টিআইবির সুপারিশ বাস্তবায়িত হোক- নীরবতা ও বর্জনের অপসংস্কৃতি

আইন করে জাতীয় সংসদ বর্জন বন্ধ করার যে সুপারিশ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) করেছে, তা বিবেচনার দাবি রাখে। আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে সংসদীয় ঘোষণাপত্রের উন্মুক্ততার ঘোষণাপত্র প্রকাশ অনুষ্ঠানে গত শনিবার টিআইবি উত্থাপিত সুপারিশে টানা ৩০ দিনের বেশি সংসদ বর্জন করলে সদস্যপদ বাতিলের


কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া কোনো সাংসদ সংসদে গেলে একনাগাড়ে সাত দিন থাকতে হবে বলেও তারা সুপারিশ করে। বর্তমান আইনে টানা ৯০ দিন সংসদ বর্জন করলে সদস্যপদ বাতিলের বিধান আছে। এ সুযোগে বিরোধী দল সময়সীমা পার হওয়ার আগ মুহূর্তে সংসদে এসে ফের ৯০ দিনের সুযোগটি কাজে লাগায়।
টিআইবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পঞ্চম জাতীয় সংসদে যেখানে সংসদ বর্জনের হার ছিল ৩৪ শতাংশ, সেখানে নবম সংসদে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৮০ শতাংশে। এটি কেবল সংসদ কার্যকর করার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়ই নয়, গণতন্ত্রের জন্যও বিপজ্জনক। গত চারটি জাতীয় সংসদের অভিজ্ঞতা হলো, বিরোধী দল বাধ্য না হলে সংসদ অভিমুখী হয় না, আবার সরকারি দলও স্বেচ্ছাচারী কায়দায় সংসদ পরিচালনা করে থাকে। নির্বাচনে বিজয়ী দল সরকার পরিচালনা করবে, এটা সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু বিরোধী দল ছাড়া সংসদীয় গণতন্ত্র চলতে পারে না।
প্রশ্ন হলো, টিআইবি যে একটানা ৩০ দিন সংসদ বর্জন করলে সংসদ সদস্যপদ বাতিলের সুপারিশ করেছে, রাজনৈতিক দলগুলো তা মানবে কি না। বর্তমানে যাঁরা ক্ষমতায় আছেন তাঁদের কাছে এই মুহূর্তে প্রস্তাবটি আকর্ষণীয় মনে হলেও বিরোধী দলে থাকতে তাঁরাও একই কাজ করেছেন।
অতএব আমরা মনে করি, সংসদকে কার্যকর করতে আইনি বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠাও জরুরি। নির্বাচনী ফল মেনে বিরোধী দলকে যেমন সংসদে কার্যকর ভূমিকা রাখতে আন্তরিক হতে হবে, তেমনি সরকারি দলকেও সমালোচনা শোনার ঔদার্য দেখাতে হবে। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়েই সংসদে আলোচনা হয় না। বিরোধী দল সংসদ বর্জনের মধ্যে তাদের সাফল্য খুঁজে পায় আর সরকারের নীতিনির্ধারকেরা ৭০ ধারার দোহাই দিয়ে নিজ দলের সমালোচনাও বন্ধ করতে সচেষ্ট থাকেন। এ কারণেই টিআইবির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলতে চাই, সংবিধানের এই ধারা সংশোধের বিকল্প নেই।
গণতন্ত্রকে সুসংহত করার লক্ষ্যে টিআইবির সুপারিশে আরও যেসব পদক্ষেপের কথা রয়েছে, তার মধ্যে আছে বেসরকারি বিল হিসেবে সাংসদদের আচরণবিধি আইনে পরিণত করা, সাংসদদের আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করা, স্বার্থসংশ্লিষ্ট কমিটিতে সদস্য হিসেবে সাংসদদের না রাখার বিধান রেখে আইন করা, স্থায়ী কমিটির কার্যক্রম জনসমক্ষে প্রকাশ করা। এসব সুপারিশের সঙ্গে দ্বিমত করার অবকাশ নেই। সরকারি ও বিরোধী দলের সাংসদেরা ব্যক্তিগত আলাপে কিংবা সভা-সেমিনারে এর যৌক্তিকতা স্বীকার করেন। কিন্তু যেখানে তাঁদের সোচ্চার হওয়ার কথা, সেখানে তাঁরা নিশ্চুপ থাকেন। এই নীরবতা ও বর্জনের অপসংস্কৃতি থেকে গণতন্ত্র ও সংসদকে উদ্ধার করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.