হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলা-ধর্মান্ধ শক্তিকে প্রশ্রয় নয়

ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা জজের আদালতে হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলায় অভিযোগ গঠিত হয়েছে সোমবার। অভিযুক্ত পাঁচজন। শুরুতে এটি ছিল হত্যাচেষ্টা মামলা, পরে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিলের মধ্য দিয়ে হত্যা মামলায় পরিণত হয়।


অভিযুক্তরা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও সংগঠক। আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের জনপ্রিয় শিক্ষক ও নন্দিত লেখক ড. হুমায়ুন আজাদের মৃত্যু হয়েছিল আট বছর আগে ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট। এ মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। মানবতাবাদী, উদারচেতা ও অসাম্প্রদায়িক এ লেখক ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর নৃশংস হামলার শিকার হয়েছিলেন এর সাড়ে পাঁচ মাস আগে ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীর সামনের সড়কে। একুশের গ্রন্থমেলার স্টল থেকে রাতে বাসায় ফেরার সময়ে তাকে ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত করে মৃতবৎ ফেলে রেখে যাওয়া হয়। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তার দিন কাটে প্রথমে ঢাকার কম্বাইন্ড মিলিটারি হসপিটাল এবং পরে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে। কিছুটা সুস্থ হলে তিনি জার্মানিতে যান এবং সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে। পরিবারের সদস্যরা এ হামলার জন্য প্রথম থেকেই ধর্মান্ধ অপশক্তিকে দায়ী করেন। লেখক-সংস্কৃতিসেবী থেকে শুরু করে গণতন্ত্রমনা প্রতিটি মানুষের অভিমতও ছিল অভিন্ন। কিন্তু সে সময়ে ক্ষমতাসীনরা ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করায় উঠেপড়ে লাগে। ধর্মান্ধ অপশক্তির বিপদ সম্পর্কে জনমত গঠনে যারা বিভিন্ন সময়ে হুমায়ুন আজাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদেরকেই এ হত্যা-প্রচেষ্টার জন্য অভিযুক্ত করার হীনচেষ্টা দেশবাসীকে স্তম্ভিত করে। সে সময়ে ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের মনোভাব কার্যত ছিল ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে শুধু তোষণ নয়, সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানেরও। এর পরিণতি দেশের জন্য আদৌ ভালো হয়নি। সরকারের প্রকাশ্য-গোপন মদদে ওই অপশক্তি বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং একের পর এক ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে গোটা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের চেষ্টা করে। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একযোগে ৬৩ জেলার শত শত স্থানে বোমা হামলা পরিচালনা, ঝালকাঠি-চট্টগ্রাম-নেত্রকোনাসহ কয়েকটি জেলায় জনবহুল স্থানে আত্মঘাতী বোমা-গ্রেনেড হামলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও যাত্রাপালা-সিনেমা হলে হামলা, গণতান্ত্রিক সরকারকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে উৎখাতের আহ্বান_ এসবই ছিল বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা চিরতরে বিনাশের ঘৃণ্য পরিকল্পনার অংশ। প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ এবং দেশশ্রেষ্ঠ কবি শামসুর রাহমানসহ মানবতাবাদী ও মুক্তচিন্তার ধারক প্রতিটি মানুষই ছিল তাদের শত্রু তালিকায়। গণতান্ত্রিক আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তাদের কাছে ছিল অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে এ গণবিরোধী শক্তি জনমনে আদৌ স্থান করে নিতে পারেনি। তাদের কর্মকাণ্ড শহর-বন্দর-গ্রাম সর্বত্র ধিক্কৃত হয়েছে এবং সরকারের কঠোর অবস্থানের সপক্ষে মিলেছে বলিষ্ঠ সমর্থন। 'অবশেষে' হুমায়ুন আজাদের হত্যা মামলার বিচার কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে যে শুরু হতে পারছে তার পেছনে এ জনমতের প্রভাব স্পষ্ট। এ ধরনের একটি চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার শুরুতে এত বিলম্ব তাদের বিচলিত শুধু নয়, উদ্বিগ্নও করে। অশুভ শক্তির দোসর কোনো শক্তি বিচার কাজে ফের বিঘ্ন ঘটাবে কি-না সে শঙ্কাও স্বাভাবিক। আর এখানেই গণতান্ত্রিক, মানবিক ও মুক্তমনা প্রতিটি নাগরিকের কাছে নবতর পর্যায়ে সচেতনতার প্রত্যাশা। তাদের সচেতন-সক্রিয়তাই ধর্মান্ধ শক্তি বাংলাদেশের বুকে কখনও যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে তার রক্ষাকবচ।

No comments

Powered by Blogger.