মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-অপপ্রচারে লিপ্ত বিদেশে থাকা দুই 'যুদ্ধাপরাধী' by আশরাফ-উল-আলম

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পর্কে দেশ-বিদেশে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি এবং ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজে বাধা সৃষ্টি করতে উঠেপড়ে লেগেছেন বিদেশে অবস্থানরত দুজন চিহ্নিত 'যুদ্ধাপরাধী'। তাঁদের একজন হলেন আশরাফুজ্জামান খান, আরেকজন চৌধুরী মাঈনুদ্দিন।


প্রথমজন থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে, দ্বিতীয়জন যুক্তরাজ্যে। তাঁরা দুজনই বিপুল অর্থবিত্তের মালিক। জানা গেছে, প্রচুর টাকা ঢেলে তাঁরা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচাল করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে অপপ্রচারসহ নানা ধরনের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ কাজে তাঁরা কজন বিদেশি আইনজীবীসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংগঠনকে মাঠে নামিয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে তথ্য-প্রমাণ মিলেছে। আরো জানা গেছে, তাঁদের হাত করা ব্যক্তিরা বিভিন্ন দেশ সফর করে বাংলাদেশে চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছেন। ইন্টারনেট এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও এ-সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি জানতে পেরে খোঁজখবর নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
বিশেষ করে আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে বলে যখন খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তখন এসব অপতৎপরতা আরো বেড়ে গেছে। শিগগিরই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন জানানো হবে বলে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ওই দুজনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে বসবাসরত আশরাফুজ্জামান খান ইসলামিক সার্কেল অব নর্থ আমেরিকার (আইসিএনএ) প্রধান। তিনি একাত্তরে ইসলামী ছাত্রসংঘের (পরে ইসলামী ছাত্রশিবির) কেন্দ্রীয় সদস্য ও আলবদরের শীর্ষস্থানীয় সদস্য ছিলেন। ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনে আশরাফুজ্জামান খানকে আলবদর বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। স্বাধীনতার পর তিনি পাকিস্তানে চলে যান এবং কিছুদিন রেডিও পাকিস্তানে কাজ করেন। একাত্তরের শেষ দিকে ঢাকায় আশরাফুজ্জামান খানের ৩৫০ নাখালপাড়ার বাড়িতে পাওয়া ব্যক্তিগত ডায়েরিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তার নাম লেখা ছিল। তাঁদের সবাইকে একাত্তরে হত্যা করা হয়।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, আলবদরের আরেক কুখ্যাত কমান্ডার চৌধুরী মাঈনুদ্দিন একাত্তরে ঢাকায় অনেক বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে হত্যা-নির্যাতনের অন্যতম খলনায়ক। তিনি জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন, পূর্বদেশ পত্রিকায় কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেন। মাঈনুদ্দিন এখন পূর্ব লন্ডন মসজিদের ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্রিটিশ সাহায্য সংস্থা মুসলিম এইডের প্রধান কর্মকর্তা। এ সংগঠনের বার্ষিক বাজেট ২০ মিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি।
ট্রাইব্যুনালের মামলাসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আশরাফুজ্জামান ও মাঈনুদ্দিনের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার, সেলিনা পারভীন, সিরাজুদ্দিন হোসেনসহ অনেক বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ রয়েছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী একাত্তরের ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল রূপকার। তাঁর পরিকল্পনা ও নির্দেশে আশরাফুজ্জামান ও মাঈনুদ্দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ দুজনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে লাশ রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে ফেলে দেওয়া হয়।
দেশবাসী যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে উৎসাহিত করছে, ঠিক তখনই এই বিচার নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলা শুরু হয় একটি মহলের পক্ষ থেকে। এ দেশে আনা হয় বিদেশি কয়েকজন আইনজীবীকে। তাঁরা সভা-সেমিনারে অংশ নিয়ে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অভিযোগ আছে, এসব আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের এ দেশে আনেন আশরাফুজ্জামান ও মাঈনুদ্দিন।
ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন ঘটছে বলে ইতিমধ্যে অভিযোগ করেছেন। গত ১৯ জুলাই ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে টম ল্যানটস হিউম্যান রাইটস কমিশনে শুনানিকালে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে টবি ক্যাডম্যান ওই অভিযোগ তোলেন। তিনি জানিয়েছেন, এই ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন করা উচিত কি না তা নির্ধারণে নিরপেক্ষ তদন্ত চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। তাঁর ভাষায় 'অব্যাহতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী সরকার'-এর প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখা হবে কি না তা নতুন করে মূল্যায়ন করার জন্য দাতা দেশগুলোর প্রতিও আহ্বান জানান তাঁর লিখিত বক্তব্যে। তিনি তাঁর বক্তব্যে আরো বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার ধারণাটি ভালো। তবে যাঁরা শুধু স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের বিচারের আওতায় আনা ঠিক নয়। তিনি পাকিস্তানি নির্যাতনকারীদের বিচারের কথা বলেছেন।
এর আগে টবি ক্যাডম্যান বাংলাদেশে এসেছিলেন দুইবার। তখন তিনি জামায়াত সমর্থিত দুটি সংগঠনের সেমিনারে অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেন। গত বছর ৫ আগস্ট তিনি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভ্রমণ ভিসা নিয়ে আসেন। কিন্তু বিমানবন্দরে নেমে দাম্ভিকতার সঙ্গে পরিচয় দেন, তিনি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে আইনি লড়াই করতে ঢাকায় এসেছেন। তখন ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাঁকে জানিয়ে দেয়, আইনি লড়াই করতে হলে ওয়ার্ক পারমিট ভিসা নিয়ে ঢুকতে হবে। এরপর তাঁকে ফেরত পাঠানো হয়। জানা গেছে, টবি ক্যাডম্যান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে মানুষকে নেতিবাচক ধারণা দিতে ও এ-সংক্রান্ত প্রচারণা চালাতে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করছেন। গত বছর ৩ অক্টোবর রাতে তিনি ব্রিটেনে জামায়াতে ইসলামীর একটি সমাবেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। ১৬ নভেম্বর তিনি নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে তাঁর হোটেল স্যুটে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করে বলেন, বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত করেছে। শুধু রাজনৈতিক কারণে কিছু লোকের বিচার করা হচ্ছে এই ট্রাইব্যুনালে। টবি ক্যাডম্যান গত ২২ মার্চ আবার যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনে, ২৪ মার্চ কানেকটিকাটের একটি সেমিনারে, ২৫ মার্চ জ্যামাইকার কমিউনিটি লিডারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং ২৬ মার্চ ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদের কাছে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন তোলেন। এ-সংক্রান্ত খবরাখবর দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
আরো খবর পাওয়া গেছে, টবি ক্যাডম্যানের পাশাপাশি ব্রিটিশ আইনজীবী স্টিভেন কে কিউসি ও জন কেমেস এ ধরনের প্রচারণা চালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের তিনজনকেই বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী হিসেবে নিয়োগের জন্য বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে আবেদন করা হয়। কিন্তু সেই আবেদন অগ্রাহ্য করা হয়। এই স্টিভেন ২০১০ সালের ১৩ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত একটি সেমিনারে নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিরপেক্ষ নয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, উভয় পক্ষের সম্মতিতে ট্রাইব্যুনালের বিচারক নিয়োগ করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার অভিযুক্তদের মতামত না নিয়েই বিচারক নিয়োগ করেছে। ট্রাইব্যুনাল গঠনে সংবিধানের মূলনীতি ব্যাহত হচ্ছে বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন।
২০১১ সালের ১৯ মে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আমেরিকান সোসাইটি অব ইন্টারন্যাশনাল ল সদর দপ্তরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিষয়ে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় ব্রিটিশ আইনজীবী জন কেমেস বলেন, বাংলাদেশে কিছু সংখ্যক বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য অভিযুক্ত করে তাঁদের বিচারের নামে বড় ধরনের প্রহসনের আয়োজন করা হয়েছে। এ বিচার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০১১ সালের ১৮ মে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক চিঠি লিখে জানায়, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের পছন্দমতো আইনজীবী নিয়োগ দিতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ট্রানজিশনাল জাস্টিস আইনমন্ত্রীকে চিঠি লিখে বলেন, ট্রাইব্যুনালে এমন সুবিধা থাকা উচিত, কোনো আদেশে আসামিরা ক্ষুব্ধ হলে সেটা রিভিউ করা যাবে। কিন্তু সেটা ট্রাইব্যুনালে নেই।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, বিদেশি কয়েকজন আইনজীবী অর্থের বিনিময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্তদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করতে এসেছিলেন; কিন্তু অনুমতি পাননি। তাঁরা এ দেশে ও অন্যান্য দেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে অযথা প্রশ্ন উত্থাপন করছেন। ওই সব আইনজীবীর অর্থের জোগান জামায়াতে ইসলামী দিচ্ছে, এটা নিশ্চিত। তিনি আরো বলেন, অভিযুক্ত আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দিনও আইনজীবীদের অর্থ দিচ্ছেন বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.