সবার ভালোবাসায় আমি ধন্য

মানতে অনেক কষ্ট হচ্ছে, কিন্নরকণ্ঠী গায়িকা শাহনাজ রহমতউল্লাহ আর গান গাইবেন না। সম্প্রতি তিনি পাঁচ দশকের সঙ্গীত জীবনের ইতি টানার ঘোষণা দেন। তবে তার গাওয়া গানগুলো যুগ যুগ ধরে শ্রোতাদের আপ্লুত করবে, একথা বলাই যায়।


তাকে নিয়ে লিখেছেন শিমুল আহমে শাহনাজ রহমতউল্লাহ আর গাইবেন না, ভক্তরা এই খবরে আঘাত পেয়েছেন। তার কণ্ঠে শ্রোতারা শুনে এসেছে কালজয়ী গান 'একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়', 'এক নদী রক্ত পেরিয়ে', 'আমার দেশের মাটির গন্ধে', 'একতারা তুই দেশের কথা বলরে আমায় বল', 'সাগরের তীর থেকে', 'যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়', 'খোলা জানালা', 'পারি না ভুলে যেতে', 'ফুলের কানে ভ্রমর এসে', 'আমি তো আমার গল্প বলেছি'। এ দেশের সঙ্গীত ভুবনের এই গুণী শিল্পীর এমন আরও অসংখ্য গান রয়েছে। আবার তার কাছ থেকে নতুন গান পেতে আগ্রহী ভক্তরা। তবে নিজের সিদ্ধান্তে তিনি অনড়।
শিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লার জন্ম ১৯৫২ সালের ২ জানুয়ারি ঢাকায়। বাবা এম ফজলুল হক, মা আসিয়া হক। মায়ের হাতেই গানের হাতেখড়ি। ছেলেবেলা থেকেই তিনি শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পান। ১১ বছর বয়সে ১৯৬৩ সালে 'নতুন সুর' চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে প্লেব্যাক শুরু করেন। সেই থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত নিয়মিত গান করেছেন। টেলিভিশনে গান শুরু করেন ১৯৬৪ সাল থেকে। তার গাওয়া চলচ্চিত্র ও দেশের গান সমান জনপ্রিয়। সত্তরের দশকে প্রচুর উর্দু গীত ও গজল গেয়েছেন। প্রখ্যাত গজলশিল্পী মেহ্দি হাসানের কাছ থেকে তিনি গজল শিখেছেন। ১৯৭৩ সালে তিনি আবুল বাশার রহমতউল্লার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের এক ছেলে, এক মেয়ে। সঙ্গীতে অবদানের জন্য তিনি বহু পুরস্কারে ভূষিত হন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কার প্রভৃতি। এখন সঙ্গীতাঙ্গন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ঘরসংসার ও ধর্মীয় ভাবনা নিয়েই তার দিন কাটে। এ ছাড়া দিনের অনেকটা সময় কাটান বাগান পরিচর্যায়। গান গাওয়া ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার পর কথা হলো তার সঙ্গে।
গান ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন?
আমি দু'বছর আগে ওমরাহ করেছি। তখন থেকেই গান-বাজনার প্রতি আগ্রহ কমে গেছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আর সংসার নিয়ে এখন ব্যস্ত থাকতে চাই। আমার কোনো অভিমান নেই। সবার ভালোবাসায় আমি ধন্য। তাছাড়া এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের গানের ভুবনে একটু সময় ও সুযোগ করে দেওয়া উচিত। অনেকের কণ্ঠ অত্যন্ত সুন্দর, তাই তাদের একটু দেখিয়ে দেওয়া দরকার। তাদের প্রতি আমার পরামর্শ, নিয়মিত সারগাম চর্চা করতে হবে। আজকাল যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়ছে সবাই। দু'বছর আগে একটি মিশ্র অ্যালবামের জন্য গাইতে বলেছিল ডা. ইকবাল। ওই অ্যালবামে গাইতে গিয়ে আমার এ সময়ের গান রেকর্ডিং করার অভিজ্ঞতা হয়। মাত্র পাঁচ-ছয় মিনিটে পুরো গান রেকর্ড হয়ে যায়। এক লাইন শেষে হলে গানের অন্য লাইন রেকর্ড করা হয়। আমরা যখন আগে গান গেয়েছি তখন একটু ভুল হলে আবার পুরো গান গাইতে হতো। একেই বলে প্রযুক্তির আশীর্বাদ।
চলচ্চিত্রের গান কমিয়ে দিলেন কবে?
আমার বিবাহিত জীবন ৪০ বছর হতে চলেছে। বিয়ের পর থেকেই চলচ্চিত্রে গান করা কমিয়ে দিই। তখন থেকেই সংসারী হয়ে উঠেছিলাম। বিয়ের পরে তিনটি চলচ্চিত্রে গেয়েছি_ খান আতাউর রহমানের সুরে 'আবার তোরা মানুষ হ', আলাউদ্দীন আলীর সুরে 'সাক্ষী' ও আনোয়ার পারভেজের সুরে 'ছুটির ফাঁদে' চলচ্চিত্রে। এর মধ্যে 'ছুটির ফাঁদে' চলচ্চিত্রে গাওয়া 'সাগরের সৈকতে কে যেন দূর থেকে' গানটির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি।
অ্যালবামের জন্য শেষ গেয়েছিলেন কবে?
৫০ বছর গেয়েছি। প্রায় ১২-১৩ বছর ধরেই মূলত তেমন একটা গাইছি না। প্রয়াত প্রণব ঘোষের সুরে আমার একক অ্যালবাম 'বারোটি বছর পরে' বেশ জনপ্রিয় হয়। এরপর আলাউদ্দীন আলীর সুরে একটি একক বের হয়। আর এ মাসেই বের হলো ডা. ইকবালের সুরে মিশ্র অ্যালবাম 'বাদল দিনের পাখি'। এটাই আমার গাওয়া গান নিয়ে বের হওয়া শেষ অ্যালবাম। তাছাড়া কোনো টিভি অনুষ্ঠানেও অংশ নেবো না। আপনার জন্ম কোথায়?
আমার জন্ম ঢাকার নয়াপল্টনে। এখানেই আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। মূলত মায়ের কাছেই গানে হাতেখড়ি আমার। মা অনেক ভালো গাইতেন। তিনি আমাকে বলতেন, 'আমার অবদানের কথা কোথাও বলবি না।' এখন তিনি বেঁচে নেই, তাই আমি বলি। আমার বয়স যখন সাড়ে চার বছর তখন বাবা ও মায়ের উৎসাহে ব্রিটিশ কাউন্সিলে ছোটদের অনুষ্ঠানে প্রথম গান করি।
আপনার পরিবারে তো অনেকেই শিল্পী?
আমার চার ভাইয়ের মধ্যে দু'ভাই নেই। প্রয়াত নায়ক জাফর ইকবাল ও প্রয়াত সুরকার আনোয়ার পারভেজ আমার ভাই। বড় ভাই আনোয়ারের সুরে অসংখ্য গান গেয়েছি। জাফর ইকবাল অভিনয় ছাড়া গিটার বাজাতে ও গাইতে পারত। ও ভালো পিয়ানো বাজাত। বিটিভি আমাদের তিনজনকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করেছিল। আমরা মোট সাত ভাইবোন ছিলাম। এর মধ্যে তিন ভাইবোন মারা গেছে।
পরিবার ছাড়া অন্য কোথায় গান শিখেছেন?
সাড়ে চার বছর ব্রিটিশ কাউন্সিলে গান শিখেছি। এরপর আমার বাবা মারা যান। আমি তখন ছোট, তেমন কিছু মনে নেই। দিলি্ল থেকে আসা ওস্তাদ নূর হোসেনের কাছে প্রথম শিখেছি। তারপর ওস্তাদ ফুল মাহমুদ, আকতার সাদ মানিকের কাছে গান শিখেছি। আমি সবসময় উচ্চাঙ্গসঙ্গীত চর্চা করেছি। তারপর কিছুদিন গান শিখেছি শহীদ আলতাফ মাহমুদের কাছে। তাকে মামা ডাকতাম। আমাদের বাড়িতে তিনি কয়েকদিন ছিলেন। সুন্দর বেহালা বাজাতেন। আলতাফ মামা তখন 'আমার হাজার তারের বীণা'র আটটি গান সুর করেন। খান আতাকেও মামা ডাকতাম, তিনিও আমাকে অনেক শিখিয়েছেন। 'বাংলার মধ্যবিত্ত'তে গান গেয়েছি স্বাধীনতার পরপর। তিনি আমার গান থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, 'দেখ প্লেব্যাক করা এত সহজ নয়।' তারপর মাইকের সামনে আমাকে দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে গাইতে হয়। তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আলতাফ মাহমুদ আমাকে দিয়ে 'বেহুলা'র যে গানটি করিয়েছিলেন সেখানে আমার সঙ্গে কণ্ঠ দিয়েছিলেন খান আতা। গানটিতে রাজ্জাক ও কবরী ঠোঁট মেলান।
আপনি পড়াশোনা করেছেন কোথায়?
বাংলাবাজার স্কুলে পড়েছি। সেখানে থেকেই ম্যাট্রিক পাস করি। এরপর বারীণ মজুমদারের 'কলেজ অব মিউজিক' থেকে গান শিখেছি।
নিয়মিত গান-বাজনার শুরু কবে থেকে?
খেলাঘর থেকেই নিয়মিত গান-বাজনা শুরু করি। আমার ও সাবিনা ইয়াসমীনের শুরু খেলাঘর থেকে। খেলাঘরে লতিফ চাচা বাচ্চাদের নিয়ে বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠান করতেন। ১৯৬৫ সালে 'চিলড্রেন পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড' পেয়েছিলাম একটা আরবি গান গেয়ে। তারপরই 'তানহা' চলচ্চিত্রে গান করি। এরপর বাবুল ঘোষের সুরে 'নতুন সুর' চলচ্চিত্রে গান করেছি। এ চলচ্চিত্রে 'সি-এ-টি মানে বিড়াল' গানটি আমার গাওয়া। এ গানের মাধ্যমেই প্রথম শিশুদের কণ্ঠে প্লেব্যাক করি। বেতারে প্রথম গান আনোয়ার পারভেজের সুরে 'আমি পৃথিবীর এসব উজাড় করে দেব'।
১৯৭১ সালটি আপনার কেমন কেটেছে?
আমার ভাই জাফর ইকবাল মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। এর দু'মাস পর রাতে আমাদের বাসায় আসে জাফর। আমার কাজিন বেলাল তালুকদার পাকিস্তানে থাকতেন। হঠাৎ তিনি একদিন টেলিগ্রাম করলেন জাফর পাকিস্তানে গিয়েছিল, সেখানে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা জানতাম না তার পাকিস্তানে যাওয়ার খবর। সংবাদটি শুনে আমার মা খুব কান্নাকাটি শুরু করেন। বেলাল তালুকদার চিঠিতে লিখেছিলেন, দ্রুত যেন আমরা পাকিস্তানে যাই। আমি আর মা সংবাদটি শুনে করাচিতে যাই। দেশ স্বাধীন হলে আমরা জাফরকে ছাড়িয়ে নিয়ে ফিরে আসি। স্বাধীনতার আগেই আনোয়ার পারভেজের সুরে 'জয় বাংলা বাংলার জয়' গানটি গেয়েছি ঢাকায়। এটি অনেক দীর্ঘ ছিল, প্রায় ১৫ মিনিটের। এই গানে আমি ও আবদুল জব্বার কণ্ঠ দিয়েছিলাম, সঙ্গে সমবেত কণ্ঠও ছিল। লতিফ চাচা আমাকে দিয়ে গাওয়ালেন 'সোনা সোনা লোকে বলে সোনা' গানটি। আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত আর কীর্তনও গেয়েছি। ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের উপস্থাপনায় ১৯৮০ সালে বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে কবিগুরুর 'মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে' পরিবেশন করি।
আপনার অনেক দেশের গান রয়েছে।
'একতারা তুই দেশের কথা', 'এক নদী রক্ত পেরিয়ে'_ এমন অনেক দেশাত্মবোধক গান গেয়েছি। সে সময় চলচ্চিত্রে অনেক গাইতাম। জহির রায়হানকে অনেক কাছ থেকে দেখেছি। তার ছবিতেও গেয়েছি। বারীণ মজুমদারের কলেজে একবার সমাবেশ হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। সেখানে আমার ওস্তাদ নূর হোসেনের 'আপকো ভুল যায়ে হাম' গানটি গেয়েছিলাম।
পুনশ্চ : শাহনাজ রহমতউল্লাহর গান আমাদের হৃদয়ে দোলা দেয়। সমকালের প্রত্যাশা, এই গুণী শিল্পীর গানগুলো সংগৃহীত হোক। হ

জনপ্রিয় গান
একতারা তুই দেশের কথা
সাগরের সৈকতে কে যেন দূর থেকে
ফুলের কানে ভ্রমর এসে
সাত ভাই চম্পা জাগো রে
এক নদী রক্ত পেরিয়ে
সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা
তোমার আগুনে পোড়ানো এ দুটি চোখে
আমি তো আমার আগুনে জ্বলেছি
যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়
আমি যে তোমার কত প্রিয়
সাগরের তীর থেকে
কারও কারও পথ আছে কাঁটা দিয়ে ভরা
প্রতিদান চাই না
আরও কিছু দাও না দুঃখ আমায়

বিবিসির জরিপ
বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকায় শাহনাজ রহমতউল্লাহর গাওয়া চারটি গান স্থান পায়। এর মধ্যে আনোয়ার পারভেজের সুর করা দুটি, খান আতাউর রহমানের সুরে 'এক নদী রক্ত পেরিয়ে', আবদুল লতিফের সুরে 'সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা' গানটি রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.