হৃদয়নন্দন বনে-শেষ বরুণ গাছটি...! by আলী যাকের

ছবি তোলার কালে নওয়াজেশ ভাই প্রায়ই একটি কথা বলতেন, যা আমাকে আজও ভাবিত করে। তিনি বলতেন, 'প্রকৃতি একটি নির্দিষ্ট স্থানের পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য কিছু গাছপালার জন্ম দেয়। হিজল কিংবা কদম ওই ধরনেরই পরিবেশবান্ধব গাছ।


এ ছাড়াও নানা রকম বৃক্ষ আমাদের গ্রামবাংলায় দেখা যায়, যার কোনো বাণিজ্যিক মূল্য নেই বটে, কিন্তু পরিবেশ-অনুকূল বলে তাদের প্রয়োজন
অত্যন্ত বেশি



সম্প্রতি, এই সমকাল পত্রিকাতেই পেছনের পাতায় একটি প্রতিবেদন পড়লাম, যার শিরোনাম ছিল, 'ঢাকা শহরের শেষ বরুণ গাছটি'। পড়ে মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। মনে পড়ল বেশ কয়েক বছর আগে আমি একটি অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃৃক্ত ছিলাম, যার শিরোনাম ছিল, 'হিজল-বরুণ-কদম উৎসব'। এই তিনটি বৃক্ষই আমাদের অতি পরিচিত এবং সাধারণত জলনির্ভর হওয়ায় বর্ষায় পত্র-পুষ্পে পল্লবিত হয়ে ওঠে। আমরা এই তিনটি বৃক্ষকে বরণ করেছিলাম বর্ণময় একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত উদ্ভিদ উদ্যানে। সেখানে স্বনামধন্য নৃত্যশিল্পী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার দল পরিবেশন করেছিলেন আমার একটি অতিপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতনির্ভর সমবেত নৃত্য_ 'আয় আমাদের অঙ্গনে অতিথি বালক তরুদল/ মানবের স্নেহসঙ্গ নে, চল্্ আমাদের ঘরে চল্্'। রবীন্দ্রনাথ এই গানটি রচনা ও সুরারোপ করেছিলেন শান্তিনিকেতনে কোনো এক বৃক্ষ উৎসবে, যখন নিকেতনবাসী যুবক-যুবতীরা নেচে-গেয়ে নানা ধরনের বৃক্ষ নিয়ে গিয়েছিল পূর্ব পল্লীতে রোপণ করার জন্য।
নামটি আমাদের কাছে খুব পরিচিত নয় এবং অতি সম্প্রতি বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে এই নামটি আমরা জানতে পেরেছি। আমাদের গ্রামবাসী বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র এই বৃক্ষটিকে চেনেন 'বইন্যা' নামে। আমি এবং নওয়াজেশ ভাই অর্থাৎ ড. নওয়াজেশ আহমেদ যখন বাংলাদেশে বনফুলের ছবি তোলা নিয়ে মেতেছিলাম সেই এক যুগেরও আগে, তখন এই বইন্যা ফুলের ছবি তুলেছি। সাদা রঙের ফুল। একটি মৃদু সুগন্ধ আছে। দেখতে ভারি সুন্দর। বইন্যা ফলও আছে, দেখতে অনেকটা সবুজ বেলের মতো। কিন্তু মাকাল ফলের মতোই খাওয়া যায় না। আমাদের গ্রামদেশে দরিদ্র গৃহবধূরা বইন্যা ফুল ভাজা পরিবেশন করেন খাবারের সঙ্গে। আহার্য হিসেবে তা বেশ স্বাদু। সেই সময় আমি এই 'বইন্যা' শব্দটির সভ্য একটি সংস্করণ সম্বন্ধে অনেককে জিজ্ঞেস করেছিলাম। নওয়াজেশ ভাই বলতেন, 'আসলে বনফুল তো। তাই বোধ হয় গ্রামবাংলার লোকেরা বন্য না বলে ওদের নিজস্ব উপভাষায় বইন্যা বলে ডাকে।' বেচারা নওয়াজেশ ভাই! মরে যাওয়ার আগে জেনে যেতে পারলেন না এর পোশাকি নামটি।
যা হোক, সেই ছবি তোলার কালে নওয়াজেশ ভাই প্রায়ই একটি কথা বলতেন, যা আমাকে আজও ভাবিত করে। তিনি বলতেন, 'প্রকৃতি একটি নির্দিষ্ট স্থানের পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য কিছু গাছপালার জন্ম দেয়। হিজল কিংবা কদম ওই ধরনেরই পরিবেশবান্ধব গাছ। এ ছাড়াও নানা রকম বৃক্ষ আমাদের গ্রামবাংলায় দেখা যায়, যার কোনো বাণিজ্যিক মূল্য নেই বটে, কিন্তু পরিবেশ-অনুকূল বলে তাদের প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি। আমি দেখেছি আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে এই ধরনের একটি বৃক্ষ আছে, যা 'ম্যাড্ডা' বলে পরিচিত। এই গাছটি যত্রতত্র দেখা যায়। কাউকে জিজ্ঞেস করলে বলে, 'এগুলি জংলি গাছ।' ওই ম্যাড্ডা গাছেও ফুল-ফল হয়। কেউ তেমন লক্ষ্য করেও দেখে না। তবে নেহায়েত জ্বালানির প্রয়োজন না পড়লে ওই গাছ কেউ কেটেও ফেলে না। এই ধরনের হাজারো গাছের নাম বলা যেতে পারে। এর বেশিরভাগই ঝোপ-ঝাড় হিসেবে গ্রামবাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। যেমন আকন্দ, কিংবা ভাটফুল অথবা কুরচি। আমাদের শিক্ষিত নগরবাসীর অনুগ্রহে এই গাছগুলো সম্প্রতি কিছুটা সম্মান পেতে শুরু করেছে। তবে তা এখনও ওইভাবে মূল্যায়িত নয়, ঠিক যেভাবে আমদানি করা গাছ অথবা ঝোপ-ঝাড়কে আমরা সমাদর করে থাকি। এই ক'দিন আগেও তো ল্যান্টেনা অথবা হুরহুরে নিতান্তই বুনো গাছ ছিল বাংলাদেশে।
আমার মনে আছে, বছর বিশেক আগে আমাদের গ্রামের জমিতে আমার আত্মীয়রা একাশিয়া গাছ বপন করার জন্য আমার কাছে শাসিত হয়েছিল। তারপর আমি নানা ধরনের 'জংলি' গাছে আমার বাগানকে ভরে তুলি। সেই বুনো গাছের সংস্পর্শে এসে যেসব জমি প্রায় পতিত ছিল, সেখানেও নানা ধরনের উদ্ভিদ জন্ম নিতে শুরু করে। স্পষ্ট মনে আছে, ওই অঞ্চলের কৃষকরা ভাবত, জমিগুলো অনাবাদি। এখন সেখানে দিব্যি ধান-গমের চাষ হয়। এও প্রকৃতির এক ধরনের আচরণ, যা আমরা বোঝারও চেষ্টা করি না হয়তো। অতএব, যখনই দেখি যে, কোনো একটি গাছ আমাদের পরিচিত মূল্যবান গাছের মধ্যে না পড়ে, সেটিকে নিদ্বর্িধায় বিনাশ করি আমরা। এই রকম অবলীলায় নিসর্গ ধ্বংসের ইতিহাস আর কোথাও সহজে গোচরীভূত হয় কিনা জানি না। তবে আমাদের দেশে হয়।
ওই দিনের সেই প্রতিবেদন, 'ঢাকা শহরের শেষ বরুণ গাছটি' পড়তে পড়তে আমার মনটা আবার বিষণ্ন হয়ে গেল। যদিও আমি নিশ্চিত নই ওইটিই ঢাকা শহরের শেষ গাছ কি-না! আমার মনে হয়, ঢাকায় এখনও নিসর্গ হননে সিদ্ধহস্ত আমাদের গৃহায়ন প্রকল্পের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কিছু কিছু জলাভূমির আশপাশে হয়তো এ গাছ দেখা গেলেও যেতে পারে। আমাদের এখানে সম্প্রতি গণমাধ্যমের সহায়তায় পরিবেশ-বিনাশী নানা ধরনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এই আন্দোলনটিকে আরও অনেক বেশি নিবিড় এবং জঙ্গম করে তুলতে হবে। কেবল লোক দেখানো জনসমাগম এবং প্রেস রিলিজের মাধ্যমে সব কর্তব্য সারা হয়ে গেছে_ এই মনোবৃত্তি ত্যাগ করে এ বিষয়টি নিয়ে নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে। এ কারণে তথাকথিত প্রখ্যাত ব্যক্তিদের ওপরে নির্ভর না করে তরুণতর নিসর্গ-সখাদের নিয়ে এ কাজটি শুরু করতে হবে। না হলে ঢাকা শহরের পরিবেশকে রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
এই সেদিন অপরিকল্পিত নগরায়নের ওপর এক আলোচনা সভায় কথা উঠেছিল, আমাদের বহুতল ভবনগুলো এমনভাবে গজিয়ে উঠছে এই শহরে যে, তার ফাঁকফোকর গলে বৃষ্টির পানি মাটির ভেতরে প্রবেশ করতে পারছে না। যদিওবা সামান্য কিছু পানি সমতলে চলে আসে, সেই সকল জায়গা শানবাঁধানো হওয়ায় তা মাটির ওপরেই থেকে যায়। এটিও আমাদের এই শহরের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার পেছনে একটি প্রধান কারণ।
এই শহরকে বাঁচাতে হলে আমাদের জলাভূমিগুলো রক্ষা করতে হবে এবং আমাদের পরিবেশবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে_ এ কথা অনস্বীকার্য এবং তা করতে হবে আমাদেরই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাঁচার জন্য। এই কাজটি যত শিগগির শুরু হয়, ততই সবার জন্য মঙ্গল।

আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
 

No comments

Powered by Blogger.