শিশুর খাদ্যাভ্যাস by তাহমিনা মিলি

বাচ্চাদের হজমে সমস্যা হলে একসঙ্গে অনেক অসুবিধে হয়। পেটে ব্যথা, বমি, গ্যাসট্রাইটিস- সব মিলেমিশে বেশ জটিল ব্যাপার। জন্মের ছ’মাস পর থেকেই বাচ্চার ফুড হ্যাবিট ঠিকমতো গড়ে তুলতে পারলে, এর অনেকটাই সামলে দেয়া সম্ভব। বাইরের খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে বাড়ির পুষ্টিকর খাওয়া যথাযথ পরিমাণে খাওয়ান।


ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সারাদিনে খাবার ভাগ করে দিন। দেখবেন হজমের সমস্যা অনেকটাই সমাধান করতে পেরেছেন।

কেন হয়
অতিরিক্ত জাঙ্ক ফুড ও বাইরে খাবার খাওয়ার কারণে বাচ্চাদের মধ্যে গ্যাস্ট্রোহাইসোফেগাল রিফ্লাক্স ডিজিজ সমস্যা দেয়া যায়। এক বছরের বাচ্চা থেকে বড় বাচ্চাদের মধ্যেও তাই হজমের গোলমাল দেখা যায়। আর এখন দু’তিন বছরের বাচ্চারাও জাঙ্ক ফুড খাচ্ছে। টিফিনে চিপস, ফ্রায়ে স্ন্যাক্স দেয়া হয়। হজমের গোলমালের সঙ্গে বাচ্চাদের পেটে ব্যথা, বমি হয়। এই বয়সের বাচ্চাদের হজমের সমস্যা হচ্ছে, সেটা অনেক মা-বাবাই বুঝতে চান না।
ঠিক সময়ে না খেলে, অনেক সময় খালি পেটে থাকলেও হজমের সমস্যা দেখা যেতে পারে। ধরুন সকালে খাবার খাওয়ার পরে স্কুলে গেল। তারপর টিফিন খেলই না। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে খেল। এই যে এতক্ষণ একটা গ্যাপ হয়ে গেল, এতে এ্যাসিড সিক্রেশন বাড়ছে, সেখান থেকে গ্যাসট্রাইটিস ডেভলপ করছে। জাঙ্ক ফুড থেকে অনেক সময় পেটে ইনফেকশনও হচ্ছে। জাঙ্ক ফুড থেকে অনেক সময় পেটে ইনফেকশনও হচ্ছে। ইনফেকশন থেকে ডায়রিয়া হতে পারে। বার বার ইনফেকশন হলে বাচ্চার হজম ক্ষমতা, রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাও কমে যায়।
কৃমি থেকে পেট ব্যথা হওয়া বোধহয় বাচ্চাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। কৃমি এক ধরনের প্যারাসাইট যা শরীরে ঢুকে সাধারণত অন্ত্রে বাসা বাঁধে। আপনার বাচ্চা যা খাচ্ছে তার ওপর কৃমি বেঁচে থাকে এবং বড় হয়। অন্ত্রে থাকাকালীনই কৃমি ডিম পাড়ে এবং সেখান থেকে নতুন কৃমির জন্ম হয়। এভাবেই ক্রমশ কৃমির বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে। স্টুল টেস্ট করে বোঝা যায় কৃমি হয়েছে কিনা। কৃমির প্রধান চিকিৎসা ডিওয়র্মিং। তবে শুধু বাচ্চার ডিওয়র্মিং করালেই হবে না। ছয় মাস অন্তর বাড়ির বাচ্চার সঙ্গে বাড়ির সকলের ডিয়র্মিং করা জরুরী।
জিয়ার্ডিয়া এক ধরনের ডাইজেস্টিভ ট্র্যাক্ট ইনফেকশন। যদি কোনভাবে জিয়ার্ডিয়া লাম্বলিয়া (এক ধরনের প্যারাসাইট) ক্ষুদ্রান্ত্রের ওপর অংশে বাসা বেঁধে ফেলে তখন পেট ব্যথা, পেট খারাপ, বমি হতে পারে। স্টুল টেস্ট করে জিয়ার্ডিয়া নির্ণয় করা হয়। ৫-৭ দিন এ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়া জরুরী। এছাড়াও বাচ্চা যাতে প্রচুর পরিমাণে পানীয় খায় (সক্ট ড্রিঙ্ক নয়), খেয়াল রাখতে হবে।
এইচ পাইলোরি বলে এক ধরনের ইনফেকশন হয়। ইউরেজ টেস্ট করে জানা যায় এর কারণে গ্যাসট্রাইটিস হয়েছে কিনা। এছাড়া এ্যামিবায়োসিস, কোলাইটিসের কারণেও বাচ্চাদের মধ্যে হজমের সমস্যা হতে পারে।

প্রতিরোধ
ছ’মাসের পর বাচ্চা প্রথম সলিড ফুড খেতে শুরু করে। ন’মাস পর্যন্ত দিনে তিন বার সেমি সলিড খাবার খাওয়া জরুরী। ন’মাসের পরে দিনে চারবার সেমি সলিড খাবার খাওয়া উচিত। বাচ্চা সলিড খাবার না খেলে শুধু দুধ খাইয়ে রেখে দেয়া ঠিক নয়। এতে হয়ত ওজন বাড়বে, কিন্তু বাচ্চার হজম ক্ষমতা গড়ে উঠবে না। পরবর্তীকালে বাচ্চাদের হজমের ক্ষমতা কমে যায়। এ কারণে ‘উইনিং’ ঠিকমতো হওয়া জরুরী। ছ’মাসে প্রথম সেমি সলিড ডাযেট শুরু করা যায়। হজম হলে তারপর আবার আর একটা সেমি সলিড খাবার শুরু করলাম্ এইভাবে নতুন খাবার শুরু করবেন। একসঙ্গে সব খাবার শুরু করবেন না। ছ’মাস থেকে দু’বছর পর্যন্ত যেন উইনিংটা ঠিকমতো হয়। দু’বছর পর থেকে প্রপার ডায়েট মেনটেন করতে হবে।
অনেক মা-ভাই ভাবেন যে বেশি খেলেই বোধহয় ভাল। বেশি খাওয়া নয়। ব্যালেন্সড ডায়েটটা জরুরী।
বাচ্চাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব বোঝান। খাওয়ার আগে হাত ভাল করে সাবান দিয়ে ধোয়া, নোংরা হাত মুখে না দেয়া, বাইরে থেকে খেলে এসে হাত-পা ধুয়ে নেয়া ইত্যাদি ছোট থেকেই শেখানোর চেষ্টা করুন।
কৃমি থাকুক বা না থাকুক বাচ্চাদের তিন মাস অন্তর ডিওয়র্মিং করা জরুরী।

চিকিৎসা
বাচ্চার স্বাভাবিক হজম ক্ষমতা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু অনেক সময় ওষুধ দিতেই হয়। যথাযথ ওষুধের কোর্স করতে হয়। তারপর এ্যাসিড সিক্রেশন কমে যায়। ঠিক সময়ে ওষুধ না খাওয়ানো হলে গ্যাসট্রাইটিস বা গ্যাসট্রিক আলসার ডেভলপ করে যেতে পারে। প্রোটিন, লিপিড, কার্বোহাইড্রেট কোন দু’ধরনের খাবার হজম হচ্ছে না সেটা পরীক্ষা করে বোঝা যায়। অনেকের ল্যাকটোজ জাতীয় খাবার সহ্য হয় না।

খাওয়া-দাওয়া
বাচ্চার স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার সু-অভ্যাস গড়ে তুলুন। আপনারা সবাই যদি হেলদি খাবার খান, তাহলেও এই সব খাবার খেতে উৎসাহ পাবে। বাইরের খাবার যত কম খাওয়া যায় ততই ভাল। বিশেষ করে জাঙ্ক ফুড বেশি খেতে দেবেন না। মাঝে মধ্যে একটু আধটু খাওয়া যেতে পারে, তবে তা যদি রোজকার বায়না হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে বাচ্চার ভালর জন্যেই আপনাকে একটু কড়া হতে হবে।
বাচ্চা যাতে বেশিক্ষণ খালি পেটে না থাকে খেয়াল রাখুন।
প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট সব ধরনের খাবারই বাচ্চাদের ডায়েটে রাখার চেষ্টা করুন। কম ঝাল ও তেলমসলা দেয়া খাবার খাওয়ান।
শুধু দুধ বা হেলথ ড্রিঙ্ক দিয়ে সব চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। শুধু দুধ খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দেবেন না।
রোজ রোজ বাচ্চাকে জাঙ্কফুড ও বাইরের খাবার খাওয়ানো অভ্যাস করাবেন না। এতে পেটে ঘনঘন ইনফেকশন হতে পারে।
বাচ্চা যাতে খালি পেটে না থাকে, তার দিকে খেয়াল রাখুন। অনেক সময় তাড়াহুড়ায় বাচ্চারা স্কুল যাওয়ার আগে এক কাপ দুধ খেয়ে চলে যায়। এটা কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়। ভাল করে ব্রেকফাস্ট করা খুবই জরুরী। কারণ বেশিরভাগ বাচ্চাই স্কুলে টিফিন খায় না। ফলে পেটে এ্যাসিড সিক্রিশন হতে পারে। তবে তার মানে এই নয় যে বাচ্চাকে একগাদা খাওয়াবেন। দিনে বার বার অল্প অল্প করে খাওয়ার অভ্যেস গড়ে তুলুন।
বাচ্চাদের খাবারে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট যেন যথাযথ পরিমাণে থাকে।
সবজি, ফল যথেষ্ট পরিমাণে রাখুন। সারাদিনে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি খাওয়ান।
একবছরের পর থেকে বাড়ির সবাই যা খায়, সেটাই বাচ্চাকে খাওয়াতে পারেন। খুব বেশি ঝাল না দিয়ে হালকা রান্না করুন। ভাল করে চিবিয়ে খেতে বলুন। সবার সঙ্গে খাওয়ার হ্যাবিট গড়ে তুলুন। দেখবেন বাড়ির খাবার খেতে খুব একটা বেশি ঝামেলা করবে না।

No comments

Powered by Blogger.