আব্দুল আলীমের ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত
দীর্ঘ ৩৮ বছর কেটে গেল। লোক সঙ্গীতের প্রাণ পুরুষ, লোক সঙ্গীতের মুকুটবিহীন সম্রাট, এক সময় বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যিনি দাপঠের সঙ্গে গান গেয়ে শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন, মরমী লোক সঙ্গীত শিল্পী, তিনি আর কেউ নন আমাদের সবার প্রিয় শিল্পী আব্দুল আলিম।
গত ৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় গ্রন্থাগার শওকত ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা ও সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান। আয়োজনে ছিলেন আব্দুল আলিম সঙ্গীত পরিষদ।
প্রতিভাধর এই শিল্পী পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম জনাব মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। শিল্পীর বয়স যখন ১০-১১ তখন তার এক চাচার বাড়িতে কলের গান (গ্রামোফোন) নিয়ে আসেন। শিল্পী তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। বাংলা ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদ বরকত তখন শিল্পীর সহপাঠী। প্রত্যেক দিন চাচার বাড়িতে গিয়ে তন্ময় হয়ে গান শুনতেন। শিল্পীর শিশু মনে সেদিন দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ক্রমে ক্রমে গান তার নেশায় পরিণত হয় । যার ফলে পড়াশোনা আর বেশিদূর আগাতে পারেনি। তাই কিশোর বয়সেই শুরু করলেন সঙ্গীত চর্চা।
শিল্পীর নিজ গামের এক ওস্তাদ, তার নাম হলো গোলাম আলী। তার কাছেই আব্দুল আলিমের প্রথম হাতে খড়ি। গোলাম আলী আলীমের গান শোনে মুগ্ধ হলেন। পরে তাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় পল্লী গানের শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং তিনি আব্দুল আলীমের গান শোনে ভূয়সী প্রশংসা করেন। কালবিলম্ব না করে তিনি আলীমকে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন আমির খসরুর কাছে নিয়ে যান এবং গান মেকার সুযোগ করে দেন। কিছুদিন গান মেকার পর শিল্পীর কলকাতা আর ভাল লাগলো না। তার মন ছুটলো নিজ গ্রাম তালিবপুরে। কিš‘ গ্রামে এসে দেখলেন তার গান বাজনা অনেক ক্ষতি হচ্ছে। এঅবস্থা দেখে তার বড় ভাই মোহাম্মদ হাবীব আলী তাকে একরকম ধরে বেঁধে কল কাতায় নিয়ে যান। তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের চরম রূপ লাভ করে। সময় ছিল ১৯৪২ সাল। শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক কলকাতায় আলীয়া মাদ্রাসায় বক্তৃতা দিতে আসেন। মাদ্রাসার মাঠ ছিল সেদিন লোকে লোকারণ্য। তিল পরিমাণ পা রাখার জায়গা ছিল না সেদিন। বড় ভাই হাবীব সেদিন শিল্পীকে নিয়ে গেলেন সেই সভায়।
এক সময় মঞ্চ থেকে শিল্পীর নাম ঘোষণা করা হলো। আব্দুল আলীম নিজেই অবাক হলে এবং ভাবলেন বড় ভাই আলীমকে না জানিয়ে এত বড় একটা কাজ করেছেন। তবও দুরু দুরু মন আস্তে আস্তে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যান এবং মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তিনি “সদা মন চাহে মদি না যাব” গানটি পরিবেশন করেন। সেদিন তার গান শোনে এ কে ফজলুল হক ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন এবং গান শেখার জন্য উৎসাহ প্রদান করেন। পরে বাজারে গিয়ে তাকে পাজামা, পাঞ্জাবি, টুপি, জুতো, মোজা সব কিনে দেন। এর পর শিল্পী বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন এবং তার গান শোনে মেগাফোন কোম্পানির ট্রেনার বাবু ধীরেন দাসকে শিল্পীর গান রেকর্ড করার নির্দেশ দেন। সেই বছর (১৯৪৭)সাল তার দুটো গান রেকর্ড হয়।
শিল্পী বিদেশে যেখানেই গেছেন সেখান থেকে সঙ্গীত পরিবেশন করে দেশের জন্য মানসম্মান নিয়ে এসেছেন। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে ১৯৬৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ১৯৬৬ সালে চীন সফর করেন। এই দুই দেশেও তিনি প্রচুর সুখ্যাতি অর্জন করেন। বিদেশে বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের মান বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে শিল্পী আবদুল আলীমের অবদান অনস্বীকার্য। বলতে গেলে, আবদুল আলীমই বিদেশে আমাদের লোকসঙ্গীতকে পরিচিত করেছেন। শিল্পী বাংলাদেশ টেলিভিশন ও রেডিও ছাড়া দেশের বিভিন্ন ছায়াছবিতে অসংখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তিনি প্রথম প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে কণ্ঠ দেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ-এ। এ পর্যন্ত শিল্পীর ৪০০-৫০০ গান রেকর্ড হয়েছে, এছাড়াও স্টুডিও রেকর্ডেও প্রচুর গান আছে।
শহিদুল ইসলাম
No comments