ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের কণ্ঠে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় by মুনিফ আম্মার
আলোর কণাটি খুবই ছোট। তবুও জ্বলে ওঠে আঁধার এলেই। চারপাশে আলোর দেখা পেলে আবারো নিভে যায়। অন্ধকারে আলো জ্বালবার জন্যই প্রস্তুত আলোর ছোট্ট বাতিটি, আলোর মাঝে আলো জ্বালতে নয়।
অদ্ভুত সুন্দর এই উদ্ভাবনটি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন উপস্থিত সবাই। জানতে চাইলেন, কেমন করে মাথায় এলো এমন সুন্দর আইডিয়া। উত্তর এলো নুহা, নাবিহা আর পূর্ণের মুখ থেকে। ভিকারুন নিসার সপ্তম শ্রেণীর এই শিক্ষার্থীরা অকপটে জানালো, “মর্নিং শিফটে পড়ি বলে খুব সকালে স্কুলে আসতে হয়। চারপাশ আলোকিত হয়ে গেলেও স্ট্রিট লাইটগুলো তখনও জ্বলতে দেখা যায়। মাথায় এলো এমন কোন লাইট আবিস্কার করা যায় না, যা আলো পেলেই নিভে যাবে। আবার জ্বলে উঠবে আঁধার এলেই।”
মুহুর্তেই চমকে উঠলেন সবাই। এতটুকুন ক্ষুদে বিজ্ঞানীর কাছে এমন সুন্দর উত্তরে সচেতন অনেকে লজ্জাও পেলেন। পরমুহূর্তে আবার বলে উঠলেন, “তোমরাই গড়বে আগামীর বাংলাদেশ।”
মঙ্গলবার ভিকারুন নিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ১৬তম প্রাণ ফ্রুটো ভিকারুন নিসা বিজ্ঞান প্রতিযোগিতায় এমন অসাধারণ অনেক উদ্ভাবন নিয়ে সমবেত হয় রাজধানীর হাজারো শিক্ষার্থী। নিজেদের সৃষ্টি দিয়ে মাতিয়ে তোলে বিজ্ঞান মেলা। একইসঙ্গে মুগ্ধ করে ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের দেখতে আসা সবাইকে।
ছড়ায় ছন্দে উদ্বোধন
সকাল ১১টায় ভিকারুন নিসার মিলনায়তনে বসে বিজ্ঞান মেলার উদ্বোধনী আসর। পুরো মিলনায়তন ভরপুর কানায় কানায়। মেলায় অংশগ্রহণকারী রাজধানীর ৭০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছুটে এসেছেন অভিভাবকরাও। চারপাশে পিনপতন নিরবতা। ভিকারুন নিসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মঞ্জু আরার সভাপতিত্বে শুরু হয় উদ্বোধনী আলোচনা।
মেলার প্রধান অতিথি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস কথা শুরু করলেন কবিতা দিয়ে। মুহুর্তেই মাতিয়ে তুললেন সবাইকে। স্বপ্ন জাগানো বক্তব্যে অনুপ্রাণিত শিক্ষার্থীরা করতালিতে মুখর করে তুললো উদ্বোধনী আয়োজন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বললেন, “প্রতিদিন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। এই ব্যবহার ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে শহর থেকে প্রান্তিকে। একসময় মোবাইলে কেবল কথা বলা যেতো। আজকাল মোবাইলে টাকাও পাঠানো যায়।”
কথা শেষ করতেই ছন্দ কাটলেন তিনি, “মোবাইলে তথ্য সেবা পাঠানো যায় মানি, বাঁচলো সময় বাঁচলো খরচ কমলো পেরেশানি”।
করতালির ঝড় উঠলো আবারো। বলে চললেন তিনি, “সবাইকে যে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে তা নয়। যে যে বিষয়ে পড়ুক না কেন, আইটি জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। বিজ্ঞান প্রতিমুহুর্তে পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে চলার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।”
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে স্থপতি ইয়াফেস বলেন, “তোমরা বাংলাদেশকে বদলে দেওয়ার জন্য জন্মেছো। বদলানোর শক্তি- সামর্থ ভালোভাবে অর্জন করতে হবে। দেখবে, ঠিকই বদলে দিতে পারবে বাংলাদেশ, গড়ে তুলতে পারবে স্বপ্নের মতো করে।”
“টাকা কড়ির টানটা প্রবল গতিটা তার রকেট, ভুলে গেলেন সব মহাজন কাফনের নাই পকেট” ছড়াটি দিয়েই অভিভাবকদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “ওরা জন্মেছে বিশেষ শক্তি সঞ্চয় করে। আমরা কেবল ওদের একটি বিষয়ে সাহায্য করতে পারি। সেটি হচ্ছে, সৎ ও নীতিবান মানুষ গঠনে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে নীতিবান মানুষ গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশ বেশিদিন পিছিয়ে থাকবে না।”
প্রধান অতিথির মনকাড়া বক্তব্য মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা হয়ে শুনলো সবাই। শিক্ষার্থীরা মনে মনে ধারন করলো সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়।
উদ্বোধনী আসরে আরও বক্তব্য দেন ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জিল্লুর রহমান, সাইন্স ক্লাবের মডারেটর মাজেদা বেগম ও ক্লাবের সভাপতি নিশাত তাসনিম রাফা।
পরে অতিথিরা প্রদীপের আলো জ্বালিয়ে মেলার উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
ক্ষুদে বিজ্ঞানী, বৃহৎ প্রদর্শনী
ভিকারুন নিসার পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের প্রদর্শনী। দারুন সব উদ্ভাবনীতে সাজানো আয়োজন। সবুজ বাংলাদেশ নিয়ে প্রজেক্ট সাজিয়েছে সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী নাজিফা, তামরিন ও শারিকা। চারপাশটা সুন্দর করে রাখলে কেমন করে বাংলাদেশকে সবুজে ভরে তোলা যায়, সে দৃশ্যই ফুটিয়ে তুলেছে তারা।
দলনেতা নাজিফা বাংলানিউজকে বললো, “আমরা এখন অনেক ছোট। বড় হয়ে যাতে বাংলাদেশটাকে স্বপ্নের মতো করে সাজাতে পারি, সেজন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি দরকার। সেই প্রস্তুতি এই দৃশ্য দিয়ে দেখিয়েছি।”
বিদ্যুতের লোডশেডিং কমানোর দারুন উদ্ভাবন নিয়ে এসেছে সাইকা ও নাজনীন। পরিত্যক্ত সামগ্রী দিয়ে কেমন করে আলো জ্বালানে যায়, সে কথাটিই জানিয়ে দিল তারা। বাংলানিউজকে সাইকা বললো, “পরিত্যক্ত কতো জিনিষ আমরা ফেলে দিই। একটু সচেতন হলে, সেগুলো দিয়ে বিদুৎ উৎপাদন করে লোডশেডিং যেমন কমানো যায়, তেমনি বিদ্যুতের খরচও বাঁচানো যায়।”
এতোসব সুন্দর আবিষ্কার করতে কতোদিন সময় লেগেছে প্রশ্ন করতেই প্রায় সবার কাছ থেকে উত্তর এলো, “তিন থেকে চার দিন”। আইডিয়া কার কাছ থেকে পেয়েছে, প্রশ্ন ছুঁড়তেই নুহা বললো, “সব আইডিয়া আমাদের নিজেদেরই। আমরা কারো কাছ থেকে আইডিয়া ধার করিনি। আমরা মনে করি, আমাদের এই আইডিয়াগুলো দিয়েই বাংলাদেশকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো।”
ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের এমন বৃহৎ প্রদর্শণী আর সুন্দর উদ্ভাবন দেখে মুগ্ধ হলেন সবাই। উচ্ছ্বসিত অভিভাবকদের কেউ কেউ বলে উঠলেন, আমরা কখনো এমনটি কল্পনাও করতে পারি নি। আমাদের সন্তানেরা তা করে দেখিয়েছে।
খিলগাঁও থেকে আসা শাহিনুর হাসনাত নামে এক অভিভাবক বাংলানিউজকে বলেন, “আমাদের সন্তানরা অনেক বেশি মেধাবী। পুরো আয়োজন তাদের আরো দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। এ ধরনের উদ্যোগ সব সময় হওয়া উচিত।”
মেলায় থাকছে গণিত অলিম্পিয়াড, পদার্থ অলিম্পিয়াড, রসায়ন অলিম্পিয়াড, অ্যাস্ট্রো অলিম্পিয়াড, মহাকাশ পর্যবেক্ষণ, সুডোকো প্রতিযোগিতা, সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতা, উপস্থিত বক্তৃতা, রুবিকস কিউব প্রতিযোগিতাসহ নানা আয়োজন।
মেলার ভেতর অন্যমেলা
বিজ্ঞান মেলা উপলক্ষে ভিকারুন নিসার মাঠ জুড়ে বসেছে খাবারের মেলা। শিক্ষার্থীদের নিজস্ব উদ্যোগেই এই আয়োজন করা হয়েছে। ১৪ টি ভিন্ন ভিন্ন বিভিন্ন শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা সাজিয়েছে নানা রকম খাবারের পসরা। আর সেগুলো ঘিরেই জমে উঠেছে আরেক আয়োজন। এ যেন মেলার ভেতর অন্য মেলা।
লেটস গো ইয়াম্মি নামে একটি খাবারের স্টল দিয়েছে নওশিন, প্রান্ত, ফারিন ও নাফিসা। বাংলানিউজকে তারা জানায়, সব খাবারই বাসা থেকে তৈরি করে আনা। নিজেদের তৈরি করা খাবার বিক্রি করতে অনেক আনন্দ লাগছে। ক্রেতারাও বেশ চাহিদা নিয়ে খাচ্ছে খাবারগুলো।
একইকথা শুনিয়েছে আড্ডাবাজ রিটার্নের ৯ বন্ধু। তারা বললো, বিজ্ঞান মেলাকে আরো সমৃদ্ধ করতে এই খাবারের আয়োজন করেছে তারা। আড্ডাবাজ নাম কেন হলো, এমন প্রশ্নের উত্তরে মীম বাংলানিউজকে জানায়, “আমরা সবাই খুব আড্ডা দিতে পছন্দ করি। আর আড্ডা দিতে দিতে খাওয়ার আমেজও আলাদা, তাই এই নাম।”
ফুড ভিলার আয়োজকরা পড়ছে উচ্চমাধ্যমিকে। মূল উদ্যোক্তা অধরা বাংলানিউজকে বলে, “গতবছরেও আমরা খাবারের দোকান দিয়ে বেশ আনন্দ করেছিলাম। এইবারইতো আমাদের শেষ বছর। তাই এই আনন্দ থেকে কোনভাবেই নিজেকে বাদ রাখতে চাই নি।”
চলবে মেলা চারদিন, আনন্দ সীমাহীন
প্রতিবছরের মতো এবারও বিজ্ঞান মেলা চারদিন একটানা চলবে। ১৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে মেলার সমাপনী ঘটবে বলে জানিয়েছে মেলার আয়োজকরা। এই চারদিনে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী মেলা পরিদর্শন করবে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে তারা। মেলা প্রসঙ্গে ভিকারুন নিসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মঞ্জু আরা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, “আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেক মেধাবী। প্রতিনিয়ত তারা যে সমস্যায় পড়ছে, সে সমস্যাগুলো থেকে উত্তোরণের নানা উপায় এই মেলায় তুলে ধরেছে। যা সত্যিই বিস্ময়কর। শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা এই মেলা সবসময়ই করতে চাই।”
প্রভা নামের এক শিক্ষার্থী জানায়, “বিজ্ঞান মেলা মানেই নতুনের সঙ্গে পরিচয়। এই মেলা সীমাহীন আনন্দ নিয়ে আসে। এই আনন্দে ভেসে আমরা গড়ে তুলবো স্বপ্নের বাংলাদেশ।”
No comments