চারদিক- চাচা চা চান by রাজীব হাসান

বুড়ির হাট থেকে তাঁর বাড়ির পথ দেড় মাইলের ওপরে। না, সাইদ আলী কোনো দিন গজ-ফিতা দিয়ে মেপে দেখেননি। তবে তাঁরা যে আমলের লোক, তাতে পায়ে পায়ে হেঁটেই বলে দিতে পারেন দূরত্ব। দেড় মাইল কম লম্বা পথ নয়। এক মাইল হলো দেড় কিলোমিটারের বেশি। হাটুরেদের কাছে অবশ্য এটা সামান্য পথ।


তবে যেতে-আসতে সময় তো লাগবেই।
সেদিন বুড়ির হাট থেকে সওদাপাতি করে, বাড়ির কাছাকাছি আসতেই সাইদ আলীর মনে পড়ে গেল ‘আসল’ জিনিসটাই কেনা হয়নি। বাড়িতে বউ উনুন ধরিয়ে বসে আছে। তিনি বাড়ি ফিরলেই হবে রান্না। তারপর রাতের খাবার। এমনিতেই যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। আবার হাটে ফিরে গিয়ে বাড়ি আসতে সময় লাগবে। তার ওপর বউ যদি শোনে কোন জিনিসটা কেনার জন্য তিনি আবার ফিরে গিয়েছিলেন হাটে, তা হলে আর রক্ষা নেই।
কিন্তু বউয়ের সম্ভাব্য রক্তচক্ষু আর গজরানি উপেক্ষা করে সাইদ আলী ফিরতি পথ ধরলেন। আবার বুড়ির হাট। সামাদের দোকান থেকে কিনলেন তাঁর সেই ‘আসল’ জিনিস। তৃপ্ত মুখে ফিরলেন বাড়িতে।
কী সেই জিনিস? চিনি আর চা-পাতা!
চায়ের সঙ্গে তাঁর প্রেমের গল্প শুনতে চাওয়াতেই আজ থেকে ৪০ কি ৫০ বছর আগের এই গল্পটাই শোনালেন সাইদ আলী। পরিচিতজনদের কাছে অবশ্য তিনি চাচা, সাইদ চাচা। সত্তরোর্ধ্ব এই বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা রংপুর টাউন হলের গেটের পাশে। শহীদ মিনারে অনুষ্ঠান চলছে। বিকন নাট্যকেন্দ্রের দুই দশক পূর্তি উৎসব। আমন্ত্রিত অতিথি বক্তাদের ভারী ভারী জ্ঞানের কথা শুনে মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। মহৌষধ চায়ের সন্ধানে টাউন হল লাগোয়া শহীদ মিনার চত্বর থেকে বেরিয়ে ফটকের পাশের দোকানটায় গেছি। সঙ্গী দুই বাল্যবন্ধু অয়ন সরকার আর রকিবুল হাসান।
গরম চায়ে ফুঁ দিয়ে একটা চুমুক দিয়েছি কি দিইনি, ওমনি পাশ থেকে একটা বৃদ্ধ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘মোক একনা চা খাওয়াইমেন বাহে?’
জীবনে অনেক ভিক্ষুক দেখেছি। কিন্তু চা ভিক্ষা করতে এই প্রথম দেখলাম! স্বাভাবিকভাবেই লোকটা মনোযোগ কেড়ে নিল আমাদের। দোকানি কিন্তু তাঁর ওপর মহা বিরক্ত। বোঝা গেল, এই দোকানে বৃদ্ধ প্রায়ই হানা দেন। চায়ে চুমুকরত খদ্দেরদের কাছে এক কাপ চা খাওয়ানোর আরজি জানান। এমন উৎপাত দোকানি সহ্য করবেন কেন?
দোকানির কুকুর-খেদানি ধমকেও অবশ্য চাচা নির্বিকার। আমরাই তাঁকে এক কাপ চায়ের নিমন্ত্রণ জানালাম। সহাস্যে আমাদের নিমন্ত্রণ ‘রক্ষা’ করলেন। এসে দাঁড়ালেন আমাদের পাশে। সন্ধ্যার আবছায়ায় তাঁর দিকে ভালো করে তাকালাম।
পরনে সাদা পাঞ্জাবি। তার চেয়েও সাদা এক গাল দাড়ি। কোটরাগত ঘোলাটে এক জোড়া চোখ, যে চোখে বিগত দিনের যাবতীয় ধূসর স্বপ্ন। মুখের ভাঁজে সংগ্রামমুখর জীবনের মানচিত্র। চাহনিতে জীবনসংগ্রামে হেরে যাওয়ার গ্লানি। দেহভাষায় ক্লান্তি।
কিন্তু চায়ের কথা বলতেই চাচা রীতিমতো চনমনে। জানতে চাইলাম, আপনি কি মানুষের কাছে টাকাপয়সাও চান, নাকি শুধুই চা? ‘আগে টেকা-পয়সাও চাইতাম। কিন্তুক ছাওয়া-পাওয়া (ছেলেপুলে) আগ (রাগ) করে। এখন খালি চা-ই চায়া খাই’—লাজুক হেসে জানালেন সাইদ চাচা।
কিন্তু এত কিছু থাকতে চা কেন? ছোট্ট দোকানটায় তো আরও অনেক কিছুই আছে। মিষ্টি-নোনতা কয়েক পদের বিস্কুট। কেক। চাচা যেন আমাদের ওপর বিরক্তই হলেন। চায়ের সঙ্গে এসবের তুলনা চলে!
চায়ের নেশাটা ধরিয়েছিলেন তাঁর চাচি। ছেলেবেলায় উষ্ণ এই পানীয়র প্রেমে পড়ে যান। চা তাঁর জন্য এখন নেশা। সংসারের জোয়াল কাঁধ থেকে নেমে গেছে। ছেলেরাই ধরেছে হাল। তাঁর নিজের আয়ের কোনো পথ নেই। এমন একটা সংসার, যেখানে চা খাওয়া রীতিমতো বিলাসিতা। সন্তানদের কাছে চায়ের টাকা চাইতে সাহসে কুলোয় না। চেয়ে-চিন্তে চা খেতে চাওয়ার বিকল্প কী?
আফসোস করলেন, ‘হামার আমলত (্আমাদের সময়ে) এক আনায় চা আর নাটি বিশকুট (লাঠি বিস্কুট) পাওয়া গেছিল। এলা কী আর যায়! শোনেন দেকি কতা। এক কাপ চাও বলে অ্যালা পাঁ-চ টেকা!’ ‘পাঁ’ আর ‘চ’-এর মাঝখানে সাইদ চাচা লম্বা একটা টান দিয়ে আমাদের মূল্যস্ফীতি বোঝাতে চান। অর্থনীতি বোঝার জন্য মোটা মোটা বই বুঝি না পড়লেও চলে!
চা শেষ হতেই চাচা আর আমাদের পাত্তা দেন না। ‘থাকেন চাই, ম্যালাই টাইম হয়্যা গেল’ বলে কবজির অদৃশ্য ঘড়ির দিকে তাকান। কে জানে হয়তো সেখানে সত্যি সত্যিই একসময় ঘড়ি ছিল। ফুটপাতের পাশে তারকাঁটার দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা তাঁর মতো দেখতেই ভাঙাচোরা একটা সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে যান। প্রথম দেখায় চাচাকে যতটা ক্লান্ত মনে হয়েছিল, এখন কিন্তু তা আর লাগে না। সেটা চায়ের সঞ্জীবনী গুণের কারণেই কি না কে জানে!
রাজীব হাসান

No comments

Powered by Blogger.