মিডিয়া ভাবনা- সাহিত্য ও টিভির জন্য জাতীয় পুরস্কার by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
সম্প্রতি বেশ ঘটা করে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ দেওয়া হয়েছে। অনেক বছর ধরে সরকার চলচ্চিত্র পুরস্কার দিচ্ছে। এ জন্য সরকার তথা তথ্য মন্ত্রণালয় অভিনন্দনের দাবিদার। আমাদের মূলধারার চলচ্চিত্র যতই দুর্বল হোক না কেন, সরকার বাছাই করে ভালো সিনেমাগুলোকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এটা সরকারের একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।
এসব ক্ষেত্রে সরকারের নীতি কীভাবে নির্ধারিত হয় জানি না। অনুমান করি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী প্রস্তাব আকারে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি উপস্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীরা অনুমোদন করলে তা সরকারের ‘নীতি’ হিসেবে গৃহীত হয়। বাজারে এ রকম ধারণাও প্রচলিত রয়েছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা তাঁদের বিশেষ সূত্র মারফত প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব জেনে তারপর মন্ত্রিসভায় একটা ‘প্রস্তাব’ উত্থাপন করেন। বাংলাদেশে কাগজে-কলমে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার পদ্ধতি চালু থাকলেও বাস্তব অর্থে তা ‘প্রধানমন্ত্রীর’ সরকার। বড় দুই দলের আমলেই তা হয়েছে। কাজেই প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব না জেনে কোনো মন্ত্রী কোনো কাজ করেন না।
আমাদের মূলধারার চলচ্চিত্র মোটামুটি দুর্বল। বাংলাদেশে রুচিশীল, মননশীল, সচেতন ও শিক্ষিত দর্শকদের একটা বড় অংশ বাংলাদেশের সিনেমা দেখে না বললেই চলে। একটি টিভি চ্যানেলের উদ্যোগে কয়েকটি পরিচ্ছন্ন সিনেমা ও টেলিফিল্ম নির্মিত হওয়ায় তা ‘বাংলাদেশের মেইন স্ট্রিম’ সিনেমা বলে বিবেচিত হচ্ছে। এফডিসিকেন্দ্রিক সিনেমা নির্মাণ এখন অনেকটাই পড়তির দিকে। টিভি মিডিয়ায় নাটক যতটা জনপ্রিয়, বাংলাদেশের সিনেমা সে রকম জনপ্রিয়তা পায়নি। সারা দেশে সিনেমা হলের ব্যবসাও নিম্নগামী। বহু সিনেমা হল ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের প্রধান বিনোদন এখন সিনেমা নয়, টেলিভিশন।
তবে সত্যের খাতিরে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, পাকিস্তান আমলে ও স্বাধীনতার পর কিছু সময় সিনেমাই ছিল এ দেশের মানুষের প্রধান বিনোদন। সিনেমার সেই জনপ্রিয়তা ও চাহিদা এখন নেই বললেই চলে। এ জন্য চলচ্চিত্র নির্মাতারাই প্রধানত দায়ী।
‘বিকল্পধারার চলচ্চিত্র’ নামে কিছু ভালো ছবি নির্মাণের প্রয়াস মাঝেমধ্যে দেখা গেছে। তাদের উদ্যোগ অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এই বিকল্পধারাও তেমন এগোতে পারেনি। তথ্য মন্ত্রণালয় এই বাস্তবতা জানে না—তা আমরা বিশ্বাস করি না।
দেশের সিনেমাশিল্পের যখন এ অবস্থা তখন সরকার প্রতিবছর ঘটা করে সেই সিনেমার নানা শিল্পী ও কলাকুশলীকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সম্মানিত করছে। এর ফলে ঢাকার সিনেমা সম্পর্কে দর্শকদের আগ্রহ বা কৌতূহল বেড়েছে বলে আমাদের মনে হয় না। যাঁরা পুরস্কার পেয়েছেন, এটা তাঁদের ব্যক্তিগত আনন্দের উপলক্ষ হয়েছে—এটুকুই মাত্র। এর বেশি কিছু হয়নি।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার সরকার প্রতিবছরই দিতে থাকুক, এতে কারও আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু পাশাপাশি চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নে সরকার কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নেবে, এটাই চলচ্চিত্র অনুরাগীরা আশা করেন। সরকার এফডিসির স্টুডিওর উন্নয়নের জন্য সম্প্রতি টাকা বরাদ্দ করেছে। দেখা যাক তার ফল কী দাঁড়ায়।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা সব সময় যে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেন না, তার প্রমাণ মাঝেমধ্যেই পাওয়া যায়। সে রকম একটি হলো: দেশে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ রয়েছে অথচ ‘জাতীয় সাহিত্য’ ও ‘জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার’ নেই। যেকোনো সংস্কৃতিমান, সচেতন ব্যক্তিই সাক্ষ্য দেবেন, এ দেশে সাহিত্য ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মান অনেক উঁচুতে। সাহিত্যের রয়েছে বিরাট পাঠকগোষ্ঠী। টেলিভিশন তো এখন বাংলাদেশে সরকারের পরই সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান। প্রতিবছর শত শত নাটক, ধারাবাহিক নাটক, সংগীতানুষ্ঠান, টক শো, বৈচিত্র্যময় ফিচার অনুষ্ঠান টিভি মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। শত শত শিল্পী, লেখক, সুরকার, পরিচালক, উপস্থাপক এই মাধ্যমে প্রতিদিন তাঁদের সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখছেন। তাঁদের রাষ্ট্র কোনো স্বীকৃতি দেবে না?
সিনেমার একটি গান লিখেও এ দেশে জাতীয় পুরস্কার পাওয়া যায়, কিন্তু ২০০ পর্বের টিভি সিরিয়ালের লেখক জাতীয় পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হন না। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের তালিকাটি একবার দেখুন, কী কী খাতে পুরস্কার দেওয়া হয়। একজন শিশুশিল্পীও জাতীয় পুরস্কার পায়। কিন্তু টিভিতে অভিনয়ের জন্য একজন সুবর্ণা মুস্তাফা কোনো জাতীয় পুরস্কার পান না। পাওয়ার কোনো সুযোগই নেই। এ কী বৈষম্য!
আমাদের সাহিত্য ও গবেষণা অনেক উচ্চমানের। প্রতিবছর একুশে বইমেলায় দেখা যায় কত বৈচিত্র্যময় বই প্রকাশিত হচ্ছে। অবশ্য অনেক নিম্নমানের বইও প্রকাশিত হয়। সাহিত্য সৃষ্টি কি সৃজনশীল কাজ নয়? উঁচুমানের কবিতা, গল্প, উপন্যাস কি সবাই লিখতে পারেন? সাহিত্য রচনা এতই সহজ কাজ?
আমাদের সাহিত্যিকদের প্রতি সরকার খুব উপেক্ষা দেখিয়েছে। এটা এ দেশের সাহিত্যিকেরা প্রত্যাশা করেন না। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও এ দেশে উুঁ মানের সাহিত্য প্রতিবছরই রচিত হচ্ছে।
আমরা মনে করি, এ দেশে সংস্কৃতি ও তথ্যক্ষেত্রে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানমালা এক বিরাট বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। বিটিভির কথা বাদ দিয়েও যদি বলি, বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠানমালা এ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সৃজনশীলতাকে প্রতিবছরই এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি প্রচুর মানহীন অনুষ্ঠানও নানা চ্যানেলে প্রচারিত হয়। কিন্তু উপভোগ্য অনুষ্ঠানের সংখ্যাই বেশি। অথচ টিভি অনুষ্ঠানের জন্য কোনো জাতীয় পুরস্কার নেই।
আমাদের তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী এ ব্যাপারে মোটেও সচেতনতার পরিচয় দেননি। ‘চলচ্চিত্র পুরস্কার’ আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। তিনি তা অব্যাহত রেখেছেন মাত্র। কিন্তু সাহিত্য ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানের জন্যও বার্ষিক জাতীয় পুরস্কার প্রবর্তন করা যেতে পারে, তা মন্ত্রী হয়তো ভাবতেও পারেননি।
আমাদের অনুরোধ, তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বিষয়টি প্রস্তাব আকারে মন্ত্রিসভার একটি বৈঠকে উপস্থাপন করুন। আমাদের বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীরা বিষয়টি সমর্থন করবেন।
যেকোনো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি একজন সৃজনশীল মানুষকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
No comments