রম্য-বলুন তো আমি কোন রাজাকার by রণজিৎ বিশ্বাস
টেলিভিশনের যে অনুষ্ঠানে আমি ধর্মার্দ্র মানুষের সওয়ালের জবাব দিতাম এবং তাদের জন্য দ্বীন-দুনিয়ার আলোর দিশা রাখতাম, সেখানেও আমি, উপস্থাপক সাহেবের মতো, ফটরফটর দু'এক বাক্য ইংরেজি বাতাসে ছেড়ে দিতাম
আমাকে অনেকে চেনে, কিন্তু আমার আসল রূপটি দীর্ঘদিন ধরে আমি ঢেকে রাখতে পেরেছিলাম। লেবাস দিয়ে তো বটেই, আরও অনেক কিছু দিয়ে।
আমাকে অনেকে চেনে, কিন্তু আমার আসল রূপটি দীর্ঘদিন ধরে আমি ঢেকে রাখতে পেরেছিলাম। লেবাস দিয়ে তো বটেই, আরও অনেক কিছু দিয়ে।
তার একটি হচ্ছে, আমি ধর্মীয় বিষয়ে জায়গায় জায়গায় লেকচার দিয়ে বেড়াতাম। টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে আমি মানুষের বিভিন্ন সওয়ালের জবাব দিতাম। ধর্ম বিষয়ক সওয়াল। মানুষ আমার প্রশংসা করত, মানুষ আমার বচনেবাচনে-ভাষণে মুগ্ধ হতো। ফোন করত, চিঠি লিখত, মেইল-মেসেজ পাঠাত।
আমি মনে মনে ধর্মকে ও আমার ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিতাম। ইশারায় ঊর্ধ্বলোকের দিকে হাত তুলে বলতাম_ দেশের মানুষ কত সরল! ধর্মের বিভিন্ন মাপের মাত্রার স্টাইলের ও তরিকার বটিকা তারা কী চমৎকার গেলে! যদি তারা জানত ১৯৭১ সালে ফরিদপুরে আমি কেমন সাহস ও নিষ্ঠার সঙ্গে উৎসাহ ও একাত্মতার সঙ্গে জোশজেল্লা ও জজবার সঙ্গে আমার প্রথম শ্বশুর ও পরে সমাজসেবা কাজের মিনিস্টার বনে যাওয়া লিডারের সঙ্গে কী করেছিলাম, কতটি বাড়ি লুট করেছিলাম, কতটি বাড়িতে মূলত হিন্দুবাড়িতে আগুন দিয়েছিলাম, কতজন হিন্দুর ধর্ম পাল্টে আমার নিজের ধর্মে নিয়ে এসেছিলাম, প্রাণের ভয়ে ও ধর্মের ভয়ে কাঁপা কতজন মালাউনের বাচ্চা মালাউনকে ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, কতটি গনিমতের মালকে নষ্ট করেছিলাম ও পাকিস্তানি মেজরদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম, পাকিস্তানি মালিকদের পায়ের চামড়া ও জুতার তলা আমার লিডারদের নিয়ে মনের আনন্দে চাটতে চাটতে কেমন সুন্দর রাজাকার বাহিনী গঠন করেছিলাম আর জোয়ান তাগড়া শরীর নিয়ে কেমন সুন্দর ও বিউটিফুল কমান্ডারি করেছিলাম_ তা যদি মানুষ সময়মতো জানত, আমার জারিজুরি সব বা'র করে হাড্ডি-অস্থি আলগা করে দিত। গণপিটুনিতে ডাকাত মারার চেয়েও নিষ্ঠুর লাঠ্যৌষধি তারা আমার মাংস ও ঢ্যাবঢ্যাবা পিঠের ওপর প্রয়োগ করত। এত যত্ন ও শ্রমনিবিড়তায় তারা এই প্রহরণকর্ম সম্পাদক করত বলে আমার বিশ্বাস, একটি কিলও মাটিতে পড়ত না, প্রহারদণ্ডের একটি সোহাগী স্পর্শও ব্যর্থ যেত না।
আমার খুব ইন্টারেস্টিং লাগে, দেশের একটি চমৎকার কলেজে যেখানে সামরিক আধিকারিকদের পাশাপাশি বিদেশিরাও অধ্যয়ন করে এবং খুব সম্মানের একটি ডিগ্রি পায়, সেখানেও আমি ডাক পেতাম লেকচার দেওয়ার জন্য! যারা আমার কথা শুনত, তাদের সামান্য অসুবিধা হয়তো হতো, কিন্তু আমি আমার ভ্রম-কণ্টকিত ইংরেজিতে ভালোই বলে আসতাম। আসলে আত্মবিশ্বাসই আসল কথা; যার আত্মবিশ্বাস নেই, তার কিছুই নেই। টেলিভিশনের যে অনুষ্ঠানে আমি ধর্মার্দ্র মানুষের সওয়ালের জবাব দিতাম এবং তাদের জন্য দ্বীন-দুনিয়ার আলোর দিশা রাখতাম, সেখানেও আমি, উপস্থাপক সাহেবের মতো, ফটরফটর দু'এক বাক্য ইংরেজি বাতাসে ছেড়ে দিতাম। এতে আমাকে নিয়ে এক লেভেলের মানুষের মুগ্ধতা বাড়ত; তারা চোখ বড় বড় করে ভাবত, এই লোক তো দেখি এইটি-সেইটি শুধু জানে না, ঐটিও জানে! যাই বলেন, এখনও এ দেশে ইংরেজির কদর আছে।
যুদ্ধাপরাধীর বিচার থেকে বাঁচার জন্য চোরের মতো যখন দিনাজপুরের হিলি বর্ডার দিয়ে আমার যোগ্য ও বাপকাবেটা পুত্র, শ্যালক ও তার চেয়েও বড় কুটুম ইউনিভার্সিটির এক টিচার_ আমাদের আদর্শের এক সৈনিক, এর সাহায্যে সবার চোখে ধুলো দিয়ে চোরের ছাওয়াল চোর ও 'তস্করস্য তস্কর'-এর মতো পালিয়ে আসি, তার আগে দেশে একটি সাংঘাতিক কাজ শুরু করে এসেছিলাম। সর্বধর্মের মিলন ও সম্প্রীতির এক সংগঠন। এবার আপনারা বলুন তো আমি কোন রাজাকার? পারতে হবে কিন্তু, নইলে আপনারা দেশ রক্ষা করতে পারবেন না।
রণজিৎ বিশ্বাস : কথাসাহিত্যিক
আমি মনে মনে ধর্মকে ও আমার ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিতাম। ইশারায় ঊর্ধ্বলোকের দিকে হাত তুলে বলতাম_ দেশের মানুষ কত সরল! ধর্মের বিভিন্ন মাপের মাত্রার স্টাইলের ও তরিকার বটিকা তারা কী চমৎকার গেলে! যদি তারা জানত ১৯৭১ সালে ফরিদপুরে আমি কেমন সাহস ও নিষ্ঠার সঙ্গে উৎসাহ ও একাত্মতার সঙ্গে জোশজেল্লা ও জজবার সঙ্গে আমার প্রথম শ্বশুর ও পরে সমাজসেবা কাজের মিনিস্টার বনে যাওয়া লিডারের সঙ্গে কী করেছিলাম, কতটি বাড়ি লুট করেছিলাম, কতটি বাড়িতে মূলত হিন্দুবাড়িতে আগুন দিয়েছিলাম, কতজন হিন্দুর ধর্ম পাল্টে আমার নিজের ধর্মে নিয়ে এসেছিলাম, প্রাণের ভয়ে ও ধর্মের ভয়ে কাঁপা কতজন মালাউনের বাচ্চা মালাউনকে ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, কতটি গনিমতের মালকে নষ্ট করেছিলাম ও পাকিস্তানি মেজরদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম, পাকিস্তানি মালিকদের পায়ের চামড়া ও জুতার তলা আমার লিডারদের নিয়ে মনের আনন্দে চাটতে চাটতে কেমন সুন্দর রাজাকার বাহিনী গঠন করেছিলাম আর জোয়ান তাগড়া শরীর নিয়ে কেমন সুন্দর ও বিউটিফুল কমান্ডারি করেছিলাম_ তা যদি মানুষ সময়মতো জানত, আমার জারিজুরি সব বা'র করে হাড্ডি-অস্থি আলগা করে দিত। গণপিটুনিতে ডাকাত মারার চেয়েও নিষ্ঠুর লাঠ্যৌষধি তারা আমার মাংস ও ঢ্যাবঢ্যাবা পিঠের ওপর প্রয়োগ করত। এত যত্ন ও শ্রমনিবিড়তায় তারা এই প্রহরণকর্ম সম্পাদক করত বলে আমার বিশ্বাস, একটি কিলও মাটিতে পড়ত না, প্রহারদণ্ডের একটি সোহাগী স্পর্শও ব্যর্থ যেত না।
আমার খুব ইন্টারেস্টিং লাগে, দেশের একটি চমৎকার কলেজে যেখানে সামরিক আধিকারিকদের পাশাপাশি বিদেশিরাও অধ্যয়ন করে এবং খুব সম্মানের একটি ডিগ্রি পায়, সেখানেও আমি ডাক পেতাম লেকচার দেওয়ার জন্য! যারা আমার কথা শুনত, তাদের সামান্য অসুবিধা হয়তো হতো, কিন্তু আমি আমার ভ্রম-কণ্টকিত ইংরেজিতে ভালোই বলে আসতাম। আসলে আত্মবিশ্বাসই আসল কথা; যার আত্মবিশ্বাস নেই, তার কিছুই নেই। টেলিভিশনের যে অনুষ্ঠানে আমি ধর্মার্দ্র মানুষের সওয়ালের জবাব দিতাম এবং তাদের জন্য দ্বীন-দুনিয়ার আলোর দিশা রাখতাম, সেখানেও আমি, উপস্থাপক সাহেবের মতো, ফটরফটর দু'এক বাক্য ইংরেজি বাতাসে ছেড়ে দিতাম। এতে আমাকে নিয়ে এক লেভেলের মানুষের মুগ্ধতা বাড়ত; তারা চোখ বড় বড় করে ভাবত, এই লোক তো দেখি এইটি-সেইটি শুধু জানে না, ঐটিও জানে! যাই বলেন, এখনও এ দেশে ইংরেজির কদর আছে।
যুদ্ধাপরাধীর বিচার থেকে বাঁচার জন্য চোরের মতো যখন দিনাজপুরের হিলি বর্ডার দিয়ে আমার যোগ্য ও বাপকাবেটা পুত্র, শ্যালক ও তার চেয়েও বড় কুটুম ইউনিভার্সিটির এক টিচার_ আমাদের আদর্শের এক সৈনিক, এর সাহায্যে সবার চোখে ধুলো দিয়ে চোরের ছাওয়াল চোর ও 'তস্করস্য তস্কর'-এর মতো পালিয়ে আসি, তার আগে দেশে একটি সাংঘাতিক কাজ শুরু করে এসেছিলাম। সর্বধর্মের মিলন ও সম্প্রীতির এক সংগঠন। এবার আপনারা বলুন তো আমি কোন রাজাকার? পারতে হবে কিন্তু, নইলে আপনারা দেশ রক্ষা করতে পারবেন না।
রণজিৎ বিশ্বাস : কথাসাহিত্যিক
No comments