সিডনির মেলব্যাগ- সময় বয়ে যাচ্ছে প্রবাসী জনমত অপেক্ষায় by অজয় দাশ গুপ্ত
যে যাই বলুক না কেন আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অস্তিত্বের মূল সূত্রই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। অর্থাৎ বাংলাদেশ। যতদিন যাচ্ছে একটা বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক দল, দলের শাখা-প্রশাখা বা অন্যান্য উপসর্গ নিয়ে বিবদমান প্রবাসী বাংলাদেশীরা মূলত দু’ভাগে বিভক্ত, এর একদিকে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও আধুনিক ধারার মানুষ।
অন্যপ্রান্তে বিএনপি বা জাতীয়তাবাদের উগ্রতায় জামায়াত তোষণ ও পাকিস্তানপ্রীতি। সিডনিতেও তাই দেখছি,্ এখানে নয় নয় করে বেশ কয়েকটি ওয়েব মিডিয়া, বাংলা কাগজ ও বাংলা রেডিও আছে। আছে একটি বাংলা টিভির সময় বেঁধে দেয়া প্রচার। এই টিভিটি যিনি করেন সেই রহমত উল্লাহকে আমি ধন্যবাদ জানাই। প্রচুর শ্রম ও মেধা বিনিয়োগ করে সপ্তাহান্তে মাপা সময়ে বিদেশ বাংলা টিভি বাঙালীর দৃশ্যমান মিডিয়া হিসেবে টিকে আছে। যে কথা বলছিলাম, এই মিডিয়া জগতের বেশিরভাগই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রাজনীতির সপক্ষে, ঘোরতর আওয়ামী ঘেঁষা বা দল অনুরাগী না হলেও এদের কার্যক্রমে বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃতি বা ভুল ধারার প্রতি সমর্থন নেই। ফলে আমরা অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশীরা এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগি না। কিন্তু খুব গোপনে দ্বৈত সত্তায় উপরে আদর্শের বা মুক্তিযুদ্ধের তকমা ধারণ করলেও কারও কারও আওয়ামী বিরোধিতা প্রায়শই এককেন্দ্রিক ও স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে মিলে যায়। অথচ এরাই অন্যদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বলে শনাক্ত করতে পছন্দ করে। জাতীয় রাজনীতির স্বভাব দোষের এই ভাগাভাগি বিদেশে রফতানি করা বেঠিক কাজ হলেও আকছার তাই ঘটে চলেছে।
আগেভাগে বলে রাখি, প্রবাসী জনমত সরকারের ইমেজ ও ভবিষ্যত নিয়ে দু’কথা বলার চেষ্টায় এই লেখা। প্রবাসীরা দেশে কেবল টাকা পাঠায় না। তাদের যোগাযোগটা দেশের সাথে আত্মার। পরিবারের সাথে অনেকটা দাপটেরও বটে। খুব স্বাভাবিকভাবেই অর্থের যোগানদাতা বা সচ্ছলতা পাইয়ে দেয়া বিদেশী সন্তান, ভাই, বোন বা আত্মীয়ের আলাদা কদর থাকে। তাদের কথা শুনতে হয়, মানতেও হয় ক্ষেত্র বিশেষে। আগামী নির্বাচনে এদের মনোভাবের গুরুত্ব তাই উড়িয়ে দেয়ার মতো কিছু নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, গ্রামীণ ব্যাংক, ড. ইউনূস, পদ্মা সেতু, হলমার্ক কেলেঙ্কারিÑযাবতীয় বিষয়ে দ্বিখ-িত, তর্ক সাপেক্ষে মতামতগুলোকে সমন্বয় করার প্রয়োজনীয়তা এখন দোরগোড়ায়। কোন আহাম্মকও এ কথা বলতে পারবে না, শেখ হাসিনার সরকারের সব পদক্ষেপেই অনুজ্জ্বল বা নিন্দনীয় কিছু, বরং এই সেদিন দেশ ঘুরে আসা বুয়েটের প্রাক্তন এক শিক্ষক, যিনি এ দেশেও শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, সুদূর ভোলায় বিদ্যুতের সরবরাহ আর সহজপ্রাপ্যতায় তাঁর সন্তোষের গল্প করছিলেন। আজকের বাংলাদেশে গণতন্ত্র যে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পাচ্ছে তার পেছনে এই সরকারের সহিষ্ণুতা ও উদারতার কথা ভুলে গেলেও চলবে না। ওয়ান ইলেভেনের অব্যবহিত পূর্বের বাংলাদেশকে যেন ভুলে না যাই আমরা। ভয়ে মানুষ দেশে যেন জিম্মি হয়েছিল, প্রবাসীরাও জিম্মি ছিলেন নানাভাবে, কেউ স্বস্তি শান্তিতে দেশে যেতে পারতেন না। আজ সেই ভয় নেই, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সরকারের মু-ুপাত কঠিন কঠোর সমালোচনা করার পরও বহাল তবিয়তে লেখা, কথা, বাগাড়ম্বর চলছে। বলছি না বলা যাবে না, আমি নিজেও বলছি, লিখছি, সিডনি ভ্রমণে আগত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের উপস্থিতিতে সমালোচনা ও নিন্দার যে ঝড় বয়ে গেছিল, জাতীয়তাবাদীরা তা সহ্য করত না। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিশ্চিত দেশে যাওয়াটা বন্ধ হতোই, অত্যাচার নিপীড়নের মুখোমুখি হওয়াটাও বিচিত্র কিছু ছিল না। আওয়ামী লীগের অন্ধ সমর্থক হবার প্রয়োজন নেই।
সত্য কথা বলতে কি তাকে সমালোচনা করার ভেতরও ভালোবাসা থাকে। যেন নিজের সন্তানের প্রতি বা অভিভাবকের প্রতি দায়বোধ, প্রাপ্য প্রাপ্তি, প্রত্যাশা পূরণ না হলে অভিমান, ক্ষোভ বেদনার ঝড় প্রমাণ করে মানুষ আওয়ামী লীগকেই ভালোবাসে। প্রবাসেও তাই, সে কারণেই সামনের দিনগুলোয় অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী বিশেষত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রাজনীতির প্রতি অনুগতদের দায়িত্ব যাবতীয় অপপ্রচার ও দেয়ালের বিরুদ্ধে মুখ খোলা, রমজানের কারণে শোক দিবসগুলো স্থগিত হয়েছিল আগস্ট মাসে। সেপ্টেম্বরে প্রায় অনেক শোক দিবস হতে চলেছে, উদ্যোক্তাদের উচিত হবে বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা, জীবনী, উদ্ভাসের পাশাপাশি শেখ হাসিনার সরকারের ন্যায্য সমালোচনা করে, দুর্নীতিগ্রস্ত, বাতিলদের বাদ দিয়ে নতুনভাবে পথচলা ও দায়িত্বভার নেয়ার লক্ষ্যে জনমত সংগঠন করা। যে সব মিডিয়া প্রবাসে সচল তাদেরও এ কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কাজটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই একদল মানুষ যে ষড়যন্ত্র বা মিথ্যাচার করে তার উপযুক্ত জবাব দেয়া। সিডনির বঙ্গবন্ধুপ্রেমী অস্ট্রেলিয়ার বুকে ছড়িয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশপ্রেমী জনগোষ্ঠীর সে আগ্রহ ও শক্তি দুটোই আছে। প্রয়োজন নেতৃত্ব, প্রয়োজন উদ্যোগ, তাহলেই বন্ধু আবিদ রহমানের ভাষায় লুণ্ঠন, ঘুষ, দুর্নীতিবাজ দু’নাম্বারী প্রচার মুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ আবহের বলয় গড়ে তোলা সম্ভব। এ আশা অন্যায্য কিছু নয়। সময়ই এর পক্ষে কথা বলবে।
No comments