মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার: আসামিপক্ষের জেরায় সুলতানা কামাল -গোলাম আযমের অনুমতি নিয়েই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটেছে

জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী সুলতানা কামাল জেরায় বলেছেন, গোলাম আযমের অনুমতি ও অনুমোদন নিয়েই একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ তিনি গতকাল বুধবার এ কথা বলেন।


আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামালকে গতকাল দ্বিতীয় দিনে প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। জেরার প্রথম দেড় ঘণ্টা গোলাম আযম আসামির কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। পরে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কারাকক্ষে (প্রিজন সেল) ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের তৃতীয় সাক্ষী সুলতানা কামাল গত সোম ও মঙ্গলবার প্রায় তিন ঘণ্টা জবানবন্দি দেন। এর আগে এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন এবং মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবউদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম (এসপি মাহবুব)।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা গোলাম আযম কবে, কোথায় করেছিলেন—গতকাল আসামিপক্ষের এ প্রশ্নের জবাবে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, এ ধরনের গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা মানুষকে জানিয়ে হয় না, এ জন্য বলা সম্ভব নয়। মতিউর রহমান নিজামী ছিলেন আলবদর বাহিনীর প্রধান এবং গোলাম আযম ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির। তাই হত্যাকাণ্ডের দায়দায়িত্ব গোলাম আযমের ওপর বর্তায়, কারণ তাঁর অনুমতি ও অনুমোদন নিয়েই এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। পরের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জামায়াতের কোন সভায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তা বলা সম্ভব নয়।
গোলাম আযম বুদ্ধিজীবী হত্যার অনুমোদন দিয়েছিলেন এমন কোনো প্রামাণ্য তথ্য কি আছে—মিজানুলের এ প্রশ্নে সুলতানা কামাল বলেন, নেই। তবে সংগঠনের প্রধানের অনুমোদন ছাড়া নেতা-কর্মীদের এ ধরনের কাজ করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া যাঁরা এ ধরনের কাজ করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এমনটাও দেখা যায় না। তাই সাংগঠনিক নিয়মানুসারে সংগঠনের প্রধানের ওপর এ ধরনের কাজের দায়দায়িত্ব বর্তায়। রাজাকার, শান্তি কমিটি, আলবদর ও আলশামস বাহিনী কি জামায়াতের অঙ্গসংগঠন—এ প্রশ্নে সাক্ষী বলেন, কাঠামোগতভাবে এ চারটিকে জামায়াতের অঙ্গসংগঠন বলা যায় না, কিন্তু এসব বাহিনীর কর্মকাণ্ড, অংশগ্রহণ ও কর্মপ্রক্রিয়ায় জামায়াতের ভূমিকাই মুখ্য ছিল। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির প্রধান ও সদস্যসচিব কি জামায়াতের নেতারা ছিলেন—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ সম্পর্কে তাঁর ধারণা নেই। তবে শান্তি কমিটির কর্মপদ্ধতি ও গঠনের বিষয়ে গোলাম আযমের ভূমিকাই মুখ্য ছিল, এটা পত্রিকা পড়ে জেনেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শান্তি কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়ে গোলাম আযম যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তা একাত্তরের ৫ ও ৭ এপ্রিল পূর্বদেশ ও আজাদ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, গোলাম আযম শান্তি কমিটির মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
মিজানুল প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কি খবরে গোলাম আযমের নাম খুঁজতেন?’ সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমি গোলাম আযমের নাম খোঁজার জন্য খবর পড়তাম না, খবরের প্রসঙ্গে তাঁর নাম এলে সেটা পড়তাম।’ শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর কোনো সদস্যকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা কি গোলাম আযমের ছিল—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা আমার জানার কথা নয়।’
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে কি সরকারি ও বেসরকারি কমিটি গঠন করা হয়েছিল—আইনজীবীর এ প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী বলেন, কমিটি গঠিত হয়েছিল কি না, তা বলতে পারবেন না, তবে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রায় ৫০টি মামলা হয়েছে—আইনজীবীর এ বক্তব্যে তিনি বলেন, অনেক মামলা হয়েছে, তবে এগুলোর সংখ্যা ৫০ কি না, তা জানা নেই।
একপর্যায়ে মিজানুল বলেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, ডা. আলীম চৌধুরী ও মুনীর চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তিনটি আলাদা মামলা হয়েছিল। শহীদুল্লাহ কায়সার হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ছিলেন জামায়াতের সদস্য খালেক মজুমদার, তাঁকে আলবদর বলা হয়েছিল। এই মামলায় নিম্ন আদালত শাস্তি দিলেও খালেক মজুমদার উচ্চ আদালতে আপিল করে খালাস পান। উচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়, খালেক মজুমদারকে আলবদর প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। সুলতানা কামাল এ বক্তব্যে ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব দেন। আইনজীবী বলেন, এই তিনটি মামলার কোনোটিতে গোলাম আযমকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী, প্রণয়নকারী বা অন্য কোনো আসামি করা হয়নি। সাক্ষী বলেন, এ তিনটি এককভাবে হত্যা মামলা হিসেবে করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দিচ্ছেন না, মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যায় গোলাম আযমের সামগ্রিক ভূমিকা নিয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন। আইনজীবী বলেন, একাত্তরের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দালাল আইনে দুটি মামলা হয়েছিল। এ মামলা দুটিতেও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ছিল না। সাক্ষী বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ছিল কি না জানা নেই, তবে কমপ্লিসিটির (মানবতাবিরোধী অপরাধে সম্পৃক্ততা) অভিযোগ ছিল।
মিজানুল বলেন, একাত্তরের ২২ নভেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত গোলাম আযম বাংলাদেশে ছিলেন না। সুলতানা কামাল বলেন, হয়তো ছিলেন না। কারণ ১ ডিসেম্বর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করতে শান্তি কমিটিই যথেষ্ট। পাকিস্তানের একজন সাবেক মন্ত্রীর বাড়ি থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নথিপত্র পাওয়া গিয়েছিল—আইনজীবীর এ কথায় তিনি বলেন, হ্যাঁ, কিন্তু কার কাছ থেকে তা মনে নেই।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামালকে বেলা একটা পর্যন্ত জেরার পর মামলার কার্যক্রম মুলতবি করা হয়। তাঁকে আজ বৃহস্পতিবার আবার জেরা করবে আসামিপক্ষ।

No comments

Powered by Blogger.