সরকার ভিলেনের পার্ট কেন পছন্দ করছে? by মুনতাসীর মামুন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ার কথা বলেন। কিন্তু, সেটি গড়া যে কঠিন তা’ হয়ত তিনি ইতোমধ্যে অনুধাবন করছেন। আমরা তো হাড়ে হাড়ে করছি। আমাদের সবার ভেতরে ক্ষুদে এক সামন্ত বসবাস করে। সামান্য পদ বা ক্ষমতা পেলে সে ক্ষুদে সামন্ত মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এবং গণতান্ত্রিক বোধ পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হয়।


কারণ তখন নিজেকে ছাড়া অন্যদের জন্য গণতন্ত্র কার্যকর করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়। এই ক্ষুদে সামন্তদের কারণেই কি একটির পর একটি ইস্যু সৃষ্টি হচ্ছে?
গত দু’মাসে দেশের প্রধান সমস্যা বিদ্যুত অভাব বা লোডশেডিং থেকে দেশ মুক্ত ছিল। স্বাভাবিকভাবেই মিডিয়া এ নিয়ে মাতামাতি করেনি। কারণ সংবাদটি ইতিবাচক, নেতিবাচক নয়। রমজান ও ঈদে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়া একটি ঐতিহ্য। এবার সেভাবে বাড়েনি, তার মানে এ নয় যে, সব কিছু সাধারণের দূরে থাকুক, মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ছিল। কিন্তু মানুষ পণ্যমূল্য নিয়ে খুব একটা ক্ষুব্ধ হয়নি। স্বাভাবিকভাবে মিডিয়া বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছে, কারণ এ খবর ইতিবাচক, নেতিবাচক নয়। ঈদে যাতায়াত নিয়ে লঙ্কাকা- হতে পারত, হয়নি, সব সময় প্রবল দুর্ঘটনা ঘটে। এবার তাও ঘটেনি। সাহারা তালা ব্যবহারের জন্য এবার ঘরে ঘরে চুরি চামারিও তেমন হয়নি। লোকজন স্বরাস্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে যত হাসি তামাশা বা সমালোচনাই করুন না কেন সাহারা তালা যে চীনা তালা থেকে কার্যকর তা প্রমাণিত হয়েছে। এ সমস্ত ঘটনা খবর নয়, কারণ এর মধ্যে নেতিবাচক কিছু নেই। সংবাদ মাধ্যমের ক্ষুদে সামন্তরা যেমন চায় তেমন খবর এগুলো নয়। খবর হলো, একটি দেশের রাষ্ট্রদূত কী বলছেন সেটি। হীনম্মন্যতা কাকে বলে! ক্ষুদে সামন্তদের হীনম্মন্যতাও একটি বৈশিষ্ট্য।
এ রকম অবস্থায় সরকার নিজে থেকে কোন প্রায় প্রতি সপ্তাহে একটি ইস্যু তৈরি করে তা বোধগম্য নয়। নিশ্চয়, এসব ঘটনা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঘটে না। যার নির্দেশেই ঘটুক প্রধানমন্ত্রী তার প্রশ্রয় দেন কেন তাও সাধারণের বোধগম্য নয়। সরকার কেন ভিলেন সাজতে চায়? নাকি, সরকার বাবু মনে করেন, ভিলেনকেই দর্শকরা পছন্দ করে, হিরোকে নয়।
গত এক মাসের ইস্যুগুলো দেখুন। ২০ লাখ [নাকি আরও কম] আদিবাসীকে বা ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে জাতিসংঘের আিদবাসী দিবস পালন করতে দেয়া হলো না। যারা এই নখরামিটি করেছে তারা নির্বাচনে দাঁড়াবে কি না জানি না। কিন্তু আওয়ামী লীগের কুড়ি লাখ ভোট নষ্ট করার অধিকার তাদের কে দিয়েছে? বাঙালীরাও কি আদিবাসী? তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। কিন্তু বাঙালীরা কি জানে না পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ে মূল বিষয় ছিল সাংস্কৃতিক অবমাননা, নিপীড়ন, দমন? এ অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও এ সরকার বিশেষ করে যে সরকার শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের সরকার হিসেবে পরিচিত, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার হিসেবে পরিচিত তারা কী ভাবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়?
জমিয়াতুল মোদাসসরিন একটি রাজাকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। ১৯৭১ সালে এর প্রতিষ্ঠাতা আলবদরের কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটি সমর্থন করেছিল হানাদার বাহিনীকে। এদের দাবি অনুযায়ী, আরবী বিশ্ববিদ্যালয় করতে হবে। সেই দাবি মেনে নেয়া কি গৌরবের? জমিয়াতুলের সদস্যরা, মাদ্রাসায় পড়ুয়ারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে? এ রকম দিবাস্বপ্ন যখন একটি দলের কা-ারিরা দেখে তখন মনে হয় অতি আত্মবিশ্বাস কি বিভ্রম সৃষ্টি করে? মোদাসসরিনের দাবি মানা হবে যারা ভোট দেবে না, কিন্তু আদিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ভোট দেবে দেখে তাদের অবমাননা করা হবে, এটি সুস্থ মানুষের কাজ বলে মনে হয় না। সরকার এখন আদিবাসীদের কাছে ভিলেন, মোদাসসরিনরা তো সব সময়ই বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা সবাইকে শুধু ভিলেন নয়, ইসলাম ধর্ম বিরোধী বলে মনে করে।
আবুল হোসেন এক মাস আগে পদত্যাগ করেছেন। তিনি আবার ফিরে আসবেন এটি আমরা সবাই জানি। এখন যখন যেতে চাচ্ছেন তখনও মনে হয় সরকার এতে খুশি নয়। যদি খুশি না হন, তাহলে লড়ে যান, আবুল হোসেনকে রেখেদিন। এক মাস ঝুলিয়ে রেখে তাকে নিয়ে যেসব গুজব ছিল সেগুলোকে আরও পল্লবিত হওয়ার সুযোগ দেয়া হলো, মুখরোচক অনেক গল্পের সৃষ্টি হলো, সরকার কিছু কার্টুন উপহার পেল। সোহেল তাজকে নিয়ে একই ব্যাপার হয়েছে। শেখ হাসিনা তাকে স্নেহ করেন, তাকে নিশ্চয় সুযোগ দিয়েছেন থাকার জন্য, কিন্তু যখন সে গোঁ ধরেছে তখন তাকে ছেড়ে দেয়াই উচিত ছিল। সোহেলের নাটকীয়তা তাহলে প্রশ্রয় পেত না। কিন্তু পুরো ঘটনা উভয়পক্ষের জন্য তিক্ত স্বাদের সৃষ্টি করেছে। এই পদত্যাগকে ঘিরে যে গুজব ছিল তা আরও জোরদার হয়েছে মাত্র। সরকার ভিলেনের রোলটিই আবার বেছে নিয়েছে।
ড. ইউনূসকে নিয়ে যে এখনও বিতর্ক চলছে তার একটি কারণ তো অর্থ মন্ত্রণালয় বটেই। একেবারেই যাবতীয় সংশোধন করে যা যা করার দরকার করে নিলে এসব বিতর্কের সৃষ্টি হতো না। যা বিতর্ক হতো একবারই হতো। এ বিতর্কে সরকার লাভবান হচ্ছে না, ড. ইউনূসও না। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি এবং এ জন্য দু’পক্ষই দায়ী। গ্রামীণ ব্যাংক একাই সুদ নেয় না বা রক্তচোষাও নয়। সরকার যত মাইক্রো ক্রেডিটকে লাইসেন্স দিয়েছে প্রত্যেকের চরিত্রই এক রকম। ড. ইউনূস ১০ বছর বেশি ভাতা নিলে তার জন্য সরকারও দায়ী। ড. ইউনূসের থেকে সে টাকা ফেরত নিলে, গত দশ বছরে যারা এই ভুল নিরীক্ষা করেনি তাদেরও শাস্তি দিতে হবে। গত প্রায় দু’বছর সরকার এমডি পদের সুরাহা করেনি কেন? কিন্তু যে বিষয়টি সবাই বুঝতে অক্ষম, তা হলো, যে ড. ইউনূসের সুনাম বিশ্বজোড়া তিনি এ বয়সেও একটি ব্যাংকের এমডি পদে থাকতে চান কেন? কী মধু এতে? যে সরকার তার সঙ্গে এমন করছে সে সরকারের পদে লাথি মেরে সরে গেলে অসুবিধা কী? আর হাইকোর্টের রায়ের পর তিনি তো এমডি হতেও পারবেন না। কিন্তু তিনি ও সুশীল সমাজ ব্যাংকের এমডি পদের জন্য এমন করছেন তাতে মনে হচ্ছে এ পদে নিশ্চয় অনেক আর্থিক সুবিধা আছে। এই ব্যাংকে গরিবদের কী কষ্ট আছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। একটি ব্যাংকের থেকে যারা ঋণ নেবে তারা ব্যাংকের অংশীদারÑএ ধারণা এ্যাবসার্ড। ড. ইউনূস যে এতদিন নেই তাতে ব্যাংকের কী ক্ষতি হয়েছে? সুশীল সমাজের কয়েকজন ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে কেউ চিন্তিত নয়। আমাদের আপত্তির বিষয় অন্য। গ্রামীণ ব্যাংকে যে সব রাষ্ট্রের এক পয়সারও বিনিয়োগ নেই তাদের কথা বলার কী অধিকার আছে এ ব্যাংক নিয়ে? একমাত্র অর্থমন্ত্রী ছাড়া এ কথা কেউ বলেননি।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত যখন বলেন, আমেরিকা বাংলাদেশের সংলাপের এজেন্ডা গ্রামীণ ব্যাংক তখন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর ঐ জবাবটাই মজেনাকে ভালভাবে দেয়া উচিত। কিন্তু বিদেশীদের এই হস্তক্ষেপের দায়দায়িত্ব ড. ইউনূসের ওপরই বর্তেছে। এতে নিজের দেশে তিনি পরদেশী হয়ে যাচ্ছেন। তিনি নিশ্চয় ভোলেননি, যারা তাকে রাজনীতিতে নামিয়েছিলেন, বিপদ দেখে তারা সরে গিয়েছিলেন।
আসলে দ্বন্দ্বটা ড. ইউনূস ও শেখ হাসিনার দ্বন্দ্ব হিসেবে যতই প্রচার হোক তা তেমন সত্য নয়। দ্বন্দ্বটা পুঁজিবাদের রূপ নিয়ে। ড. ইউনূস পুঁজিবাদের কঠিন খোলসটা সরিয়ে নমনীয় একটি মোড়ক দিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার পুঁজিবাদ তো বটেই মুক্ত অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। তাহলে ড. ইউনূসের ব্যাপারে তারা আপত্তি করছে কেন এ বিষয়টিই পাশ্চাত্য বুঝতে পারছে না। কিন্তু এ বিতর্কে, সরকার তার যুক্তিগুলো যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারেনি, অভ্যন্তরীণ ও বিদেশী মিডিয়ায়। হায়! প্রধানমন্ত্রীর চারপাশে ডিগ্রীধারী এতো লোকের সমাবেশ তারাও প্রধানমন্ত্রীর সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারেননি। এমনকি আওয়ামী সমর্থক জাঁদরেল বুদ্ধিজীবীরাও। এটির কারণ বোধহয় খতিয়ে দেখলে ভাল। প্রধানমন্ত্রী সুশীল সমাজকে কেয়ার করেন না কিন্তু তাঁর উপদেষ্টারা করেন, বুদ্ধজীবীরা করেন। ফলে সরকার এ ইস্যুতে ভিলেনই থাকল, হিরো আর হতে পারল না।
অন্যান্য ইস্যু বাদ দিয়ে লিমন ইস্যু দিয়েই শেষ করি। এক গরিব বেচারাকে প্রতিপক্ষ করে সরকার হতে যাচ্ছে ভিলেন আর লিমন হিরো। লিমনকে পঙ্গু করার পর যা যা ঘটেছে তার একটিও র‌্যাবের পক্ষে যায়নি। পুলিশী তদন্তও নয়। র‌্যাব জঙ্গী ও সন্ত্রাস দমনে কাজ করেছে তা ভেতরে ভেতরে সবাই প্রশংসা করে। ‘ক্রসফায়ার’ না হলে লোকে র‌্যাবকে দেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা বাহিনী মনে করত। কিন্তু সেনা পুলিশের পর স্রেফ জেদের কারণে র‌্যাবেরও একই অবস্থা হবে। র‌্যাবের সাক্ষী ইব্রাহিম যে কারণেই মামলা করুক না কেন, তা র‌্যাবের পক্ষে যায়নি। লিমন সংক্রান্ত কোন ঘটনা র‌্যাবের পক্ষে যাবে না। লিমন থেকে র‌্যাব সরে গেলে এমন কিছু হতো না। যদি র‌্যাবের কেউ অপরাধী হয়ে থাকে তাকে বাঁচানোর জন্য পুরো বাহিনীর নাম নষ্ট করে কী লাভ? র‌্যাবে যারা আছেন, বিশেষ করে তরুণরা, তারা হাইতির টন টন ম্যাকাউ ও ইরানের সাভাকের নাম শুনেছেন কিনা জানি না। এরাও একসময় হাইতি ও ইরানে খুবই মশহুর নির্যাতনকারী বাহিনী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছিল। এখন ঐ বাহিনীর সদস্যদের রাস্তাঘাটে দেখলে আক্রান্ত হতে হয়।
আমরা জানি, বাংলাদেশের কোন নিরাপত্তা বাহিনী আমাদের বন্ধু নয়। তারা সরকারের বন্ধু। এ সরকার যদি সরকারে না থাকে তখন তারা ঐ সরকারের বন্ধু এবং এ সরকারের শত্রু হবে। পুরনো ছবি, প্রতিবেদন, টিভি ফুটেজ এর প্রমাণ। এসব জেনেও সরকার লিমন ইস্যু কেন জিইয়ে রাখছে? কী লাভ হচ্ছে তাতে কয়েকজনের জেদ রাখা ছাড়া। জজ মিয়ার কাহিনী যেমন কেউ বিশ্বাস করে না লিমনের কাহিনীও বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না।
মানুষ তো ফেরেশতা নয়। ফেরেশতারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়বেন না। মানুষই গড়বে এবং যেহেতু মানুষ সেহেতু ভুল করবে। সে ভুল সংশোধন করলে বা এড়িয়ে গেলেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দৃঢ় হবে। ক্ষুদে সামন্ত মনোভাব, হীনম্মন্যতা, জেদ এগুলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শত্রু। ভিলেনকে কেউ মনে রাখে না, দুয়ো দেয়।
আমরা চাই না আগামী এক বছর অযথা নন ইস্যুকে ইস্যু করতে দিক সরকার। বরং ১ সেপ্টেম্বর থেকে পদ্মা সেতুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ভোটার তোষণ শুরু করুক। ভোটারদের চোখে ভিলেন নয়, হিরো হয়ে উঠুক।

No comments

Powered by Blogger.