স্মরণ- বাউলসম্রাটের স্মৃতি by সুমনকুমার দাশ
মনে পড়ে সেই দিনের কথা। মাত্রই তো তিন বছর আগের ঘটনা। এখনো কত সজীব আর প্রাণবন্ত সেই স্মৃতি। আমরা ভেসে চলছিলাম শেষ বর্ষার যৌবন হারানো বরাম হাওর পাড়ি দিয়ে। কাঠফাটা রোদ আমাদের চোখ ধাঁধাচ্ছিল। কিছু গাঙচিল, সারস, চড়ুই আর কাক উড়ছিল আমাদের মাথার ওপর।
বরাম হাওরের স্বচ্ছ জলে ভাসমান সবুজ জলজ উদ্ভিদগুলো সামান্য বাতাসে দুলছিল। তারও দূরে হিজল-করচ গাছগুলো যেন আমাদের প্রতীক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে!
সেই রকমই এক দিনে আমরা গোটা ত্রিশেক মানুষ ‘ময়ূরপঙ্খি’ নৌকার ছইয়ের ওপরে বসে নীরবে চোখের পানি ফেলছিলাম। আমাদের সামনে-পেছনে শত শত নৌকাভর্তি মানুষ। সবার দৃষ্টি আমাদের নৌকার দিকে। ততক্ষণে বাউল রণেশ ঠাকুর করুণ গলায় গান ধরেন, ‘কেন পিরিতি বাড়াইলায় রে বন্ধু/ ছেড়ে যাইবায় যদি’। রণেশের দরদি গলার গান শুনে নৌকাভর্তি মানুষের চোখ ছলছল। এবার গানে টান দেন বাউল আবদুর রহমান: ‘আমার বুকে আগুন বন্ধু/ তোমার বুকে পানি/ দুই দেশে দুইজনার বাস/ কে নিবায় আগুনি রে/ আর আমার দরদি নাই রে’।
দুই বাউলের কান্নাজড়িত খালি গলার গান হাওরের তপ্ত বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এত এত নৌকা, এত এত মানুষ, বরামের হাওরে এত এত জল। কিন্তু কোনো মানুষের মুখে শব্দ নেই, বরাম হাওরের পানিতে নেই কোনো আফালের গর্জন। এ এক অন্য রকম দৃশ্য। ধীরে ধীরে দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামে। হাওরের পানিতে ভাটার টান পড়তি রোদের আলোয় আরও যেন স্পষ্ট হয়। একসময় উজানধল গ্রামে আমাদের নৌকা থামে। আগে থেকেই সেখানে অবস্থানরত হাজারো মানুষ এবার ঝাপটে পড়ে আমাদের নৌকায়। কারণ, এ নৌকার ছইয়েই যে ‘আতর-গোলাপ ছোঁয়া চন্দন’ গায়ে মেখে চুপচাপ শুয়ে রয়েছেন প্রিয় বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম।
বাউলসম্রাটের প্রিয় গ্রামবাসী আবেগ আর ভালোবাসায় চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কফিন ধরাধরি করে কাঁধে তোলে। এরপর তারা আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে বহন করে চলে প্রয়াত বাউলের মরদেহ। সে মুহূর্তের দৃশ্যটি এখনো স্পষ্ট চোখে ভাসে। সেদিন ছিল ২০০৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। এর আগের দিন সকাল সাতটা ৫৮ মিনিটে সিলেটের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সবার প্রিয় ‘করিম ভাই’।
বাউলসম্রাটকে মৃত্যুর পরদিন সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামের নিজ বাড়িতে সহধর্মিণী সরলার কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। এর পর থেকে অসংখ্য মানুষের সুখস্মৃতি হয়ে তিন বছর ধরে বাউলসম্রাট ‘মাটির বিছানায়’ শুয়ে রয়েছেন।
বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটে শাহ আবদুল করিম গানে গানে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছেন। ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধীদের বিচারের দাবিতে ছিলেন অগ্রগণ্য সৈনিক। গান ও কথায় বাঙালি জাতিকে মুক্তির পথ দেখানোর চেষ্টা করেছেন আজীবন দেশব্রতী প্রগতিশীল এই বাউলসাধক। ফলে মৃত্যুর আগেই পেয়েছেন কিংবদন্তির মর্যাদা। বাংলা লোকগানের এই অগ্রগণ্য সাধক অসম্ভব জনপ্রিয় ও তত্ত্ববহুল বাউলগানের পাশাপাশি রচনা করেছেন অজস্র গণসংগীত। এসব গণসংগীত ইতিমধ্যে ‘সর্বহারার দুঃখজয়ের মন্ত্র’ বলে সারস্বত সমাজ কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে।
শাহ আবদুল করিম সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে কবিয়াল রমেশ শীলের সঙ্গে গণসংগীত পরিবেশন করেছেন। মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। ২০০১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার লোকসংগীতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ‘একুশে পদক’ প্রদান করে। বাউলসম্রাট পরে ২০০৪ সালে মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননাও পেয়েছিলেন। এ ছাড়া আড়াই শতাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা তিনি পেয়েছিলেন। পুরস্কার পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তিনি সব সময় একটি কথাই বলতেন, ‘মানুষের ভালোবাসাই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। জীবনে চলতে-ফিরতে অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পেয়ে আমি মুগ্ধ। এর চেয়ে বেশি কিছু আমার চাওয়া-পাওয়া নেই।’
গতকাল ১২ সেপ্টেম্বর বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে ঢাকা, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বাউলের গ্রামের বাড়িতে পালিত হয়েছে নানা কর্মসূচি। হাজারো মানুষ এসব কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছে। শত শত নৌকায় করে হাজারো ভক্ত-অনুরাগী বাউলের গ্রামের বাড়িতে গতকাল বুধবার সকাল থেকেই ভিড় জমাতে শুরু করে। তারা প্রথমেই বাউলসম্রাটের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। একসময় ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় বাউলসম্রাটের ‘মাটির ঘর’। এরপর আগত ভক্তরা নিজেদের মতো করে গানে-আলোচনায় করিম-বন্দনায় মেতে ওঠেন। হাওরের বন্ধনহীন মুক্ত আকাশে ছড়িয়ে পড়ে বাউলসম্রাটের প্রচলিত-অপ্রচলিত সব গানের বাণী।
কোনো দাওয়াত আর আমন্ত্রণ ছাড়া প্রাণের টানেই তাই ছুটে আসছে দূর গাঁয়ের মানুষ। বাউলসম্রাটের লেখা দুটি পঙিক্ত উল্লেখ করে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা প্রকাশ করছি ঠিক এভাবেই: ‘মানুষ যদি হইতে চাও করো মানুষের ভজনা/ সবার উপরে মানুষ সৃষ্টিতে নাই যার তুলনা’।
সুমনকুমার দাশ
সিলেট প্রতিনিধি
সেই রকমই এক দিনে আমরা গোটা ত্রিশেক মানুষ ‘ময়ূরপঙ্খি’ নৌকার ছইয়ের ওপরে বসে নীরবে চোখের পানি ফেলছিলাম। আমাদের সামনে-পেছনে শত শত নৌকাভর্তি মানুষ। সবার দৃষ্টি আমাদের নৌকার দিকে। ততক্ষণে বাউল রণেশ ঠাকুর করুণ গলায় গান ধরেন, ‘কেন পিরিতি বাড়াইলায় রে বন্ধু/ ছেড়ে যাইবায় যদি’। রণেশের দরদি গলার গান শুনে নৌকাভর্তি মানুষের চোখ ছলছল। এবার গানে টান দেন বাউল আবদুর রহমান: ‘আমার বুকে আগুন বন্ধু/ তোমার বুকে পানি/ দুই দেশে দুইজনার বাস/ কে নিবায় আগুনি রে/ আর আমার দরদি নাই রে’।
দুই বাউলের কান্নাজড়িত খালি গলার গান হাওরের তপ্ত বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এত এত নৌকা, এত এত মানুষ, বরামের হাওরে এত এত জল। কিন্তু কোনো মানুষের মুখে শব্দ নেই, বরাম হাওরের পানিতে নেই কোনো আফালের গর্জন। এ এক অন্য রকম দৃশ্য। ধীরে ধীরে দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামে। হাওরের পানিতে ভাটার টান পড়তি রোদের আলোয় আরও যেন স্পষ্ট হয়। একসময় উজানধল গ্রামে আমাদের নৌকা থামে। আগে থেকেই সেখানে অবস্থানরত হাজারো মানুষ এবার ঝাপটে পড়ে আমাদের নৌকায়। কারণ, এ নৌকার ছইয়েই যে ‘আতর-গোলাপ ছোঁয়া চন্দন’ গায়ে মেখে চুপচাপ শুয়ে রয়েছেন প্রিয় বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম।
বাউলসম্রাটের প্রিয় গ্রামবাসী আবেগ আর ভালোবাসায় চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কফিন ধরাধরি করে কাঁধে তোলে। এরপর তারা আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে বহন করে চলে প্রয়াত বাউলের মরদেহ। সে মুহূর্তের দৃশ্যটি এখনো স্পষ্ট চোখে ভাসে। সেদিন ছিল ২০০৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। এর আগের দিন সকাল সাতটা ৫৮ মিনিটে সিলেটের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সবার প্রিয় ‘করিম ভাই’।
বাউলসম্রাটকে মৃত্যুর পরদিন সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামের নিজ বাড়িতে সহধর্মিণী সরলার কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। এর পর থেকে অসংখ্য মানুষের সুখস্মৃতি হয়ে তিন বছর ধরে বাউলসম্রাট ‘মাটির বিছানায়’ শুয়ে রয়েছেন।
বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটে শাহ আবদুল করিম গানে গানে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছেন। ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধীদের বিচারের দাবিতে ছিলেন অগ্রগণ্য সৈনিক। গান ও কথায় বাঙালি জাতিকে মুক্তির পথ দেখানোর চেষ্টা করেছেন আজীবন দেশব্রতী প্রগতিশীল এই বাউলসাধক। ফলে মৃত্যুর আগেই পেয়েছেন কিংবদন্তির মর্যাদা। বাংলা লোকগানের এই অগ্রগণ্য সাধক অসম্ভব জনপ্রিয় ও তত্ত্ববহুল বাউলগানের পাশাপাশি রচনা করেছেন অজস্র গণসংগীত। এসব গণসংগীত ইতিমধ্যে ‘সর্বহারার দুঃখজয়ের মন্ত্র’ বলে সারস্বত সমাজ কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে।
শাহ আবদুল করিম সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে কবিয়াল রমেশ শীলের সঙ্গে গণসংগীত পরিবেশন করেছেন। মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। ২০০১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার লোকসংগীতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ‘একুশে পদক’ প্রদান করে। বাউলসম্রাট পরে ২০০৪ সালে মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননাও পেয়েছিলেন। এ ছাড়া আড়াই শতাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা তিনি পেয়েছিলেন। পুরস্কার পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তিনি সব সময় একটি কথাই বলতেন, ‘মানুষের ভালোবাসাই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। জীবনে চলতে-ফিরতে অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পেয়ে আমি মুগ্ধ। এর চেয়ে বেশি কিছু আমার চাওয়া-পাওয়া নেই।’
গতকাল ১২ সেপ্টেম্বর বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে ঢাকা, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বাউলের গ্রামের বাড়িতে পালিত হয়েছে নানা কর্মসূচি। হাজারো মানুষ এসব কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছে। শত শত নৌকায় করে হাজারো ভক্ত-অনুরাগী বাউলের গ্রামের বাড়িতে গতকাল বুধবার সকাল থেকেই ভিড় জমাতে শুরু করে। তারা প্রথমেই বাউলসম্রাটের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। একসময় ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় বাউলসম্রাটের ‘মাটির ঘর’। এরপর আগত ভক্তরা নিজেদের মতো করে গানে-আলোচনায় করিম-বন্দনায় মেতে ওঠেন। হাওরের বন্ধনহীন মুক্ত আকাশে ছড়িয়ে পড়ে বাউলসম্রাটের প্রচলিত-অপ্রচলিত সব গানের বাণী।
কোনো দাওয়াত আর আমন্ত্রণ ছাড়া প্রাণের টানেই তাই ছুটে আসছে দূর গাঁয়ের মানুষ। বাউলসম্রাটের লেখা দুটি পঙিক্ত উল্লেখ করে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা প্রকাশ করছি ঠিক এভাবেই: ‘মানুষ যদি হইতে চাও করো মানুষের ভজনা/ সবার উপরে মানুষ সৃষ্টিতে নাই যার তুলনা’।
সুমনকুমার দাশ
সিলেট প্রতিনিধি
No comments