মাইল স্টোন না টুম্ব স্টোন by আতাউস সামাদ
প্রথমেই স্বীকার করে নেই যে, ভারতের বিরুদ্ধে কিছু বলার সময় ব্যক্তিগতভাবে আমার কিছুটা খারাপই লাগে। তার প্রথম কারণ হলো আমার নিজের শিশু থেকে কিশোর হয়ে ওঠার কালটা কেটেছে হুগলি, কলকাতা আর জলপাইগুড়িতে। যদিও তখন সময়টা ভালো ছিল না। আমরা হুগলিতে থাকতে থাকতেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তারপর বাবা যখন কলকাতায় বদলি হলেন, তখন যুদ্ধ চলছে পুরোমাত্রায়।
আমরা কলকাতায় থাকতে থাকতেই জাপানি বিমান হামলার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। আর ওই শহর ছাড়ার আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল দুর্ভিক্ষ। সেই সময় আমাদের বাসার দোতলার ঝুল বারান্দা থেকে নিচে রাজপথে ভুখা শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দিনের পর দিন যে অবস্থায় দেখেছিলাম, আজও আমাদের মহান শিল্পী জয়নুল আবেদীনের আঁকা দুর্ভিক্ষের স্কেচগুলোতে যেন তাই দেখতে পাই। সে জন্যই বোধ হয় তার ওই ছবিগুলো খুব পরিচিত মনে হয়। ব্রিটিশ ও মার্কিন সৈন্যদের কনভয় দেখতে দেখতে থ্রি নট থ্রি রাইফেল, টমি গান, মেশিন গান ও সাব-মেশিন গান চেনা হয়ে গিয়েছিল আমাদের মতো বাচ্চাদেরও। আর সেই সময়ই খাদ্য রেশনিং প্রথার সঙ্গেও পরিচয় হয়। কলকাতার পর জলপাইগুড়ি। সেখানে পৌঁছানোর কিছুদিন পরই আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল একদিকে ব্রিটিশের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য অপেক্ষার আনন্দ আর অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্ক। কিন্তু এত ভয় ও দুঃখের মধ্যেও ভালো আর মজার ছিল অনেক কিছু। হুগলির নদী, ইমাম বাড়া আর গাছপালায় ভরা বাসা এবং সেখানে অসংখ্য বাঁদরের উত্পাত; কলকাতায় ট্রাম দেখা আর চড়া, হাওড়া অথবা শিয়ালদহ স্টেশনে ব্রডগেজ ট্রেনের অতিকায় ইঞ্জিন দেখে ভয়ে বড়দের হাত চেপে ধরা, একই সঙ্গে ওই ট্রেনে উঠতে পারার আনন্দ, খিদিরপুর ডকে মস্তবড় জাহাজগুলোর চিমনির ডগাটা দেখার জন্য ওপর দিকে তাকিয়ে আকাশ দেখে ফেলা, বাসার ছাদে বড় ভাইরা ঘুড়ি উড়ানোর সময় এক-দু’বার নাটাই ধরতে পারা এবং ঈদের সময় ওয়াসেল মোল্লার দোকান থেকে জামা-জুতো কেনাকাটা হয়ে যাওয়ার পর গড়ের মাঠে ঈদের জামাত শেষে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম এবং তারপর বাবা বা বড় ভাইদের হাত ধরে বাড়ি ফিরে সারা দুপুর ‘কলের গান’ বাজানো; কলকাতায় থাকতে এসব ছাড়াও ছিল চিড়িয়াখানা এবং বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ। আর জলপাইগুড়িতে তিস্তা নদী ও করলা খালের একেক সময় একেক রূপ, খালের ওপর ঝুলন্ত সেতু, রাস্তার ঢালে স্কুলের ক্লাসরুম থেকে পথের দিকে তাকিয়ে থাকায় কানে স্যারের হাতের হিমশীতল ছোঁয়া, ‘খেলনা ট্রেনে’ চেপে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিংয়ে বেড়াতে যাওয়া এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা আর এভারেস্ট গিরিশৃঙ্গ এবং বড় জলপ্রপাত দেখা—এসব কিছুর সুখ-স্মৃতি বিষাদময় ছবিগুলোর তলায় চাপা পড়ে যায়নি। ওই ছোটবেলাতেই ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের কত কিছু যে জেনেছিলাম এবং পরে তা থেকে শিক্ষা নিয়েছিলাম। এ জন্য ভারতের ওই শহরগুলো এবং সেসব জায়গায় কাটানো দিনগুলো আমার প্রিয়। আমি নিশ্চিত যে, বাংলাদেশে আমার মতো বহু মানুষ আছেন যারা একই রকম অনুভব করেন।
দ্বিতীয়ত, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে যে সহায়তা দিয়েছে, প্রায় এক কোটি বাঙালি শরণার্থীকে নয় মাস আশ্রয় ও খাদ্য দিয়েছে, অবশেষে রণাঙ্গনে এসে ভারতীয় সৈন্যরা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করে নৃশংস পাকিস্তানি হানাদারদের পরাস্ত করতে সাহায্য করেছে, সে কথাও আমরা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করি। মার্চ মাস এসে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ দিবাগত রাত থেকে। সে রাতে যুদ্ধের ঘোষণা এসেছিল বেইমান পাকিস্তানিদের রাইফেল, স্টেনগান আর কামানের গর্জনের মাধ্যমে এবং তাদেরকে আমাদের পুলিশ ও বিডিআর সৈনিকদের প্রতিরোধের ভেতর দিয়ে। এ মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বেশি বেশি মনে করব এবং তখন ভারতের সহায়তার কথাও আমরা অবশ্যই বলব।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে স্ত্রীর কোলে নবজাত কন্যা এবং আমাদের সঙ্গে বৃদ্ধা মাতা থাকায় (আসলে তার সঙ্গে আমরা থাকতাম) ঢাকা থেকে চলে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার কথা আমরা বাতিল করে দেই। পরে আগস্ট কী সেপ্টেম্বরের দিকে আবার একবার ভাবলাম নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ভারতে যাই। এ জন্য আগরতলায় অবস্থানরত আমার বড় বোনকে খবরও পাঠিয়েছিলাম। উত্তরে তিনি একটা চিরকুট পাঠালেন, যার মধ্যে একটা বাক্য ছিল ‘তোমরা আসতে পারো কিন্তু এখানে তোমার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।’ আমার বোন জাহানারা হক তখন বাংলাদেশের কসবা থানা থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে ’৭০-এর নির্বাচনে জয়ী জাতীয় সংসদের সদস্য বিশিষ্ট আইনজীবী জনাব সিরাজুল হকের স্ত্রী। কসবার পাশেই আগরতলা, ফলে সেখানে মুক্তিযুদ্ধের নানান কাজে আমার ভগ্নিপতি ও বোনের স্বাভাবিকভাবেই বহুবিধ সম্পৃক্ততা রয়েছে। পরে জেনেছি অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক ও জনাব এমআর সিদ্দিকীকে (পরে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী) ’৭১-এর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বিশেষ ব্যবস্থায় নয়াদিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ভারতীয় শীর্ষ কর্তৃপক্ষের কাছে জনাব তাজউদ্দীন আহমদকে শনাক্ত করার জন্য। সম্ভবত এই শনাক্তকারী দু’জনকে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে শনাক্ত করে দিয়েছিলেন ত্রিপুরা প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। তো সেই বোনের কাছ থেকে লাল সঙ্কেত পেয়ে ঢাকায় থেকে গেলাম। আমার স্ত্রী কামরুন নাহার, যিনি জনাব সিরাজুল হকের ছোট বোন। বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বললেন, যেমনটি আগে থেকেই বলছিলেন, ‘মরলে দেশের মাটিতেই মরবো।’ এখানে বলা খুবই জরুরি যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ বাংলাদেশে বাঙালি জননী, ভগিনী ও জায়াদের অসাধারণ সাহসী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল—যার মধ্যে অন্যতম ছিল পাকিস্তানি নরপশুদের হাতে বন্দি হয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের আটক আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজখবর নেয়া, গোপনে তাদের ওষুধ ও খাবার পৌঁছে দেয়া এবং বন্দিদের মুক্তির জন্য চেষ্টা করা। এ জন্য তাদের যে পাকিস্তানিদের সঙ্গে কথা বলতে হতো এবং বন্দিশিবিরে যেতে হতো তা ছিল পরম সাহসিকতাপূর্ণ কাজ। ওই কর্তব্য পালনে যে কত সাহস দরকার হতো এবং ঝুঁকি নিতে হতো অন্যের পক্ষে তা পূর্ণভাবে উপলব্ধি করা খুবই কঠিন। এক কথায় বলতে হলে বলা যায় যে, তারা রক্তপিপাসু বাঘের ঘরে যাওয়া-আসা করতেন। এখানে আরও বলে রেখে যেতে চাই যে, এই অসম সাহসী নারীরা শুধু নিজের পুত্র, স্বামী, ভ্রাতা বা পিতার খোঁজখবরই নিতেন না—তারা অন্য বিপন্ন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে থেকে একে অপরের জন্য কাজ করতেন। এ ধরনের কোনো নারী যখন পাকিস্তানি সৈন্যদের মুখ থেকে কাউকে তারা ‘জয় বাংলা ভেজ দিয়া হ্যায়’ করেছে—এমন কথা শুনে ঘরে ফিরতেন তখন তাদের কী অবস্থা হতো তা আজ কল্পনার নাগালেও আসতে চায় না। তাদের হাজার সালাম। তো ফিরে আসি মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত না যেতে পারার কথায়। আমার বোনের চিরকুট পড়ে প্রথমে বুঝিনি আগরতলায় আমার নিরাপত্তার প্রশ্ন কেন উঠবে। তবে কিছুদিনের ভেতরেই খবর পেলাম যে, ভারত সরকার বাংলাদেশের বামপন্থীদের খুব সুনজরে দেখছে না তাদের ওখানে নকশাল আন্দোলনের কারণে আর সে ক্ষেত্রে অসুবিধা হয়ে গেল আমার বেশির ভাগ বন্ধু বামপন্থী হওয়ায়। সেই বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিলেন অবজার্ভার ও হলিডে খ্যাত সাংবাদিক এনায়েতুল্লাহ্ খান। তবু আমার মধ্যে কোনো ভারত-বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়নি। আমি তো জানতাম যে, আমার ভাই-ভাতিজারা মুক্তিযুদ্ধ করছে এবং তারা সময় সময় ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিচ্ছে। সেসব দিনের কথা আজ পুনর্ব্যক্ত করতে আদৌ কার্পণ্য বোধ করি না আমি। সে জন্য ভারতের সমালোচনা করার সময় আমি তা সংযতভাবেই করি।
তৃতীয়ত, আমি, আমার স্ত্রী ও সন্তানরা সেই ভারতকে পছন্দ করি যে, ভারতের কাছ থেকে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। ওই সময়টা আমি নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বিশেষ সংবাদদাতা ছিলাম। সেখানে পেশার দিক থেকে ভারতীয় এবং অন্য দেশীয় নতুন বহু বন্ধুই শুধু পাইনি, কর্মক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে নতুন কত কিছু যে শিখেছি! একই সময় প্রতিবেশীরা ও বাঙালি সাংবাদিকদের পরিবারের সদস্যরা এবং আমার সন্তানদেন স্কুলের বন্ধুরা তাদের বুঝতেই দেয়নি যে, তারা বিদেশ বিভুঁইয়ে আছে। তবে ‘মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী’ সেইদিক থেকে দেখলে ভারতে আমার জন্য খুবই মূল্যবান ছিল প্রায় প্রতিদিন লোকসভার বিতর্ক শোনা এবং সেখানে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলতে পারা। তারপর আসে ‘সাউথ ব্লক’ (ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভবন) এবং সেচ মন্ত্রণালয়ে ভারতীয় আমলাদের সঙ্গে কাটানো সময়টা। পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় যে, ওই সাড়ে চার বছরে আমার জীবনে অভিজ্ঞতার ঝুলিতে যত সঞ্চয় হয়েছে, অন্য কোথাও ওরকম অল্প সময়ের মধ্যে হয়নি। এখানে উদাহরণস্বরূপ তার মাত্র পাঁচটি উল্লেখ করি : প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাত্কার নেয়া, ফিল্ড মার্শাল স্যাম ম্যানেকশ’র সঙ্গে তার বাড়িতে দেখা করা, ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করবেই সেই খবর দিতে পারা, ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচন এলাহাবাদ হাইকোর্টে বাতিল হওয়া ও তার ফলে ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা, ভারতের আণবিক বোমা বিস্ফোরণ এবং আমার ফ্ল্যাটের সামনের ফুটপাতে জনাব এমআর আখতার মুকুলকে (মুকুল ভাই) আবিষ্কার করতে পারায় তার সহায়তায় ভারতীয় নিরাপত্তা ব্যূহ পার হয়ে পিতৃ-মাতৃহারা শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে পারা। যে কোনো বাংলাদেশী সাংবাদিকের জন্য এ ক’টাই এক জীবনের অভিজ্ঞতা হতে পারে। তাই ভারতকে আমি সম্মানের চোখে দেখি।
লোকসভার কথা বলছিলাম। আমরা দিল্লির পার্লামেন্ট স্ট্রিট থেকে যেদিক দিয়ে লোকসভা প্রাঙ্গণে ঢুকতাম, সেদিকের গেটটা পার হলেই দেখা যায় ড. আম্বেদকারের একটা প্রস্তর মূর্তি—উঁচু বেদির ওপর বসানো। ভারতের সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যে ড. আম্বেদকার ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। এ ছাড়া গান্ধী, পণ্ডিত, প্যাটেল, সর্দার আর ব্যানার্জী অভিজাত ও দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ওই ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের রাজ্যে অচ্ছুত্ হরিজনদের গোত্র থেকে উঠে আসা নেতা ছিলেন ড. ভিমরাও আম্বেদকার। ১৯৪৯ সালে ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়। ভারত ড. আম্বেদকারকে সম্মান দেখিয়েছে; কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পর এতদিনেও হরিজনদের দুঃখ ঘোচেনি। ১৯৭২ সালে আমি যখন নয়াদিল্লিতে গিয়ে কাজ শুরু করি, তখন পশ্চিমবঙ্গে নকশালরা সরকারের সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশের হাতে নিধন হতে হতে প্রায় গুটিয়ে গেছে; কিন্তু ভারতের অন্যত্র শুরু হয়েছে ‘দলিত’ আন্দোলন। ভারতের জন্য তখনও বেদনার বিষয় ছিল ‘বন্ডেড লেবার’ বা ধনীদের কাছে বংশানুক্রমে শৃঙ্খলিত দাস বাহিনীর অস্তিত্ব। ভারত যখন পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করছে, তখন লোকসভায় আইন পাস হচ্ছে ‘বন্ডেড লেবার’ প্রথা বাতিল করার জন্য। এখনও ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ খুবই অসম। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে পশ্চিমা জগত্ তাকে খাতির করলেও ওই অসাম্য দেশটির বড় সমস্যা। বিশ্বমন্দার মধ্যেও ভারত তার ‘চমত্কার’ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখায় প্রশংসিত হচ্ছে। কিন্তু এও বাস্তব যে, ভারতের প্রবৃদ্ধি মূলত দেশটির পাঁচটি রাজ্যে সীমাবদ্ধ, বাকি ২৩টি বঞ্চিত। আর সম্ভবত সে জন্যই পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, বিহার ও দাক্ষিণাত্যের অন্ধ্র রাজ্যে নতুন করে সশস্ত্র মাওবাদী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আর এককালের ‘ভূস্বর্গ কাশ্মীর’ তো এখন ‘বিধবাদের উপত্যকা’। তবু কাশ্মীরে এখনও চলছে স্বাধীনতা সংগ্রাম (যা দিল্লির ভাষায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহিংসতা)। কিন্তু কাশ্মীরেও একটা সময় এসেছিল, যখন সেখানকার দরিদ্র কিন্তু স্বভাবে নম্র মুসলিমদের যদি অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি করার সুযোগ দেয়া হতো, তাহলে তারা সশস্ত্র বিদ্রোহের বদলে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে একটা সম্মানজনক সমাধান গ্রহণ করত। একবার দিল্লি সরকার কাশ্মীরি দরিদ্রদের জন্য বিশেষ আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করেছিল; কিন্তু কাশ্মীরে গিয়ে সেই টাকা আর দরিদ্র মুসলিমদের হাতে পৌঁছায়নি। এমন অভিযোগ শুনেছি দিল্লির বন্ধুদের মুখেই। ভারতীয় শাসকদের এ স্বার্থপর ও আগ্রাসী চরিত্রকে আমরা বিশ্বাস করতে পারি না, সম্মান করার তো প্রশ্নই ওঠে না।
এই মার্চ মাসে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর যারা আমাদের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তাদের শ্রদ্ধা জানাই আমাদের লাখো শহীদের সঙ্গে। কিন্তু যুগপত্ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ও জনাব এইচটি ইমামসহ প্রধানমন্ত্রীর যেসব সদস্য ভারতের ‘আস্থা’ অর্জনের বানে ভাসছেন, তাদের ওই দেশের শাসকদের সম্পর্কে কিছুটা সতর্ক ও কিছুটা কম উচ্ছ্বাসপ্রবণ হতে অনুরোধ করি। এরই মধ্যে বাংলাদেশ রাইফেলসের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মইনুল ইসলাম সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্তের সমস্যা নিয়ে মন্তব্য করেছেন যে, বাংলাদেশ ও ভারতের শীর্ষ পর্যায়ে সম্প্রতি যে সমঝোতা হয়েছে, তার প্রভাব এখনও ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ পর্যন্ত পৌঁছায়নি। মেজর জেনারেল মইনুল ইসলাম বিনয়ী মানুষ। তা ছাড়া ‘ডিসিপ্লিন’ মানতে হয় তাকে। তাই তিনি বলতে পারেননি যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর সংক্রান্ত বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বিবৃতিতে কোথাও বলা হয়নি যে, ভারতীয় সৈন্যরা সীমান্তে আর বাংলাদেশী হত্যা করবে না। তবে কথাটা আমরা বেসরকারি ব্যক্তিরা বলতে পারি, বলেছি এবং আবারও বলছি। ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য নিয়ে তো সিপিডির গবেষকরাই বলছেন, রাজনৈতিক পর্যায়ে যে সিদ্ধান্ত হয়, ভারতীয় আমলারা সেগুলো সহজে কার্যকর করেন না। আর অভিন্ন নদীর পানি? গঙ্গার পানির হিস্যা আমরা ১৯৯৬-এর চুক্তি মোতাবেকও পাচ্ছি না। এটাই সত্যি। কিন্তু এ সত্যি কথাটা তো দূরের কথা, গঙ্গার নামটা পর্যন্ত উল্লেখ করানো যায়নি মনমোহন সিং-শেখ হাসিনা শীর্ষ বৈঠকের যৌথ বিবৃতিতে। সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে বলা হয়েছে, তিস্তা নদীর কথা। কিন্তু উলফা নেতা রাজখোয়াকে হাতে পাওয়াসহ বাংলাদেশ দিয়ে ভারত থেকে ভারতে ট্রানজিটের অঙ্গীকার নয়াদিল্লি ঠিকই আদায় করে নিয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুত্ ব্যবস্থা এবং রেল, সড়ক ও নদীপথ নিয়ন্ত্রণ করার পথেও এগিয়েছে ভারত। কিন্তু দিল্লি, কলকাতা ও মিজোরাম থেকে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার বজায় রেখেছে পুরোমাত্রায়। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তাদের পার্লামেন্টে বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর দুই দেশের সম্পর্ক উন্নতির ক্ষেত্রে একটি মাইল স্টোন স্থাপন করেছে। অবশ্য মিস্টার সিং-এর নজরে যা মাইলফলক আমাদের জন্য তা হয়ে রয়েছে টুম্ব স্টোন বা সমাধিফলক। তবে মনে হয় আমাদের জনগণ সেটা উপড়ে ফেলবে।
No comments