ধর্ষক পুলিশের ছেলে, তাই বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা by পারভেজ খান ও রাশেদ আহমদ খান
হবিগঞ্জের বাহুবল মডেল থানার আবাসিক ভবনে গত শুক্রবার রাতে এক কনস্টেবলের ছেলে ওই থানারই এক এসআইয়ের ভাতিজিকে ধর্ষণ করে। এর জের ধরে ওই নির্যাতিতার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যার ঘটনায় পুরো পুলিশ বিভাগে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
এদিকে ঘটনার পর ধর্ষক যুবক ফাহাদ হোসেনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশেরই একটি মহল তৎপর হয়ে উঠেছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল রবিবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদল করে সহকারী পুলিশ সুপারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে পুলিশের আইজি খন্দকার হাসান মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেউ চেষ্টা করলে তাকেও কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটে গত শুক্রবার রাতে। এর পর পরই পুলিশ কনস্টেবল রুহুল আমিনের ছেলে ফাহাদকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু তারপর থেকে শুরু হয় ফাহাদের পক্ষে নানা মহলের তৎপরতা। গত শনিবার নিহতের চাচি কামরুন্নাহার বাদী হয়ে বাহুবল মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু এই মামলার তদন্ত নিয়ে শুরুতেই প্রশ্ন ওঠে থানার ওসি আজিজুর রহমান সরকারের বিরুদ্ধে। শনিবারই পুলিশের সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি এবং হবিগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের নির্দেশ দেন। গতকাল আজিজুর রহমান সরকারকে পরিবর্তন করে জেলা সদর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হককে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে আদেশ হলেও এখন পর্যন্ত তিনি মামলাসংক্রান্ত কোনো নথিপত্র পাননি বলে জানা গেছে।
এদিকে এই ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হচ্ছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমেদ, পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ সুপার নাজমুল ইসলাম ও হবিগঞ্জ জেলা পুলিশের ডিআইও-১ শফিকুল ইসলাম।
হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার কামরুল আমিন গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, মারজানা আক্তার যে আত্মহত্যা করেছেন সে বিষয়ে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে এর আগে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন কি না সেটা তদন্তসাপেক্ষ। আর এ ঘটনাটি কেউ ভিন্নখাতে নেওয়ার চেষ্টা করলে এবং সেটা প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে এই মামলাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ এনে থানারই কয়েকজন সাব-ইন্সপেক্টর কালের কণ্ঠকে বলেন, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজিজুর রহমান সরকার ঘটনাটি ভিন্নদিকে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। আর এ কারণেই ফাহাদকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হলেও তাকে রিমান্ডে আনার কোনো আবেদন জানানো হয়নি।
এই অভিযোগ অস্বীকার করে আজিজুর রহমান সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ফাহাদকে রিমান্ড চেয়ে আবেদন জানানো হয়নি এটা সত্য। প্রয়োজনে তাকে রিমান্ডে আনা হবে। তবে ফাহাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, প্রাথমিকভাবে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ কারণেই তাকে রিমান্ডে আনার আবেদন জানানো হয়নি। তবে একটা বিষয় সত্য যে, তাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ছিল।
পুলিশ সদর দপ্তরের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মতে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরিবর্তনের ঠিক আগ মুহূর্তে পুলিশের আবাসিক ভবনে এ ঘটনা পুলিশকেই কলঙ্কিত করেছে। অথচ থানার পক্ষ থেকে মারজানাকে দোষারোপ করে ঘটনাটিকে ভিন্ন দিকে নেওয়ার অপচেষ্টা চলছে।
বাহুবল উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল কাদির চৌধুরী এ ব্যাপারে কালের কণ্ঠকে বলেন, ধর্ষণ ও আত্মহত্যার ঘটনাটি স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চরম ব্যর্থতার ফল। এই ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়া হলে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না।
নিহতের পরিবারের সদস্যরা গতকালও অভিযোগ করে বলেছেন, থানার ওসিসহ সংশ্লিষ্ট পুলিশের অবহেলার কারণে মারজানা আত্মহত্যা করেছেন। শুক্রবার রাত ৯টার দিকে লোডশেডিং শুরু হলে এসআই রফিকুল ইসলামের স্ত্রী কামরুন্নাহার সন্তানদের নিয়ে বাসার বাইরে অবস্থান করছিলেন। এ সুযোগে একই ভবনে বসবাসরত কনস্টেবল রুহুল আমিনের ছেলে ফাহাদ হোসেন বাসায় ঢুকে মারজানা আক্তারকে ধর্ষণ করে। মারজানার চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে ফাহাদকে আটক করে। ঘটনাটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজিজুর রহমানকে জানানো হয়। ওসি আজিজুর, এসআই অহিদুর রহমান, কনস্টেবল দুলালসহ কয়েকজন ওই ভবনে যান। এ সময় তাঁরা ধর্ষণের শিকার মারজানাকে আপত্তিকর প্রশ্ন করতে থাকেন। এ অবস্থায় মারজানা লজ্জা ও ঘৃণায় ভেঙে পড়েন। এর জের ধরেই রাত সাড়ে ১২টার দিকে মারজানা তাঁর চাচার বাসার ছাদে উঠে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন।
ওসি আজিজুর রহমান এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, তিনি কোনো আপত্তিকর কথা বলেননি। তদন্তের স্বার্থে যেটা জানা দরকার, তিনি সেটাই জানতে চেয়েছিলেন মারজানার কাছে। এরপর এসআই অহিদুর রহমান, কনস্টেবল দুলাল, ওয়্যারলেস অপারেটর কনস্টেবল কাদিরকে ওই বাসায় রেখে তিনি থানায় চলে আসেন। পরে জানতে পারেন, মারজানা ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
লাফিয়ে পড়ে আহত হওয়ার পর স্থানীয় হাসপাতালেও মারজানার যথাযথ চিকিৎসা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। হাসপাতালে নেওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর তাঁর মৃত্যু হয়।
বাহুবল হাসপাতালের চিকিৎসক উম্মে তানিয়া নাসরিন জানান, আহত মারজানার শারীরিক অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাঁকে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে স্থানান্তরের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু বাহুবল মডেল থানার কনস্টেবল রুহুল আমিন নিজ দায়িত্বে মারজানাকে রেখে বাহুবল হাসপাতালেই চিকিৎসা দেওয়ার লিখিত অনুরোধ জানান। পরে চিকিৎসারত অবস্থায় মারজানার মৃত্যু হয়।
মারজানার চাচা এসআই রফিকুল ইসলাম বলেন, বাহুবল থানা থেকে মাত্র কিছুদিন আগে তিনি গোয়াইনঘাট থানায় বদলি হয়ে গেছেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরা বাহুবলেই থাকত। সংশ্লিষ্ট পুলিশের অবহেলার কারণেই মারজানা আত্মহত্যা করেছেন বলে তিনি দাবি করেন।
মারজানার মৃত্যু নিয়ে এলাকায়ও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। স্থানীয় সমাজকর্মী অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন বলেন, থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে যদি একটি মেয়ে নিরাপত্তা না পায় তাহলে বাহুবলের মানুষ কেমন আছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। এ ঘটনায় ধর্ষক ছাড়াও দায়িত্বপালনে ব্যর্থ সবার শাস্তি দাবি করেন তিনি।
স্থানীয় আরেক সমাজকর্মী মাওলানা আবদুল কাইয়ূম জাকি বলেন, থানা কম্পাউন্ডের মতো জায়গায় বসবাস করেও মারজানা নিরাপদে থাকতে পারলেন না। তাঁকে নিজ ঘরে ধর্ষণের শিকার হতে হলো। ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর মারজানা কাদের প্ররোচনায় আত্মহত্যা করলেন? পুলিশের সামনে থেকে কিভাবে দৌড়ে গিয়ে ছাদে উঠে লাফ দিলেন? পুলিশের কি দায়িত্বে অবহেলা ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর বের করতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নিলুফার ইয়াছমিন বলেন, থানার ভেতরে যেসব পুলিশ নারীর নিরাপত্তা দিতে পারে না, তাদের বাহুবল মডেল থানায় প্রয়োজন নেই।
No comments