আর্সেনিক মাত্রা ভয়াবহ ১০ বছরে রূপপুরে মারা গেছে ৫০ জন- পাবনার পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বাড়ছে by হামিদ-উজ-জামান মামুন

পাবনায় পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত ১০ বছরে শুধু জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর গ্রামেই আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া সেখানে আক্রান্ত হয়েছে আরও প্রায় ১ হাজার মানুষ। এ এলাকার কয়েকটি পরিবারের সব সদস্যই আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।


ওই এলাকা সরেজমিন ঘুরে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে আর্সেনিক প্রতিকারে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা ও ঢাকা কমিউনিটি ক্লিনিক এলাকায় কাজ করলেও কিছুটা সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়া কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। এখনও চলছে বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার।
পাবনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলার অধিকাংশ মানুষই আর্সেনিক ঝুঁকির মধ্যে আছে। জেলার ৯ উপজেলার পানিতেই আর্সেনিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ঈশ্বরদী উপজেলায় ২৫টি গ্রাম, পাবনা সদরে ১৫টি, সুজানগরে ৫০টি, সাঁথিয়ায় ২৫টি, বেড়ায় ৫০টি এবং আটঘরিয়া উপজেলায় ১০টি গ্রামে আর্সেনিকের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এসব এলাকায় আর্সেনিকের মাত্রা ভবিষ্যতে আরও বেশি হতে পারে। জনস্বাস্থ্য বিভাগসহ বেশ কিছু বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা আর্সেনিক নিয়ে সরেজমিন কাজ করে ফলাফল ভয়াবহ বলে মতামত জানিয়েছে। তারা মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা করে আর্সেনিকযুক্ত টিউবওয়েলগুলোতে ‘রেডমার্ক’ দিয়ে ঐ সব টিউবওয়েলের পানি খেতে এলাকাবাসীদের নিষেধ করেছে। পাবনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ মাহাবুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, ২০১০ সালের শেষ দিকে পানি পরীক্ষা করে দেখা গেছে রূপপুর ও নলগারিয়া গ্রামে পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা ৫০০ পিপিপি পর্যন্ত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা হচ্ছে মাত্র ৫০ পিপিপি।
রূপপুর গ্রামের বিবিসি বাজারের স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক (যিনি প্রথম আর্সেনিক রোগীর সন্ধান পান) ডা. আলমগীর পারভেজ জনকণ্ঠকে জানান, আশির দশক থেকে পাবনায় আর্সেনিকের আলামত পাওয়া যায়। ঐ সময় পদ্মা তীরবর্তী ঈশ্বরদীর রূপপুর এলাকায় অজ্ঞাত রোগে বেশ কিছু লোক মারা যায়। কিন্তু রোগ শনাক্তকরণ করতে না পেরে সে সময় আর্সেনিক আক্রান্তে এসব লোক মারা গেছে, এটা বলা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে দেশে আর্সেনিক আক্রান্তদের আলামত শনাক্ত করার পর বিশেষজ্ঞরা মত দেন ইতোপূর্বে পাবনায় অজ্ঞাত রোগে যাদের মৃত্যু হয়েছিল তাদের অধিকাংশই ছিল আর্সেনিক আক্রান্ত। গত দশ বছরে প্রায় ৫০ জন মারা গেছে আর্সেনিকের কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা আয়োজিত শিশু ও নারী উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম (চতুর্থ পর্যায়) ও ইউনিসেফের সহায়তায় পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, এই গ্রামের মসলেম উদ্দিন, ফাতেমা বেগম, মজিবর রহমান, আবেদা খাতুন, ফজলুল হক, পারুল, তরু, কনক, মুক্তার হোসেন, মকসেদ, সেলু, হাজেরা, বাবুল মালিথা, কুটু জান, লিলি, সাদ্দাম, খালেক, জাহাঙ্গীর, ফাতেমা, জরিনা, মানিক, জোহরা, বাবুল মালিক, নূর ইসলাম, সফর ফুরকুনি, নিপুণ, আদিলসহ প্রায় ৫০ জন আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এ ছাড়া আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়েছে এখানকার ১ হাজার মানুষ। এদের মধ্যে অনেক পরিবারেরই একাধিক ব্যক্তির আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু এবং মুমূর্ষু অবস্থায় জীবিত আছে। এমনই একজন সুজন মিয়া (২২)। আমিরুল ইসলামের পুত্র সুজন ছোটবেলা থেকেই আর্সেনিকে আক্রান্ত হন। বর্তমানে এ্যাজমায় আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। দেশে-বিদেশে অনেক চিকিৎসা করেও কোন ফল হচ্ছে না। তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও আর্সেনিকে আক্রান্ত। ডা. আলমগীর পারভেজ এ বিষয়ে বলেন, এর আগে ১৯৯৫ সালে ওই গ্রামের হাজী নুরুল হকের ছেলে জিয়া এভাবেই মৃত্যুরবণ করেছিলেন। তারও আর্সেনিক আক্রান্তের পর এ্যাজমা হয়েছিল। আর্সেনিক আক্রান্তদের হাত, পা শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত বিক্ষতের চিহ্ন দেখা যায়। ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর ছাড়াও চররূপপুর, বাবুলচড়া, উত্তরপাড়া, আরামবাড়িয়া, বাগান মলিকাপাড়াসহ ছলিমপুর ও লক্ষ্মীকু-া ইউনিয়নের বেশিরভাগ গ্রাম এখন আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এসব এলাকায় অধিকাংশ মানুষই এখন আর্সেনিক আক্রান্ত।
আর্সেনিক নিয়ে কথা বলতেই রূপপুর গ্রামের স্থানীয়রা জানান, আর্সেনিক নিয়ে সরকারের পাশাপাশি ঢাকা কমিউনিটি ক্লিনিকসহ বেশ কিছু বেসরকারী সংস্থা তাদের এলাকায় কাজ করলেও ফলাফল কিছুই আসেনি। শুধু আর্সেনিক তাড়ানোর নামে গচ্চা যাচ্ছে দাতা সংস্থার কোটি কোটি টাকা। তিনি আরও বলেন, এসব এনজিওর মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। ফলে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সরকারীভাবে আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। তাই উপায়ান্তর না দেখে এখানকার মানুষ বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে ‘রেডমার্ক’ চিহ্নিত টিউবওয়েলের পানি খেয়ে আর্সেনিক আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি করছে।
এ গ্রামেরই মোসলেম উদ্দিন জানান, ১৯৯৬ সালে এ এলাকা আর্সেনিক শনাক্ত হওয়ায় মানুষ সামাজিকভাবেও হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছে। এই এলাকার মানুষের সঙ্গে অনেকেই আত্মীয়তা করতে চান না। তাঁরা আরও বলেন, অনেকেই আর্সেনিক রোগ ছোঁয়াচে ভেবে এ রোগে আক্রান্তদের ঘৃণার চোখে দেখেন।

No comments

Powered by Blogger.