শ্রদ্ধাঞ্জলি- পিরুজালী ঢাকা পড়েছে নুহাশপল্লীর আড়ালে by শাকুর মজিদ
মাত্র ৩০ দিনে গাজীপুরের এই পিরুজালী গ্রামটি কেমন করে যেন বদলে গেল। জঙ্গলের মধ্যে নিরিবিলি থাকা আর নিজের নাটক-সিনেমার শুটিং করার জন্য ২০ বিঘা জমি যখন কেনেন, তখন কিছু গাছগাছালি, সাপখো ছাড়া আর কিছুই তেমন ছিল না। দীর্ঘ ১৫ বছরে আপন মমতায় নিজ হাতে তিনি এর কলেবর বাড়িয়েছেন দ্বিগুণ।
এ বৃক্ষপ্রেমী লেখক তৈরি করেছেন দেশের সবচেয়ে বড় ঔষধি বৃক্ষের বাগান, নিজের ও ইউনিটের থাকার জন্য ঘর, দিঘি—কত কিছু। একটুখানি ফুরসত পেলেই ছুটে আসতেন তাঁর প্রিয় নুহাশপল্লীতে। কথা বলতেন বৃক্ষদের সঙ্গে, মমতামাখা হাতে স্পর্শ করতেন গাছের ডাল, পাতা। কিন্তু তার সবই এখন ইতিহাস। তিনি নেই।
গত ২৪ জুলাই, অবশেষে তাঁর শেষ ঠিকানা হিসেবে নির্ধারিত হয়ে যায় এই প্রিয় আঙিনা। ২৪ জুলাইয়ের বৃষ্টিমুখর দিনে হাজার হাজার ভক্তের অশ্রু মিশে গিয়েছিল বাদলের ধারায়। তাঁর প্রিয় লিচুতলায় সমাহিত করার পর থেকে প্রতিদিনই বদলে যেতে থাকে এই আঙিনার চেহারা। শত শত লোকের আগমন ঘটতে থাকে। বাদলের প্রথম ফোটা কদম ফুল হাতে নিয়ে ভক্তরা এসে দাঁড়ান কবরের কাছে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আবার চলে যান। দিনে দিনে বাড়তে থাকে এই অনুরাগীর সংখ্যাও। ঠিক এক মাস পর এই নুহাশপল্লীতে দেখা যায় ভিন্ন রূপ।
পিরুজালী গ্রামের মসজিদের কাছে উত্তর দিকে প্রায় দেড় কিলোমিটারের পথ। তার কিছুটা পাকা, কিছু এখনো কাঁচা। নুহাশপল্লী থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার আগে রাস্তার পাশে দাঁড় করানো কয়েক শ গাড়ি, তার পাশে বসে গেছে বাজার। দেশের বড় পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ঢোকার আগে যেমনটি থাকে, অনেকটা তার চেয়েও বেশি। সবই অস্থায়ী দোকানপাট। প্রতিদিনের অবিরাম জনস্রোত দেখে স্থানীয় লোকেরা ফলমূল, নানা রকম খাবারদাবারের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন। গেটের বাইরে গানের আসর বসিয়েছেন হালিম সরকার। পিরুজালী গ্রামেই তাঁর বাড়ি, হুমায়ূন আহমেদের কয়েকটা নাটকে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি। বিভিন্ন সময় নুহাশপল্লীতে এসে গান শোনাতেন তাঁকে। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে তাঁকে নিয়ে আটটি গান লিখেছেন তিনি। নিজেই সুর করেছেন, নিজেই গাইছেন। এখানে একটা স্টেজ বানিয়ে তিনি আসর বসিয়েছেন গানের।
৩০ দিনের মাথায়, আজকের (গতকাল) ২৪ আগস্ট দিনটি সরকারি ছুটির দিন বলেই হয়তো এমন উপচে পড়া ভিড় ছিল এই নুহাশপল্লীতে। ভেতরে এবং বাইরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই উপচে পড়া জনস্রোত তাঁর দাফনের দিনের লোকসংখ্যাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে নিঃসন্দেহে।
এসেছিলেন জাপানের রিক্কিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য কিয়োসি কাসাহারাও। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও দুজন জাপানি-বাংলাদেশি। সৈয়দ মুর্তাজা ও নাসির উদ্দিন জমাদার। দুজনই রিক্কিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বছর তিনেক আগে এই অধ্যাপকের সঙ্গে হুমায়ুন আহমেদের দেখা হয়েছিল। নিউইয়র্কের নীল আকাশে ঝক ঝকে রোদ বইটিতেও এই লেখককে তিনি স্মৃতিচারণা করেছিলেন। অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলামের বাসায়ও তাঁকে নিয়ে আয়োজন হয়েছিল আড্ডার। আজ মাজহারই তাঁকে নিয়ে গেছেন তাঁর কবরস্থান দেখানোর জন্য। জাপানে জোনাকি পোকা ছিল না (বর্তমানে চাষ করা হচ্ছে) বলে একবার এক জাপানি অধ্যাপককে নুহাশপল্লীতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই অধ্যাপক রাতের অন্ধকারে মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলেন বাংলাদেশের জোনাকি। আজ এই অধ্যাপক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গেলেন বাংলাদেশি এক লেখকের নিজের হাতে গড়া এক উদ্ভিদ উদ্যান। একসময় ড. কিয়োসি এসে কবরস্থানের সামনে দাঁড়ালেন। এ সময় লেখকের কবর জিয়ারতের জন্য মোনাজাতের ভঙিতে হাত তুলে দাঁড়ালেন আলমগীর রহমান, মাজহারুল ইসলাম, কমল, নাসির জমাদারসহ বেশ কয়েকজন। একসময় দেখি অধ্যাপক কিয়োসিও হাত তুলেছেন মোনাজাতের জন্য। মোনাজাত শেষ। এবার তিনি অনুরোধ করেন তাঁদের ধর্মীয় শিষ্টাচার অনুযায়ী তিনি যেন এ মৃতের জন্য প্রার্থনা করতে পারেন। বাঁশের বেড়া ডিঙিয়ে প্রবেশ করেন তিনি। দুই পায়ে ভর করে বসে করজোড়ে মাটি ছুঁয়ে প্রার্থনা করেন। উঠে যাওয়ার সময় আরেকবার কুর্ণিশ করে তিনি কবরস্থান ত্যাগ করলেন।
মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে এই পিরুজালী গ্রামের নামটি ঢাকা পড়ে যাচ্ছে নুহাশপল্লীর আড়ালে। যেমন করে বোলপুর ঢাকা পড়ে শান্তিনিকেতন নামের আড়ালে। রবীন্দ্রনাথের ১১ বছর বয়সে তাঁর বাবা কেবল ব্যক্তিগত প্রার্থনা আর বিশ্রামের জন্য শান্তিনিকেতন নামক একটা আশ্রম বানিয়েছিলেন।
কালের পরিক্রমায় আজ এখন এটা ‘বিশ্বভারতী’ নামক বিশ্বের একটি অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নিয়েছে। আমাদের নুহাশপল্লীও হয়তো এ রকম একটা কিছু হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশে ঢাকার এত কাছে চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশে হুমায়ূন আহমেদের পবিত্র স্মৃতিচিহ্নকে সামনে রেখে এই অঞ্চলটি শিক্ষা-সংস্কৃতি ও পর্যটকের একটি চমৎকার কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে—নুহাশপল্লীই হতে পারে আমাদের শান্তিনিকেতন।
গত ২৪ জুলাই, অবশেষে তাঁর শেষ ঠিকানা হিসেবে নির্ধারিত হয়ে যায় এই প্রিয় আঙিনা। ২৪ জুলাইয়ের বৃষ্টিমুখর দিনে হাজার হাজার ভক্তের অশ্রু মিশে গিয়েছিল বাদলের ধারায়। তাঁর প্রিয় লিচুতলায় সমাহিত করার পর থেকে প্রতিদিনই বদলে যেতে থাকে এই আঙিনার চেহারা। শত শত লোকের আগমন ঘটতে থাকে। বাদলের প্রথম ফোটা কদম ফুল হাতে নিয়ে ভক্তরা এসে দাঁড়ান কবরের কাছে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আবার চলে যান। দিনে দিনে বাড়তে থাকে এই অনুরাগীর সংখ্যাও। ঠিক এক মাস পর এই নুহাশপল্লীতে দেখা যায় ভিন্ন রূপ।
পিরুজালী গ্রামের মসজিদের কাছে উত্তর দিকে প্রায় দেড় কিলোমিটারের পথ। তার কিছুটা পাকা, কিছু এখনো কাঁচা। নুহাশপল্লী থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার আগে রাস্তার পাশে দাঁড় করানো কয়েক শ গাড়ি, তার পাশে বসে গেছে বাজার। দেশের বড় পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ঢোকার আগে যেমনটি থাকে, অনেকটা তার চেয়েও বেশি। সবই অস্থায়ী দোকানপাট। প্রতিদিনের অবিরাম জনস্রোত দেখে স্থানীয় লোকেরা ফলমূল, নানা রকম খাবারদাবারের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন। গেটের বাইরে গানের আসর বসিয়েছেন হালিম সরকার। পিরুজালী গ্রামেই তাঁর বাড়ি, হুমায়ূন আহমেদের কয়েকটা নাটকে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি। বিভিন্ন সময় নুহাশপল্লীতে এসে গান শোনাতেন তাঁকে। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে তাঁকে নিয়ে আটটি গান লিখেছেন তিনি। নিজেই সুর করেছেন, নিজেই গাইছেন। এখানে একটা স্টেজ বানিয়ে তিনি আসর বসিয়েছেন গানের।
৩০ দিনের মাথায়, আজকের (গতকাল) ২৪ আগস্ট দিনটি সরকারি ছুটির দিন বলেই হয়তো এমন উপচে পড়া ভিড় ছিল এই নুহাশপল্লীতে। ভেতরে এবং বাইরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই উপচে পড়া জনস্রোত তাঁর দাফনের দিনের লোকসংখ্যাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে নিঃসন্দেহে।
এসেছিলেন জাপানের রিক্কিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য কিয়োসি কাসাহারাও। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও দুজন জাপানি-বাংলাদেশি। সৈয়দ মুর্তাজা ও নাসির উদ্দিন জমাদার। দুজনই রিক্কিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বছর তিনেক আগে এই অধ্যাপকের সঙ্গে হুমায়ুন আহমেদের দেখা হয়েছিল। নিউইয়র্কের নীল আকাশে ঝক ঝকে রোদ বইটিতেও এই লেখককে তিনি স্মৃতিচারণা করেছিলেন। অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলামের বাসায়ও তাঁকে নিয়ে আয়োজন হয়েছিল আড্ডার। আজ মাজহারই তাঁকে নিয়ে গেছেন তাঁর কবরস্থান দেখানোর জন্য। জাপানে জোনাকি পোকা ছিল না (বর্তমানে চাষ করা হচ্ছে) বলে একবার এক জাপানি অধ্যাপককে নুহাশপল্লীতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই অধ্যাপক রাতের অন্ধকারে মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলেন বাংলাদেশের জোনাকি। আজ এই অধ্যাপক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গেলেন বাংলাদেশি এক লেখকের নিজের হাতে গড়া এক উদ্ভিদ উদ্যান। একসময় ড. কিয়োসি এসে কবরস্থানের সামনে দাঁড়ালেন। এ সময় লেখকের কবর জিয়ারতের জন্য মোনাজাতের ভঙিতে হাত তুলে দাঁড়ালেন আলমগীর রহমান, মাজহারুল ইসলাম, কমল, নাসির জমাদারসহ বেশ কয়েকজন। একসময় দেখি অধ্যাপক কিয়োসিও হাত তুলেছেন মোনাজাতের জন্য। মোনাজাত শেষ। এবার তিনি অনুরোধ করেন তাঁদের ধর্মীয় শিষ্টাচার অনুযায়ী তিনি যেন এ মৃতের জন্য প্রার্থনা করতে পারেন। বাঁশের বেড়া ডিঙিয়ে প্রবেশ করেন তিনি। দুই পায়ে ভর করে বসে করজোড়ে মাটি ছুঁয়ে প্রার্থনা করেন। উঠে যাওয়ার সময় আরেকবার কুর্ণিশ করে তিনি কবরস্থান ত্যাগ করলেন।
মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে এই পিরুজালী গ্রামের নামটি ঢাকা পড়ে যাচ্ছে নুহাশপল্লীর আড়ালে। যেমন করে বোলপুর ঢাকা পড়ে শান্তিনিকেতন নামের আড়ালে। রবীন্দ্রনাথের ১১ বছর বয়সে তাঁর বাবা কেবল ব্যক্তিগত প্রার্থনা আর বিশ্রামের জন্য শান্তিনিকেতন নামক একটা আশ্রম বানিয়েছিলেন।
কালের পরিক্রমায় আজ এখন এটা ‘বিশ্বভারতী’ নামক বিশ্বের একটি অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নিয়েছে। আমাদের নুহাশপল্লীও হয়তো এ রকম একটা কিছু হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশে ঢাকার এত কাছে চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশে হুমায়ূন আহমেদের পবিত্র স্মৃতিচিহ্নকে সামনে রেখে এই অঞ্চলটি শিক্ষা-সংস্কৃতি ও পর্যটকের একটি চমৎকার কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে—নুহাশপল্লীই হতে পারে আমাদের শান্তিনিকেতন।
No comments