প্রশাসনে অনিয়ম-গতিশীলতার জন্য সংস্কার জরুরি

রাষ্ট্রের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে প্রয়োজন একটি গতিশীল জনপ্রশাসন। জনপ্রশাসনের স্থবিরতা দূর করা যেকোনো সরকারেরই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। আবার প্রশাসনের সব ক্যাডার সার্ভিসের মধ্যে সুসমন্বয়েরও প্রয়োজন রয়েছে। আন্তক্যাডার সমন্বয় না থাকলে অনেক কাজেই অসুবিধা হবে।


কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে আমাদের দেশে প্রশাসনের এক ক্যাডারের সঙ্গে অন্য ক্যাডার সার্ভিসের এক ধরনের ফারাক তৈরি হয়ে আছে। তৈরি হয়েছে আস্থার সংকট। দেখা দিয়েছে ক্যাডার-বৈষম্য। এসবের পাশাপাশি দলীয়করণ বলে একটা ব্যাপার চালু আছে। সর্বত্রই আনুগত্যের পরীক্ষা দিয়ে চলতে হয়। আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াটা যেখানে নিয়মে পরিণত হয়, সেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন স্তরে নানা জটিলতা দেখা দেওয়াটাই স্বাভাবিক। নিয়মকানুন কিংবা বিধিবিধান মানা না হলে অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়। তার ফলে অনেকের বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। বঞ্চিতদের মধ্যে সৃষ্ট হতাশা থেকে প্রশাসন যেমন গতিহীন হয়ে পড়তে পারে, তেমনি অন্য ক্যাডারেরও একই ধারাবাহিকতায় স্থবির হয়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়।
বাংলাদেশের ক্যাডার সার্ভিসে বিভিন্ন সরকারের আমলে সুবিধাভোগী একটি শ্রেণী তৈরি হয় বলে অভিযোগ আছে। এই শ্রেণীটি দলীয় আনুগত্যে পরীক্ষিত। বিশেষ করে প্রশাসনে এই শ্রেণীর দেখা পাওয়া যায়। পদোন্নতি থেকে শুরু করে সর্ববিধ সুবিধাভোগী এই শ্রেণীটিকে ঘিরেই সংশ্লিষ্ট সরকারের আমলে সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রশাসনে দলীয়করণের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে শ্রেণীবৈষম্যের মতো নানা বৈষম্যের অভিযোগও রয়েছে। পদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি বা টাইম স্কেল নিয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। কিন্তু অন্য ক্যাডারের ক্ষেত্রে তা হয়নি। ২৭টি ক্যাডারের ৬০ হাজার কর্মকর্তা বঞ্চিত হয়েছেন। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বঞ্চিত এসব কর্মকর্তা হতাশায় ভুগছেন। এই হতাশা উন্নয়নের অন্তরায়। দেখা যাচ্ছে, সুবিধাদি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়েছে ২৭ বছর আগের সুপারিশও। ১৯৮৫ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন অনুবিভাগ থেকে জারি করা অফিস আদেশে সব ক্যাডারে একজন গ্রেড-১ বা সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার পদ রাখার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি, এমনকি জোট সরকারের আমলে আড়ালে চলে যাওয়া বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গঠিত কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের দিকেও বিগত সাড়ে তিন বছরে কারো দৃষ্টি পড়েনি।
প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে, তা দূর করতে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকেই হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে শীর্ষ ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারলে কোনো ক্ষেত্রেই ফলদায়ক কিছু আশা করা যায় না। পদোন্নতি, টাইম স্কেল, অ্যাডহক নিয়োগসহ নানা ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা। সংবিধানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিচালনার জন্য আইন প্রণয়নের নির্দেশনা থাকলেও গত ৪০ বছরে তা প্রণীত হয়নি।
প্রশাসনসহ সব ক্যাডারের মধ্যে সুসমন্বয় একান্ত আবশ্যক। সবারই লক্ষ্য হওয়া উচিত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দেশের অগ্রগতির স্বার্থে সবাইকে কাজ করতে হবে। প্রাপ্ত সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে গিয়ে অন্যকে বঞ্চিত করা অন্যায়। প্রশাসন যদি গতি হারায়, ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে যদি অবিশ্বাস জন্ম নেয়, তাহলে এর সুদূরপ্রসারী ফল পড়বে দেশের আগামী দিনের ওপর। প্রশাসনে অনিয়ম পরিশেষে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও কল্যাণকর চরিত্রই বিনষ্ট করে দিতে পারে। রাষ্ট্র কার্যত গণবিরোধী ও নিপীড়ক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তবু আশার কথা, প্রধানমন্ত্রী বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন। আমরা আশা করব, সব অনিয়ম দূর হবে। প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে নিয়মে ফিরবে প্রশাসন।

No comments

Powered by Blogger.