেম্বর গৌরীপুরে সমবেত হন। এর দুই মাইল দূরে কানাইঘাট ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা।
২৬ নভেম্বর ভোরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী (৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট) তাদের মূল ডিফেনসিভ পজিশন ছেড়ে পূর্ণ শক্তিতে অগ্রসর হয়ে হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের আলফা কোম্পানি নাজুক অবস্থায় পড়ে যায়। এই কোম্পানিতে ছিলেন আবুল বাশার।
আবুল বাশার চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। তখন তাঁর পদবি ছিল ল্যান্স নায়েক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৯ মার্চ ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবুল বাশারকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১১৭। তাঁর প্রকৃত নাম আবুল বশার।
আবুল বাশার ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। ২০০০ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি গোপালগঞ্জের সদর উপজেলার চন্দ্রদিঘলিয়া গ্রামে। বাবার নাম আবদুর রাজ্জাক, মা আঞ্জুমান নেছা। স্ত্রী সাহেদা বেগম। তাঁদের এক ছেলে ও তিন মেয়ে।
সূত্র: প্রথম আলোর গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি সুব্রত সাহা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info
No comments