নাম বদলের সংস্কৃতি বন্ধ হোক by প্রফেসর ড. মোঃ আবদুল হাই তালুকদার
ব্যক্তি, বস্তু, কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা জিনিস ও মানুষের তৈরি স্থাপনার নামকরণ করতে হয়। নাম দিয়ে ব্যক্তি বা বস্তুকে পরিচিত করা হয়। নাম দেয়ার সঙ্গে ব্যক্তি, বস্তু বা স্থাপনাতে কিছু অর্থ আরোপ করা হয়। এতে শনাক্তকরণ সহজ হয় এবং যার প্রতি অর্থ আরোপ করে নাম দেয়া হয় তা বিশিষ্টতা লাভ করে, তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তি তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সামনে রেখে নাম দেন। নামটির নিজস্ব কোনো মূল্য নেই।
ধরুন আমরা যে কাগজ ও কলম দিয়ে লিখি তার নামকরণ মানবজাতিই দিয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী কাগজ-কলম নামটি বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর কাছে পরিচিত হয়ে আসছে। কেউ ডাকছে কাগজ-কলম, কেউ ডাকছে পেপার-পেন আবার কেউ ডাকছে কির্তার-কালাম নামে। ভাষার ভিন্নতার কারণে নামগুলো ভিন্ন ভিন্ন। যদি আমাদের পূর্ব পুরুষরা কাগজ-কলম না বলে খাগজ-খলম বলতেন তবে ওই নামই চালু থাকত। অর্থাত্ আমরা খাগজ-খলম বলে কাগজ-কলমকে শনাক্ত করতাম। মানুষ নিজ প্রয়োজন ও প্রত্যাশা পূরণার্থে শব্দে অর্থ আরোপ করে। অর্থ আরোপের কাজটি মানবিক। দীর্ঘদিন চালু থাকলে নামটি মানুষের মনে গেঁথে যায়। তাকে মুছে ফেলা কষ্টকর এবং এই মুছে ফেলার কাজটি কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। স্মরণীয় করে রাখার জন্য তৈরি করা জিনিসের নাম বিশেষ ব্যক্তির নামে করতে পারেন। তাতে ওই ব্যক্তির নিজের কোনো লাভ-ক্ষতি নেই। যে ব্যক্তির নামে নামকরণ করা হয় সে ব্যক্তি নিঃসন্দেহে একজন স্বনামখ্যাত বিখ্যাত ব্যক্তি। তার নাম ব্যবহার করে তার গুণগ্রাহী অনুসারীরা আত্মতৃপ্তি লাভ করেন ও সঙ্গে সঙ্গে তৈরি করা জিনিস বা স্থাপনায় মর্যাদা বৃদ্ধি পায় ও পরিচিতি বাড়ে। স্থাপনাটি যিনি বা যারা তৈরি করেন তারা অনেক ভেবেচিন্তে সুস্থ মস্তিষ্কে নাম দেন প্রিয় ও বিখ্যাত মানুষটির নামে। অনেক বছর পর নামটি হাইজ্যাক করা হলে প্রিয় মানুষটির অনুসারীরা আহত ও ব্যথিত হন। এরূপ সংবেদনশীল কাজ করে খুব বেশি লাভবান হওয়া যায় না। অনুসারীর সংখ্যা অনেক হলে তো কথাই নেই। সবাই মিলে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। অসফল হলে সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। সুযোগ এলে নামটি পুনঃস্থাপন করেন ও নাম বদলকারীদের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করেন। শুরু হয় পাল্টা-পাল্টি কর্মোদ্যোগ ও কর্মপরিকল্পনা। এরূপ কর্মোদ্যোগের ফলাফল কখনোই শুভ হতে পারে না। এ কাজ যদি সরকারের তরফ থেকে করা হয়, তার ফলাফল আরও ভয়াবহ ও অশুভ হতে বাধ্য।
একটি দেশের সরকার অবশ্যই সেই দেশের একটি ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান। গণতান্ত্রিক সরকার হলে নাম বদলের খেলা চলতেই থাকবে। এক দল নাম বদল করলে অন্য দল ক্ষমতা পেয়েই নামটি পাল্টে ফেলবে। ফলে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা হবে বিনষ্ট ও অর্থনীতিতে আসবে স্থবিরতা। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এদেশের ১৫ কোটি মানুষ যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়ে সরকার গঠন করেন। তাদের সহ্যশক্তি অপরিসীম হলেও মর্যাদাহানিকর বিষয়ে তারা খুবই সংবেদনশীল। এক্ষেত্রে তারা কখনও আপস করেন না, জীবন বাজি রেখে তারা নিজ অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন, করতে পিছপা হন না। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম বদল করে হজরত শাহজালাল করা হয়েছে। এটা যদি বিএনপিকে শিক্ষা দেয়ার জন্য করা হয় তবে কাজটিকে ভালো বলা যায় না। এদেশের অগুনতি মানুষ শহীদ জিয়াকে অন্তরের মণিকোঠায় স্থান দিয়েছেন। তাদের অন্তরে জিয়ায় ছবি জ্বলজ্বল করছে। তারা কিছুতেই এ কাজ সমর্থন করবেন না। বরং এ কাজকে তারা নিজেদের মর্যাদাহানিকর হিসেবে বিবেচনা করবে। বিভিন্ন স্থাপনা থেকে সরকার জিয়ার নাম মুছে ফেলার যে সংস্কৃতি চালু করছে, এ দেশের মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে। হজরত শাহজালালের নামে বিমানবন্দরের নামকরণ করায় কোনো কৃতিত্ব নেই। সরকার অনেক বড় বড় স্থাপনা তৈরি করতে পারে এবং সেসবে হজরত শাহজালালের নাম ফলক লাগালে তাই হতো যথোচিত ও বিবেচনাপ্রসূত কাজ। হজরত শাহজালাল একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। বিমানবন্দরের সঙ্গে তার নাম সংযুক্ত করলেই তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায় না। তিনি বেঁচে থাকলে এরূপ কাজ সমর্থন করতেন না। একজনের নাম বদলে তার নাম প্রতিস্থাপন করতে চাইলে এই বুজুর্গ পীর নিশ্চয়ই অপছন্দ করতেন। নিঃসন্দেহে তিনি বিনয়ের সঙ্গে নাম বদলের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করতেন। বিমানবন্দরের নাম শহীদ জিয়া নিজে দেননি। তার শাহাদাত বরণের পর এরশাদ সরকার নামটি দেন। এ নামকরণের পেছনে তার গুণগ্রাহী ভক্তরা জড়িত ছিলেন।
বিমানবন্দরের নামটি অবশ্যই যৌক্তিক কারণে দেয়া হয়েছিল। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রসেনানী বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার যাকে বীরোত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সবল করণে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধ এক আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার কারিগর। তিনি দেশের আপামর জনগোষ্ঠীকে ভালবেসে গ্রামীণ জনপদকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বলিয়ান করতে চেয়েছিলেন। তিনিই একমাত্র প্রেসিডেন্ট যার গায়ে মাটির সোঁদা গন্ধ পাওয়া যায়। কোনোরকম প্রটোকলের ধার না ধেরে ছুটে যান এদেশের নিভৃত পল্লীতে। শুভ সূচনা করেন খালকাটা কর্মসূচি। তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন এদেশকে সত্যিকার ব্যাঘ্রে রুপান্তরিত করতে হলে ৮৭ হাজার গ্রামীণ জনপদের উন্নতি ঘটাতে হবে। তিনি শুরু করেন গ্রামীণ সবুজ বিপ্লব। ঘোষণা করেন ১৯ দফা কর্ম পরিকল্পনা, যার প্রথমেই ছিল দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। নিজেদের আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে শুরু করেন কৃষি বিপ্লব। তার ধ্যান ও জ্ঞান ছিল কৃষি বিপ্লবই পারে এ দেশের ভূখা নাঙ্গা মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। তার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ছিল কৃষি। এতে করে গ্রামীণ তথা জাতীয় অর্থনীতিকে করতে চেয়েছেন জোরদার। দেশের সব মানুষকে করতে চেয়েছেন স্বাবলম্বী। খাদ্য, বস্ত্র, চিকিত্সা, শিক্ষা ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা দিতে চেয়েছেন সবার। এসব বাস্তবায়নে তিনি রাতদিন পরিশ্রম করে অর্থনীতির চাকাকে সচল করেন। তার স্বপ্নের বাংলাদেশে শ্রমিক মালিকের সম্পর্ক হবে মধুর ও হৃদ্যতাপূর্ণ। সরকারি চাকরিজীবীরা হবেন জনগণের সেবক, প্রভু নয়। সমাজ থেকে দুর্নীতি নামক বিষবৃক্ষকে করতে চেয়েছেন নির্বাসিত।
শহীদ জিয়া নিজে ছিলেন দুর্নীতির ঊর্ধ্বে। তাই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল সরকার ও প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা। খাঁটি দেশপ্রেমিক ও নিবেদিতপ্রাণকর্মী জিয়া কখনোই সম্পদের পেছনে ছোটেননি। নিজের বউ বাচ্চাদের ভবিষ্যত্ তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন এ দেশের গণমানুষের ওপর। দেশের মানুষও তাকে অকৃত্রিম ভালোবাসায় সিক্ত করেছিল। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তার মৃত্যুর পর। লাখো কোটি জনতা শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ও তার আত্মার মাগফিরাত কামনায় সমবেত হন মরহুমের জানাজায়। এত লোকের সমাবেশ তার প্রতি গভীর ভক্তি ও শ্রদ্ধার নিদর্শন। মৃত জিয়া হয়ে ওঠেন জীবিত জিয়ার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। জিয়ার নাম এখনও ১৫ কোটি মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছে। এ দেশের মানুষ কখনোই জিয়াকে ভুলবে না। তিনি সব ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের মানুষকে একত্রিত করেন, তাদের অধিকারকে সংরক্ষণ করে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করেন। শহীদ জিয়া চলে গেছেন, রেখে গেছেন অগুনতি অনুসারী, গুণগ্রাহী।
ব্রিটিশরা পাক-ভারত উপমহাদেশ শাসন করেছেন প্রায় দুইশ’ বছর। তারা এদেশকে নানা দিক থেকে শোষণ, লুণ্ঠন ও অত্যাচার চালিয়েছেন। এদেশের মানুষকে দুইশ’ বছর রেখেছেন অধিকার হারা, বাক স্বাধীনতাহীন। মানুষ হয়েছে অত্যাচারিত, নির্যাতিত নিগৃহীত ও পদদলিত। অবশ্য শাসকদের মধ্যে অনেকে ছিলেন উদারপন্থী, মানবতাবাদী ও মানুষের সেবক। অনেকে এদেশের মানুষের কল্যাণে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তাই বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মানুষ ওইসব মহত্প্রাণ ব্যক্তিকে ভুলে যাননি। তাদের নামের স্থাপনাগুলোর নাম এখনও রয়েছে অবিকৃত। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর পাকিস্তানি শোষক গোষ্ঠীর সব নামই পরিবর্তন করা হয়েছে। এসব নাম বদলের রয়েছে যথেষ্ট যৌক্তিকতা। নাম বদল করে এদেশের গণমানুষের কল্যাণে যারা কাজ করেছেন তাদের নামে নামকরণ করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পার্কের বিভিন্ন স্থাপনা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ইত্যাদির নাম বদলে নতুন নাম দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করেছিল তাদের নাম পাল্টানো যথোচিত কর্ম। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নাম বদল করায় নেই কোনো সার্থকতা ও যৌক্তিকতা। এরূপ কর্ম অনুচিত ও অবৌদ্ধিক। কারণ জিয়া নিজ জীবন বাজি রেখে কর্তব্যকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কখনও কোনো কারণে মানুষকে বিপদে ফেলে সরে যাননি। তাই তার নামাঙ্কিত ফলক সরিয়ে ফেলে তাকে ছোট করা যাবে না। হৃদয়ে অঙ্কিত নামফলক মোছা মানুষের সাধ্যাতীত।
বিএনপি নামক প্রতিষ্ঠানটি শহীদ জিয়ার অমর কীর্তি। এ প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি মাইলফলক ও এদেশের জাতীয়তাবাদী মানুষের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ দান। তিনি রাজনীতিকে রাহুমুক্ত করে ফিরিয়ে দেন মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা। জিয়াউর রহমান সামরিক আইন তুলে নিয়ে সত্ ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির শুভসূচনা করেন। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ পরিচিতি পায় আত্মনির্ভরশীল কর্মী জাতি হিসেবে। ওআইসি, সার্ক ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে স্থাপন করেন নিবিড় সম্পর্ক। সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা এই কর্মী পুরুষকে এ দেশের মানুষ উচ্চাসন দিয়েছে, যার প্রভাব এখনও এ দেশের রাজনীতিতে বহমান। এই ভালবাসার মানুষটির প্রাণপ্রিয় সংগঠন বিএনপি বেগম জিয়ার দক্ষ পরিচালনায় এগিয়ে যাচ্ছে। ১/১১ পরবর্তী সময়ে বিএনপি ধ্বংসের যে প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল, তাতে বিএনপির অনেক ক্ষতি হয়েছে সত্য, তবে ধ্বংস হয়নি। তাই আমার স্বনির্বন্ধ অনুরোধ, এই নাম বদলের রাজনীতি বন্ধ করুন। সেটা হবে সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রতিষ্ঠান গঠনের এবং বিকাশের সর্বোত্তম পথ। দেশের মানুষ প্রতিহিংসার রাজনীতি পছন্দ করে না। জিয়ার মতো সত্, নিষ্ঠাবান, আদর্শবান ও কর্তব্যপরায়ণ রাষ্ট্রনায়কের নাম বদল দেশের মানুষ ভালোভাবে নেবে না।
একটি দেশের সরকার অবশ্যই সেই দেশের একটি ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান। গণতান্ত্রিক সরকার হলে নাম বদলের খেলা চলতেই থাকবে। এক দল নাম বদল করলে অন্য দল ক্ষমতা পেয়েই নামটি পাল্টে ফেলবে। ফলে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা হবে বিনষ্ট ও অর্থনীতিতে আসবে স্থবিরতা। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এদেশের ১৫ কোটি মানুষ যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়ে সরকার গঠন করেন। তাদের সহ্যশক্তি অপরিসীম হলেও মর্যাদাহানিকর বিষয়ে তারা খুবই সংবেদনশীল। এক্ষেত্রে তারা কখনও আপস করেন না, জীবন বাজি রেখে তারা নিজ অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন, করতে পিছপা হন না। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম বদল করে হজরত শাহজালাল করা হয়েছে। এটা যদি বিএনপিকে শিক্ষা দেয়ার জন্য করা হয় তবে কাজটিকে ভালো বলা যায় না। এদেশের অগুনতি মানুষ শহীদ জিয়াকে অন্তরের মণিকোঠায় স্থান দিয়েছেন। তাদের অন্তরে জিয়ায় ছবি জ্বলজ্বল করছে। তারা কিছুতেই এ কাজ সমর্থন করবেন না। বরং এ কাজকে তারা নিজেদের মর্যাদাহানিকর হিসেবে বিবেচনা করবে। বিভিন্ন স্থাপনা থেকে সরকার জিয়ার নাম মুছে ফেলার যে সংস্কৃতি চালু করছে, এ দেশের মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে। হজরত শাহজালালের নামে বিমানবন্দরের নামকরণ করায় কোনো কৃতিত্ব নেই। সরকার অনেক বড় বড় স্থাপনা তৈরি করতে পারে এবং সেসবে হজরত শাহজালালের নাম ফলক লাগালে তাই হতো যথোচিত ও বিবেচনাপ্রসূত কাজ। হজরত শাহজালাল একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। বিমানবন্দরের সঙ্গে তার নাম সংযুক্ত করলেই তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায় না। তিনি বেঁচে থাকলে এরূপ কাজ সমর্থন করতেন না। একজনের নাম বদলে তার নাম প্রতিস্থাপন করতে চাইলে এই বুজুর্গ পীর নিশ্চয়ই অপছন্দ করতেন। নিঃসন্দেহে তিনি বিনয়ের সঙ্গে নাম বদলের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করতেন। বিমানবন্দরের নাম শহীদ জিয়া নিজে দেননি। তার শাহাদাত বরণের পর এরশাদ সরকার নামটি দেন। এ নামকরণের পেছনে তার গুণগ্রাহী ভক্তরা জড়িত ছিলেন।
বিমানবন্দরের নামটি অবশ্যই যৌক্তিক কারণে দেয়া হয়েছিল। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রসেনানী বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার যাকে বীরোত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সবল করণে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধ এক আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার কারিগর। তিনি দেশের আপামর জনগোষ্ঠীকে ভালবেসে গ্রামীণ জনপদকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বলিয়ান করতে চেয়েছিলেন। তিনিই একমাত্র প্রেসিডেন্ট যার গায়ে মাটির সোঁদা গন্ধ পাওয়া যায়। কোনোরকম প্রটোকলের ধার না ধেরে ছুটে যান এদেশের নিভৃত পল্লীতে। শুভ সূচনা করেন খালকাটা কর্মসূচি। তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন এদেশকে সত্যিকার ব্যাঘ্রে রুপান্তরিত করতে হলে ৮৭ হাজার গ্রামীণ জনপদের উন্নতি ঘটাতে হবে। তিনি শুরু করেন গ্রামীণ সবুজ বিপ্লব। ঘোষণা করেন ১৯ দফা কর্ম পরিকল্পনা, যার প্রথমেই ছিল দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। নিজেদের আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে শুরু করেন কৃষি বিপ্লব। তার ধ্যান ও জ্ঞান ছিল কৃষি বিপ্লবই পারে এ দেশের ভূখা নাঙ্গা মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। তার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ছিল কৃষি। এতে করে গ্রামীণ তথা জাতীয় অর্থনীতিকে করতে চেয়েছেন জোরদার। দেশের সব মানুষকে করতে চেয়েছেন স্বাবলম্বী। খাদ্য, বস্ত্র, চিকিত্সা, শিক্ষা ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা দিতে চেয়েছেন সবার। এসব বাস্তবায়নে তিনি রাতদিন পরিশ্রম করে অর্থনীতির চাকাকে সচল করেন। তার স্বপ্নের বাংলাদেশে শ্রমিক মালিকের সম্পর্ক হবে মধুর ও হৃদ্যতাপূর্ণ। সরকারি চাকরিজীবীরা হবেন জনগণের সেবক, প্রভু নয়। সমাজ থেকে দুর্নীতি নামক বিষবৃক্ষকে করতে চেয়েছেন নির্বাসিত।
শহীদ জিয়া নিজে ছিলেন দুর্নীতির ঊর্ধ্বে। তাই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল সরকার ও প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা। খাঁটি দেশপ্রেমিক ও নিবেদিতপ্রাণকর্মী জিয়া কখনোই সম্পদের পেছনে ছোটেননি। নিজের বউ বাচ্চাদের ভবিষ্যত্ তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন এ দেশের গণমানুষের ওপর। দেশের মানুষও তাকে অকৃত্রিম ভালোবাসায় সিক্ত করেছিল। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তার মৃত্যুর পর। লাখো কোটি জনতা শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ও তার আত্মার মাগফিরাত কামনায় সমবেত হন মরহুমের জানাজায়। এত লোকের সমাবেশ তার প্রতি গভীর ভক্তি ও শ্রদ্ধার নিদর্শন। মৃত জিয়া হয়ে ওঠেন জীবিত জিয়ার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। জিয়ার নাম এখনও ১৫ কোটি মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছে। এ দেশের মানুষ কখনোই জিয়াকে ভুলবে না। তিনি সব ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের মানুষকে একত্রিত করেন, তাদের অধিকারকে সংরক্ষণ করে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করেন। শহীদ জিয়া চলে গেছেন, রেখে গেছেন অগুনতি অনুসারী, গুণগ্রাহী।
ব্রিটিশরা পাক-ভারত উপমহাদেশ শাসন করেছেন প্রায় দুইশ’ বছর। তারা এদেশকে নানা দিক থেকে শোষণ, লুণ্ঠন ও অত্যাচার চালিয়েছেন। এদেশের মানুষকে দুইশ’ বছর রেখেছেন অধিকার হারা, বাক স্বাধীনতাহীন। মানুষ হয়েছে অত্যাচারিত, নির্যাতিত নিগৃহীত ও পদদলিত। অবশ্য শাসকদের মধ্যে অনেকে ছিলেন উদারপন্থী, মানবতাবাদী ও মানুষের সেবক। অনেকে এদেশের মানুষের কল্যাণে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তাই বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মানুষ ওইসব মহত্প্রাণ ব্যক্তিকে ভুলে যাননি। তাদের নামের স্থাপনাগুলোর নাম এখনও রয়েছে অবিকৃত। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর পাকিস্তানি শোষক গোষ্ঠীর সব নামই পরিবর্তন করা হয়েছে। এসব নাম বদলের রয়েছে যথেষ্ট যৌক্তিকতা। নাম বদল করে এদেশের গণমানুষের কল্যাণে যারা কাজ করেছেন তাদের নামে নামকরণ করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পার্কের বিভিন্ন স্থাপনা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ইত্যাদির নাম বদলে নতুন নাম দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করেছিল তাদের নাম পাল্টানো যথোচিত কর্ম। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নাম বদল করায় নেই কোনো সার্থকতা ও যৌক্তিকতা। এরূপ কর্ম অনুচিত ও অবৌদ্ধিক। কারণ জিয়া নিজ জীবন বাজি রেখে কর্তব্যকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কখনও কোনো কারণে মানুষকে বিপদে ফেলে সরে যাননি। তাই তার নামাঙ্কিত ফলক সরিয়ে ফেলে তাকে ছোট করা যাবে না। হৃদয়ে অঙ্কিত নামফলক মোছা মানুষের সাধ্যাতীত।
বিএনপি নামক প্রতিষ্ঠানটি শহীদ জিয়ার অমর কীর্তি। এ প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি মাইলফলক ও এদেশের জাতীয়তাবাদী মানুষের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ দান। তিনি রাজনীতিকে রাহুমুক্ত করে ফিরিয়ে দেন মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা। জিয়াউর রহমান সামরিক আইন তুলে নিয়ে সত্ ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির শুভসূচনা করেন। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ পরিচিতি পায় আত্মনির্ভরশীল কর্মী জাতি হিসেবে। ওআইসি, সার্ক ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে স্থাপন করেন নিবিড় সম্পর্ক। সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা এই কর্মী পুরুষকে এ দেশের মানুষ উচ্চাসন দিয়েছে, যার প্রভাব এখনও এ দেশের রাজনীতিতে বহমান। এই ভালবাসার মানুষটির প্রাণপ্রিয় সংগঠন বিএনপি বেগম জিয়ার দক্ষ পরিচালনায় এগিয়ে যাচ্ছে। ১/১১ পরবর্তী সময়ে বিএনপি ধ্বংসের যে প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল, তাতে বিএনপির অনেক ক্ষতি হয়েছে সত্য, তবে ধ্বংস হয়নি। তাই আমার স্বনির্বন্ধ অনুরোধ, এই নাম বদলের রাজনীতি বন্ধ করুন। সেটা হবে সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রতিষ্ঠান গঠনের এবং বিকাশের সর্বোত্তম পথ। দেশের মানুষ প্রতিহিংসার রাজনীতি পছন্দ করে না। জিয়ার মতো সত্, নিষ্ঠাবান, আদর্শবান ও কর্তব্যপরায়ণ রাষ্ট্রনায়কের নাম বদল দেশের মানুষ ভালোভাবে নেবে না।
No comments