তারকা নয়, অভিনেতা হতে চাওয়া একজন
আকাশের দিকে তাকিয়েই মনটা খারাপ হয়ে গেল। কালো মেঘে ঢেকে আছে শরতের আকাশ। অন্ধকার হয়ে এসেছে চারদিক। অথচ ঘণ্টা দুয়েক আগেও সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় চকচক করছিল পুরো ঢাকা শহর। শরতের এই এক সমস্যা ভাবভঙ্গি ঠিক বুঝে ওঠা দুষ্কর। জ্বলজ্বলে রোদেলা দিনের শুরু মানেই একইভাবে যে শেষ হবে তার কোন কারণ নেই।
সে কারণ না থাকলেও সূর্যের অনুপস্থিতিতে এত ঘটা করে মন বেজারের কারণ অবশ্য আছে। স্বল্প আলোয় ফটোগ্রাফারের ক্যামেরা ভাল আউটপুট দিতে পারবে না এটাই মূল ব্যাপার। উত্তরার ১৩নং সেক্টরের একটি বাড়িতে শূটিং চলছে ‘নিজগ্রহে পরবাসী’ নাটকের। জিনাত হাকিমের রচনায় ১০৪ পর্বের এ ধারাবাহিকটি পরিচালনা করছেন আজিজুল হাকিম। এখানেই দেখা হওয়ার কথা নাটকটির অন্যতম অভিনেতা আরমান পারভেজ মুরাদের সঙ্গে। ক’দিন ধরেই কথা হচ্ছিল ফোনে। দুই ঘণ্টার ঝক্কি ঝামেলাময় ছোটখাটো ভ্রমণ শেষে গোটা টিমসহ আমরা সরাসরি স্পটে। হাসি হাসি মুখ করে স্বাগত জানাতে এগিয়ে এলেন মুরাদ নিজেই। তার হাতে কাঁটাচামচ দেখে বুঝে নিতে বাকি থাকল না লাঞ্চব্রেক চলছে। ছোট একটা শর্ট সেরে আড্ডা দিতে বসলেন আমাদের সঙ্গে। প্রথমেই উঠে আসে ধারাবাহিকটির প্রসঙ্গ। বাংলাভিশনের জন্য নির্মিত এ নাটকটিতে মুরাদ পরিবারের মেঝো ছেলে। আগে পরে আরও দুই ভাই থাকলেও তার বরাবরই অকম্মা টাইপের। কিন্তু কর্তৃত্ব খাটানোর বেলায় ষোলোআনা। ব্যয়ভার থেকে শুরু করে পরিবারের অনেক ঝামেলাই খুব দক্ষতা আর ধৈর্যের সঙ্গে সামলান মুরাদ আর তার স্ত্রী। একটি একান্নবর্তী পরিবারের সুখ-দুঃখ আর টানাপড়েন নিয়ে কাহিনী নিজস্ব গতি পেয়েছে ‘নিজগ্রহে পরবাসী’ নাটকে। এখানে মুরাদের স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করছেন অপর্ণা। তবে মুরাদের জন্য এ নাটকটির গুরুত্ব অন্যদের তুলনায় একটু বেশি, বিশেষ করে যখন একটা দুটো করে অভিনয়ে ফিরতে শুরু করছেন। অনেকদিন ধরেই মুরাদের সঙ্গে মিডিয়ার কোন সম্পর্ক ছিল না, এক রকম আড়ালে আড়ালেই কাটিয়ে দিয়েছেন প্রায় দুই বছর। এ সময়টা ব্যক্তিগত ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে এতটা সময় নিভৃতে কাটানোর কারণ কি? মুরাদ জানালেন, “একটানা অভিনয় করে যাওয়া আসলে সম্ভব না। একজন অভিনেতা হিসেবে একেকটা চরিত্রায়ন করতে গেলে কিছুটা বিরতি দিয়ে ভেবে ভেবে কাজ করা উচিত। আর যেহেতু আমরা বিভিন্ন চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করি; যতই ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সঙ্গে, পেশার সাথে পরিচয় ঘটে, ততই সমৃদ্ধ হয় অভিজ্ঞতার ঝুলি। যে অভিজ্ঞতাগুলো অভিনয়ের জন্য খুবই দরকার।” বোঝাই যাচ্ছে, ভাল অভিনয়ের প্রয়োজনে ক্যামেরা থেকে কিছু সময় দূরে থাকার পক্ষে তিনি। চরিত্রকে বিশ্বাস করে তার জন্য প্রস্তুত হতে চান আগ থেকেই। যতই দূরে যাওয়া হয়, ততই নাকি ভালবাসা বাড়ে। মুরাদের বেলায় এ ব্যাপারটি একেবারেই মিলে যায়। দীর্ঘদিন পর অভিনয়ে এসে তিনি তারাশঙ্করের ‘বেদেনী’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত একটা নাটকে একই সঙ্গে তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। শুনেই আঁচ করা যাচ্ছে, সত্যিই অনেক কঠিন একটা কাজ। একই সেটে বসে ভিন্ন ভিন্ন তিনটি চরিত্র নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোন শিল্পীর পক্ষে সম্ভবই না। একটু সময় নিয়ে ভেবে ভেবে না করলে এ রকম ভাল অভিনয় উপহার দেয়া অনেক কঠিন। তাই মুরাদ বরাবরই চরিত্রের গভীরে ডুবে যেতে চান, নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ঢেলে দিয়ে অভিনয় করতে চান আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। ফল হিসেবে, আলাদা এক শ্রেণীর দর্শক তৈরি হয়েছে তার, যারা টেলিভিশনের পর্দায় শুধু মুরাদকেই খুঁজে ফেরে। যাচ্ছে তাই কাহিনী আর সংলাপ দিয়ে ‘ফালতু’ অভিনয় তাই তাকে মানায় না। ভক্তরা তাকে দেখতে চান, শুধুমাত্র অর্থের মোহে ছুটে সস্তামানের অভিনয় দিয়ে তাদের নিরাশ করতে চান না তিনিও। কিন্তু মুরাদ যেটির বিপক্ষে, সেটি আমাদের বর্তমান মিডিয়ার একটা অতি সাধারণ চিত্র। অগনিত চ্যানেলের ভিড়ে একই মুখ বার বার দেখতে দেখতে দর্শক-বিরক্তিটা সর্বোচ্চ পর্যায়ে। তাও যদি অভিনয়ের ব্যতিক্রম থাকে, সেটা অন্য কথা। একই রকম চরিত্র আর ‘হাস্যকর’ অভিনয়ের জন্য সব মিলিয়ে কিছু আর্টিস্টের নাটক দেখা মোটামুটি নির্যাতনের পর্যায়ে চলে গেছে। এতকিছুর ভিড়ে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মুরাদ নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছেন। শিল্পকে ব্যবসার পর্যায়ে নিয়ে যাননি কখনো। কারণ খুব বেশি উচ্চাশা তার নেই। নিজের চাওয়াকে সাধ্যের ভেতরে সীমাবদ্ধ রাখতেই সবটুকু তৃপ্তি পান তিনি।
ঘুরে ফিরে আলাপচারিতা চলে যায় চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে। ক্যারিয়ারে সংখ্যার বিচারে মুরাদের অভিনীত চলচ্চিত্র মাত্র পাঁচটি। কিন্তু প্রতিটিই দারুণ দর্শকনন্দিত। দেশের প্রথম ডিজিটাল চলচ্চিত্র ‘প্রিয়তমেষু’র সাফল্যের প্রাপ্তিটা অনেকাংশেই তার। সর্বশেষ ছবি ‘আমার বন্ধু রাশেদ’এ তিনি মুক্তিযোদ্ধা। এই চরিত্রে তার দুর্দান্তভাবে মিশে যাওয়া দর্শকের মনে দাগ কেটে আছে এখনও। গরু খাটিয়ে শস্য থেকে তেল বের করে আনা ‘ঘানি’ সম্প্রদায়ের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে আছেন তিনি। ব্যতিক্রমী কাহিনীর এ ছবিটিতে তার জনপ্রিয়তার প্রমাণ সে বছরের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সবমিলিয়ে সাফল্যে জ্বলজ্বল করছে সিনেমার ক্যারিয়ার। তবে এ ক্ষেত্রটি নিয়ে মুরাদের আফসোসও কম নয়। সিনেমার জন্য নিজেকে যেভাবে প্রস্তুত করেছিলেন, শুধুমাত্র সুযোগের অভাবে তার সবটুকু ঢেলে দিতে পারেননি ক্যামেরার সামনে। চলচ্চিত্রে নেগেটিভ চরিত্রে তার অনেকখানি আগ্রহ থাকলেও, পরিচালক-প্রযোজকদের আগ্রহের অভাবে পছন্দের চরিত্র নিয়ে ক্যামেরায় চিত্রায়িত হওয়া হয়নি। ভালই তো ছিল। শান্তশিষ্ট, সহজ-সরল নায়ক। কিন্তু তা ছেড়ে নেতিবাচক চরিত্রে আগ্রহের কারণ কি? মুরাদ বললেন, “এ ধরনের চরিত্রে অনেক ভেরিয়েশন থাকে, হিরোদের মধ্যে যেটা থাকে না। আমি হিরোইজমের বাইরের একজন মানুষ। চলচ্চিত্রের এন্টি-ক্যারেক্টার আমার পছন্দের একটা বিষয়।” অনেকেই হয়ত জানেন না, ভালো নাচও পারেন মুরাদ। রাজশাহী শহরে একসময় ব্রেক ড্যান্সের জন্য ভাল নামডাক ছিল তার। এখনও দেশের বাইরে যে কোন পার্টিতে নাচ দিয়ে বাহবা কুড়ান। মুখে একরাশ হাসি ঝুলিয়ে মুরাদ শোনালেন, শুধু এটা নয়, সিনেমার জন্য সব রকম প্রস্তুতিই নিয়ে নিয়েছেন তিনি। সে রকম সুযোগ পেলে অবশ্যই বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য কিছু করে দেখাবেন। তিনি বিশ্বাস করেন, যে কোন কাজের পেছনে পঁচানব্বই ভাগ হচ্ছে সুযোগ, আড়াই ভাগ কোয়ালিটি আর বাকি আড়াই ভাগ সম্পূর্ণ ভাগ্যের ব্যাপার। সে সুযোগটির আসলেই বড় অভাব।
মুরাদের দরাজ গলার ছন্দময় কথাগুলো শুনতে শুনতে কখন যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে টেরই পাইনি। এরমধ্যে একপশলা বৃষ্টিও হয়ে গেছে। গাছের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা চুইয়ে পড়ছে, অদ্ভুত এক শব্দের কারুকাজ, আর সামনে মুরাদের আবৃত্তির মতো ছান্দসিক কথার ফুলঝুরি। এভাবে আরও কিছুক্ষণ চালানো গেলে মন্দ হতো না। কিন্তু আলো চলে যাচ্ছে, আর কিছু সময় চলে গেলে ছবি ভাল আসবে না। ছাদে উঠে বিভিন্ন পোজের অনেক ছবি তোলার পর আবার শুরু হলো আলাপচারিতা।
মুরাদের ক্যারিয়ারের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে দেশের অন্য মিডিয়াকর্মীদের থেকে তার পার্থক্য অনেক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবৃত্তি নিয়ে মেতে থাকা এ তরুণটির জীবনের প্রথম দু’দশকও বেশি সময় কেটেছে রাজশাহীর শান্ত-শীতল পরিবেশে। প্রাণরসায়ন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকা এসেছিলেন শুধুমাত্র অভিনয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে। সালটা ১৯৯৮। থিয়েটারে অভিনয় করছেন আর খুব সকালে উঠে রেডিওতে দৌড়াচ্ছেন ‘মহানগর’ অনুষ্ঠানটি করতে। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মাঝখানে তখনও অনেকখানি ব্যবধান। ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিনিয়তই দেখা দিচ্ছে বড় বড় চ্যালেঞ্জ। ঢাকার সেই প্রথম দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে চান মুরাদ এভাবেই, “ঢাকায় এসে প্রত্যেকটা রাস্তা-ঘাট আমাকে চিনতে হয়েছে। কারণ আমি ঢাকার কিছুই জানতাম না এবং ঢাকা আমার কাছে একটা সাগরের মতো মনে হতো।” কিন্তু থিয়েটারের সুবাদে খুব তাড়াতাড়িই ফিট হয়ে যান তিনি। সে হিসেবে থিয়েটারই ঢাকাতে তার প্রথম পরিবার। এখান থেকে পরবর্তীতে একুশে টেলিভিশনে। সে সময় ইটিভির প্রায় ৮০ ভাগ ভয়েসই ছিল আরমান পারভেজ মুরাদের। ভয়েস দিয়েছেন অনেক বিজ্ঞাপনেও। তার ‘ পেপসোডেন্ট জার্মি চেক, মাত্র পাঁচ টাকা’ টিভিসিটিতে তার কণ্ঠ আজও অনেকের কানে বিঁধে আছে। শুরুটা ছিল এভাবেই। একপর্যায়ে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করেছেন প্রায় ছয় বছর। সেখানকার অভিজ্ঞতাগুলো আরও চমৎকার। এরপর থেকে অল্প অল্প করে ক্যামেরার সামনে আসতে শুরু করেন তিনি। মুরাদের আজকের অবস্থানে আসার পথটা কোনকালেই মসৃণ ছিল না। বড় রুক্ষ্ম আর টিলাময় সে পথ। তবে তিনি সব চ্যালেঞ্জ সর্বশক্তি দিয়ে মোকাবেলা করে মিডিয়াতে নিজস্ব ইমেজ ধরে রেখেছেন আজও। এভাবেই দর্শকনন্দিত হয়ে আরও অনেকদিন টিকে থাকতে চান আরমান পারভেজ মুরাদ।
ঘুরে ফিরে আলাপচারিতা চলে যায় চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে। ক্যারিয়ারে সংখ্যার বিচারে মুরাদের অভিনীত চলচ্চিত্র মাত্র পাঁচটি। কিন্তু প্রতিটিই দারুণ দর্শকনন্দিত। দেশের প্রথম ডিজিটাল চলচ্চিত্র ‘প্রিয়তমেষু’র সাফল্যের প্রাপ্তিটা অনেকাংশেই তার। সর্বশেষ ছবি ‘আমার বন্ধু রাশেদ’এ তিনি মুক্তিযোদ্ধা। এই চরিত্রে তার দুর্দান্তভাবে মিশে যাওয়া দর্শকের মনে দাগ কেটে আছে এখনও। গরু খাটিয়ে শস্য থেকে তেল বের করে আনা ‘ঘানি’ সম্প্রদায়ের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে আছেন তিনি। ব্যতিক্রমী কাহিনীর এ ছবিটিতে তার জনপ্রিয়তার প্রমাণ সে বছরের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সবমিলিয়ে সাফল্যে জ্বলজ্বল করছে সিনেমার ক্যারিয়ার। তবে এ ক্ষেত্রটি নিয়ে মুরাদের আফসোসও কম নয়। সিনেমার জন্য নিজেকে যেভাবে প্রস্তুত করেছিলেন, শুধুমাত্র সুযোগের অভাবে তার সবটুকু ঢেলে দিতে পারেননি ক্যামেরার সামনে। চলচ্চিত্রে নেগেটিভ চরিত্রে তার অনেকখানি আগ্রহ থাকলেও, পরিচালক-প্রযোজকদের আগ্রহের অভাবে পছন্দের চরিত্র নিয়ে ক্যামেরায় চিত্রায়িত হওয়া হয়নি। ভালই তো ছিল। শান্তশিষ্ট, সহজ-সরল নায়ক। কিন্তু তা ছেড়ে নেতিবাচক চরিত্রে আগ্রহের কারণ কি? মুরাদ বললেন, “এ ধরনের চরিত্রে অনেক ভেরিয়েশন থাকে, হিরোদের মধ্যে যেটা থাকে না। আমি হিরোইজমের বাইরের একজন মানুষ। চলচ্চিত্রের এন্টি-ক্যারেক্টার আমার পছন্দের একটা বিষয়।” অনেকেই হয়ত জানেন না, ভালো নাচও পারেন মুরাদ। রাজশাহী শহরে একসময় ব্রেক ড্যান্সের জন্য ভাল নামডাক ছিল তার। এখনও দেশের বাইরে যে কোন পার্টিতে নাচ দিয়ে বাহবা কুড়ান। মুখে একরাশ হাসি ঝুলিয়ে মুরাদ শোনালেন, শুধু এটা নয়, সিনেমার জন্য সব রকম প্রস্তুতিই নিয়ে নিয়েছেন তিনি। সে রকম সুযোগ পেলে অবশ্যই বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য কিছু করে দেখাবেন। তিনি বিশ্বাস করেন, যে কোন কাজের পেছনে পঁচানব্বই ভাগ হচ্ছে সুযোগ, আড়াই ভাগ কোয়ালিটি আর বাকি আড়াই ভাগ সম্পূর্ণ ভাগ্যের ব্যাপার। সে সুযোগটির আসলেই বড় অভাব।
মুরাদের দরাজ গলার ছন্দময় কথাগুলো শুনতে শুনতে কখন যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে টেরই পাইনি। এরমধ্যে একপশলা বৃষ্টিও হয়ে গেছে। গাছের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা চুইয়ে পড়ছে, অদ্ভুত এক শব্দের কারুকাজ, আর সামনে মুরাদের আবৃত্তির মতো ছান্দসিক কথার ফুলঝুরি। এভাবে আরও কিছুক্ষণ চালানো গেলে মন্দ হতো না। কিন্তু আলো চলে যাচ্ছে, আর কিছু সময় চলে গেলে ছবি ভাল আসবে না। ছাদে উঠে বিভিন্ন পোজের অনেক ছবি তোলার পর আবার শুরু হলো আলাপচারিতা।
মুরাদের ক্যারিয়ারের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে দেশের অন্য মিডিয়াকর্মীদের থেকে তার পার্থক্য অনেক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবৃত্তি নিয়ে মেতে থাকা এ তরুণটির জীবনের প্রথম দু’দশকও বেশি সময় কেটেছে রাজশাহীর শান্ত-শীতল পরিবেশে। প্রাণরসায়ন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকা এসেছিলেন শুধুমাত্র অভিনয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে। সালটা ১৯৯৮। থিয়েটারে অভিনয় করছেন আর খুব সকালে উঠে রেডিওতে দৌড়াচ্ছেন ‘মহানগর’ অনুষ্ঠানটি করতে। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মাঝখানে তখনও অনেকখানি ব্যবধান। ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিনিয়তই দেখা দিচ্ছে বড় বড় চ্যালেঞ্জ। ঢাকার সেই প্রথম দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে চান মুরাদ এভাবেই, “ঢাকায় এসে প্রত্যেকটা রাস্তা-ঘাট আমাকে চিনতে হয়েছে। কারণ আমি ঢাকার কিছুই জানতাম না এবং ঢাকা আমার কাছে একটা সাগরের মতো মনে হতো।” কিন্তু থিয়েটারের সুবাদে খুব তাড়াতাড়িই ফিট হয়ে যান তিনি। সে হিসেবে থিয়েটারই ঢাকাতে তার প্রথম পরিবার। এখান থেকে পরবর্তীতে একুশে টেলিভিশনে। সে সময় ইটিভির প্রায় ৮০ ভাগ ভয়েসই ছিল আরমান পারভেজ মুরাদের। ভয়েস দিয়েছেন অনেক বিজ্ঞাপনেও। তার ‘ পেপসোডেন্ট জার্মি চেক, মাত্র পাঁচ টাকা’ টিভিসিটিতে তার কণ্ঠ আজও অনেকের কানে বিঁধে আছে। শুরুটা ছিল এভাবেই। একপর্যায়ে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করেছেন প্রায় ছয় বছর। সেখানকার অভিজ্ঞতাগুলো আরও চমৎকার। এরপর থেকে অল্প অল্প করে ক্যামেরার সামনে আসতে শুরু করেন তিনি। মুরাদের আজকের অবস্থানে আসার পথটা কোনকালেই মসৃণ ছিল না। বড় রুক্ষ্ম আর টিলাময় সে পথ। তবে তিনি সব চ্যালেঞ্জ সর্বশক্তি দিয়ে মোকাবেলা করে মিডিয়াতে নিজস্ব ইমেজ ধরে রেখেছেন আজও। এভাবেই দর্শকনন্দিত হয়ে আরও অনেকদিন টিকে থাকতে চান আরমান পারভেজ মুরাদ।
No comments