পেশাদার খুনীরা হত্যা করেছে ডা. নিতাইকে!- ৪ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ ॥ খুনীদের দ্রুত গ্রেফতারের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর by গাফফার খান চৌধুরী
চিকিৎসকদের কেন্দ্রীয় নেতা ডা. নারায়ণ চন্দ্র দত্ত নিতাই পরিকল্পিত হত্যাকা-ের শিকার হতে পারেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুনীদের দ্রুত গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছেন। হত্যাকা- ও ছুরিকাঘাতের ধরন পরিকল্পিত হত্যাকা-ের পূর্বাভাস দেয় বলে জানালেন ডা. নিতাইয়ের এক সহকর্মী চিকিৎসক।
পেশাদার খুনীরা ঘটনাটি ঘটিয়ে থাকতে পারে। খুনীদের ডা. নিতাইয়ের দ্বিতীয় তলার অবস্থান জানার বিষয়টি রীতিমতো রহস্যের জন্ম দিয়েছে। আগাম তথ্যের ভিত্তিতেই ডা. নিতাইয়ের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই খুনীরা দ্বিতীয় তলায় গিয়ে ঘটনাটি ঘটায়। বাড়ির সামনে মাত্র ৪ ফুট উঁচু দেয়াল টপকে না গিয়ে পেছনের অন্তত ১০ ফুট দেয়াল ডিঙ্গিয়ে চোর বা ডাকাতদের প্রবেশের বিষয়টি রীতিমতো রহস্যের জন্ম দিয়েছে। স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ছাড়াও রাজনৈতিক কোন্দলের সুযোগ নিয়েও কোন সুযোগ সন্ধানী পক্ষ পরিকল্পিতভাবে এমন হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটাতে পারে। সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে মামলা সংশ্লিষ্টরা অনেকটাই নিশ্চিত হত্যাকা-টি পূর্বপরিকল্পিত। হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ৪ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকা- সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ডা. নিতাইকে অন্যত্র বদলি করা হয়। ওই সময় তিনি জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ডা. নিতাই জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের এ্যাসপাইরেটরি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন। বছরখানেক আগে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক হন। বদলি করা হয় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে যোগদান না করার কারণে ডেপুটেশনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কার্যালয়ে (ডিজি অফিস) বদলি করা হয়। সেখান থেকে ডেপুটেশনেই তাঁকে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নিয়োগ দেয়া হয়।
এদিকে জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে যোগদানের পর থেকেই তিনি ওই বাড়িতে বসবাস করছিলেন। এদিকে ডা. নিতাই চন্দ্রের আমল থেকেই হাসপাতালটিতে নিয়োগসহ নানা বিষয়াদি নিয়ে জটিলতা চলে আসছিল। হাসপাতালের চিকিৎসক নেতাদের মধ্যে দুটি গ্রুপ রয়েছে। শুধু গ্রুপ নয় গ্রুপ দুটির মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে দীর্ঘ দিন ধরেই। কোন্দল কোন সময়ই প্রকাশ্য রূপ লাভ করেনি। তবে ভেতরে ভেতরে এখনও যথেষ্ট গ্রুপিং রয়েছে। সেই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগ নিয়ে তৃতীয় কোন স্বার্থান্বেষী পক্ষ বুধবার রাত সোয়া ৩টায় রাজধানীর বনানী থানাধীন মহাখালী জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সরকারী বাসভবনে ডা. নিতাই হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটাতে পারে।
ডা. নিতাই থাকতেন ৫২ নম্বর ভবনের ওয়াই/২ নম্বর ডুপ্লেক্স বাড়িটিতে। বাড়িটির সামনে মাত্র ৪ ফুট উঁচু দেয়াল। রয়েছে সমান উচ্চতার গ্রিলের পর পর দুটি ফটক। একটি ফটক দিয়ে মানুষজন যাতায়াত করেন। আরেকটি দিয়ে গাড়ি যাতায়াত করে। রয়েছে গাড়ি রাখার গ্যারেজ। বাম দিকে ও পেছনে প্রায় ১০ ফুট উঁচু দেয়াল। দেয়ালের ওপর কাঁটাতারের বেড়া। পুরো এলাকা জঙ্গলে ভর্তি। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো দাঁড়িয়ে আছে। তবে আলো দেয় না। তাই সারাক্ষণই ঘুটঘুটে অন্ধকার।
বাড়িটির নিচতলার বারান্দা শক্ত গ্রিল দিয়ে ঘেরা। ঘরে ঢুকতেই বিশাল হলরুম। হলরুমের বামদিকের পাশে একটি শয়নকক্ষ। এই শয়ন কক্ষেই ছিলেন ডা. নিতাইয়ের মা মঞ্জু রানী দত্ত। ঘরের ভেতর দিয়ে দু’তলায় যাওয়ার সিঁড়ি। বাইরে থেকে দু’তলা বা ছাদে ওঠার কোন রাস্তা নেই।
পাশের ৫৩ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. আকতার হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, তার বাড়ি ভোলা জেলার তজুমুদ্দিন থানাধীন এলাকায়। তিনি বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস ডিগ্রী অর্জন করেছেন। তিনি এ বাসায় রয়েছেন প্রায় একবছর। ঘটনার রাতে তিনি বাসার দু’তলায় ছিলেন। তিনি আমাশয়ে ভুগছিলেন। বার বার বাথরুমে যাওয়ার কারণে ঘুমাতে দেরি হচ্ছিল। বিছানায় শুয়ে থেকেও রাত প্রায় ৩টা পর্যন্ত সজাগ ছিলেন। রাত সোয়া ৩ থেকে পৌনে ৪টার মধ্যে কোন এক সময় তাদের বাসার দেড়শ’ গজ দূরে অবস্থিত ডা. মাসুম তাঁকে ফোন দেন। তার কাছেই ডা. নিতাই খুনের বিষয়টি জানতে পারেন। পরবর্তীতে ডা. নিতাইয়ের মায়ের সঙ্গে কথা হয় তার। নিতাইয়ের মায়ের বরাত দিয়ে তিনি আরও জানান, নিতাইয়ের মা আমাদের ডেকেছেন। কিন্তু আমরা দু’তলায় থাকায় ভাল করে শোনা যায়নি। এরপর নিতাইয়ের মা দৌড়ে ডাক্তার মাসুমের বাসায় যান। মাসুম তার সহপাঠী বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে একসঙ্গে পড়াশুনা করেছেন। মাসুমের বাসায় নিচ তলায় গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করলে মাসুম বেরিয়ে আসে। এরপর মাসুম ও ডা. নিতাইয়ের মা দু’জন বাসায় ফেরেন। ইতোমধ্যেই তিনিও সেখানে হাজির হন। দেখা যায় বাড়ির সামনের সিঁড়ির কাছে ডা. নিতাই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। তার গলায় লুঙ্গি পেঁচানো। সারাশরীরে রক্ত। এ সময় নিতাইয়ের মা দু’তলায় ডাকাত রয়েছে বলে চিৎকার করছিলেন।
দ্রুত তাকে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালে নেয়ার আগেই সম্ভবত ডা. নিতাই স্বর্গীয় হন। হাসপাতালে দেখা গেছে, ডা. নিতাইয়ের ঘাড়ে, পাঁজরে ও পেট ও বুকের মাঝ বরাবর গভীর ক্ষত। ক্ষত দেখে ধারণা করা যায়, এটি কোন চোর বা ডাকাতদের কাজ নয়। ছুরিকাঘাতের চিহ্ন দেখে ধারণা করা যায়, পেশাদার খুনীরা হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটাতে পারে। তবে ঠিক কি কারণে বা কি উদ্দেশ্যে তাকে হত্যা করা হতে পারে তা নিশ্চিত নয়। এ সম্পর্কে তার কোন ধারণাও নেই। তিনি আরও বলেন, এমনও হতে পারে খুনীরা তাকে প্রথমে শ্বাসরোধ করে হত্যার চেষ্টা করতে পারে। তাতে ব্যর্থ হয়ে ঘাড়ে ধারাল ছুরি দিয়ে আঘাত করে। এরপর দ্বিতীয় দফায় পাঁজরে আঘাত করতে পারে। এছাড়া বুক ও পেটের মাঝ বরাবর যে গভীর ক্ষত রয়েছে তা দেখে ধারণা করা যায়, ডা. নিতাইয়ের মৃত্যু নিশ্চিত করতেই খুনীরা শেষবারের মতো বুকে আঘাত করতে পারে। তবে ডা. নিতাই খুবই শক্তিশালী ও তেজি প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি অতীত স্মৃতি হাতড়ে বলেন, অস্ত্রের মুখে চোর বা ডাকাতদের বাধা দেয়ার মতো নির্বোধ ব্যক্তি তিনি ছিলেন না। কারণ একবছর আগে ডা. নিতাই তাঁর এক বন্ধু ডাক্তারের সঙ্গে রাতে মোহাম্মদপুর যাচ্ছিলেন। ওই সময় তাঁরা ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। ডা. নিতাই নিজের সঙ্গে থাকা সব মাল ছিনতাইকারীদের হাতে বিনা বাক্য ব্যয়ে তুলে দিয়ে তার বন্ধুকেও সঙ্গে থাকা মাল দিয়ে দেয়ার পরামর্শ দেন। এ ঘটনাটি ডা. নিতাই তাঁকে বলেছিলেন। কারণ সামান্য জিনিসের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। এছাড়া ডা. নিতাই নিঃসন্তান ছিলেন। এ কারণে নিজের জীবন বিপন্ন করে স্বর্ণালঙ্কার সামাল দেয়ার মতো নির্বোধ কাজ তিনি করতে পারেন বলে মনে হয় না।
ডা. আকতার আরও জানান, চোর বা ডাকাত বাড়িতে নিচতলা দিয়ে প্রবেশ না করে সরাসরি দু’তলায় প্রবেশ করার বিষয়টি বেশ রহস্যজনক। দুর্বৃত্তরা কি করে নিশ্চিত হলো ডা. নিতাই দু’তলায়ই রয়েছেন ? এতে স্পষ্ট বুঝা যায়, আগাম তথ্যের মাধ্যমে ডাক্তার নিতাইকে হত্যা করতে খুনীরা সরাসরি দু’তলায় গিয়ে হাজির হয়। নিতাইয়ের চিৎকারে নিচতলা থেকে নিতাইয়ের মা ওপরে যান। দরজায় ধাক্কাধাক্কি করতে থাকেন। এ সময় খুনীরা খুব সম্ভবত নিতাইকে বুকে শেষ আঘাত করে পালিয়ে যায়। নিতাই কোনমতে ঘরের ছিটকিনি খুলেন। এরপর মাকে ধরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন। মা ডা. নিতাইকে বাইরের মেঝেতে রেখে লোকজন ডাকতে যান। এদিকে ঘটনার পর পরই পুলিশ, র্যাব, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও সিআইডির উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত প্রয়োজনীয় আলামতের পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। এদিকে ডা. নিতাই খুনের প্রতিবাদে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এক ঘণ্টা কর্মবিরতি পালিত হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, নিয়োগ, অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানা বিষয়ের জের ধরে হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটতে পারে। তবে ডা. নিতাইকে হুমকি প্রদান বা নিয়োগ জটিলতা সম্পর্কে কোন কিছুই জানা নেই বলে সাংবাদিকদের জানান, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. বশির আহমেদ। তবে গত ১ আগস্ট তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী পদে ৫৫ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এরমধ্যে ডা. নারায়ণের ভাই গৌতম ও গৌতমের স্ত্রীও রয়েছেন। এদিকে হাসপাতালকেন্দ্রিক রাজনীতিতে কোন অভ্যন্তরীণ কোন্দল ছিল না বলে জনকণ্ঠের কাছে দাবি করেছেন জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. বরকতউল্লাহ। তবে তিনি জনকণ্ঠের কাছে দাবি করেছেন, যেসব কর্মচারী সম্প্রতি নিয়োগ পেয়েছেন ওইসব কর্মচারী ডা. নিতাই চন্দ্রের আমলেই নিয়োগ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে তা আর হয়ে উঠেনি। তিনি হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও জানান।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ জোনের উপ-কমিশনার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, ডা. নিতাই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে কালাম ও মাসুমসহ ৪ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তবে জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকা- সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ডা. নিতাইকে অন্যত্র বদলি করা হয়। ওই সময় তিনি জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ডা. নিতাই জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের এ্যাসপাইরেটরি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন। বছরখানেক আগে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক হন। বদলি করা হয় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে যোগদান না করার কারণে ডেপুটেশনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কার্যালয়ে (ডিজি অফিস) বদলি করা হয়। সেখান থেকে ডেপুটেশনেই তাঁকে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নিয়োগ দেয়া হয়।
এদিকে জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে যোগদানের পর থেকেই তিনি ওই বাড়িতে বসবাস করছিলেন। এদিকে ডা. নিতাই চন্দ্রের আমল থেকেই হাসপাতালটিতে নিয়োগসহ নানা বিষয়াদি নিয়ে জটিলতা চলে আসছিল। হাসপাতালের চিকিৎসক নেতাদের মধ্যে দুটি গ্রুপ রয়েছে। শুধু গ্রুপ নয় গ্রুপ দুটির মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে দীর্ঘ দিন ধরেই। কোন্দল কোন সময়ই প্রকাশ্য রূপ লাভ করেনি। তবে ভেতরে ভেতরে এখনও যথেষ্ট গ্রুপিং রয়েছে। সেই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগ নিয়ে তৃতীয় কোন স্বার্থান্বেষী পক্ষ বুধবার রাত সোয়া ৩টায় রাজধানীর বনানী থানাধীন মহাখালী জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সরকারী বাসভবনে ডা. নিতাই হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটাতে পারে।
ডা. নিতাই থাকতেন ৫২ নম্বর ভবনের ওয়াই/২ নম্বর ডুপ্লেক্স বাড়িটিতে। বাড়িটির সামনে মাত্র ৪ ফুট উঁচু দেয়াল। রয়েছে সমান উচ্চতার গ্রিলের পর পর দুটি ফটক। একটি ফটক দিয়ে মানুষজন যাতায়াত করেন। আরেকটি দিয়ে গাড়ি যাতায়াত করে। রয়েছে গাড়ি রাখার গ্যারেজ। বাম দিকে ও পেছনে প্রায় ১০ ফুট উঁচু দেয়াল। দেয়ালের ওপর কাঁটাতারের বেড়া। পুরো এলাকা জঙ্গলে ভর্তি। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো দাঁড়িয়ে আছে। তবে আলো দেয় না। তাই সারাক্ষণই ঘুটঘুটে অন্ধকার।
বাড়িটির নিচতলার বারান্দা শক্ত গ্রিল দিয়ে ঘেরা। ঘরে ঢুকতেই বিশাল হলরুম। হলরুমের বামদিকের পাশে একটি শয়নকক্ষ। এই শয়ন কক্ষেই ছিলেন ডা. নিতাইয়ের মা মঞ্জু রানী দত্ত। ঘরের ভেতর দিয়ে দু’তলায় যাওয়ার সিঁড়ি। বাইরে থেকে দু’তলা বা ছাদে ওঠার কোন রাস্তা নেই।
পাশের ৫৩ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. আকতার হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, তার বাড়ি ভোলা জেলার তজুমুদ্দিন থানাধীন এলাকায়। তিনি বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস ডিগ্রী অর্জন করেছেন। তিনি এ বাসায় রয়েছেন প্রায় একবছর। ঘটনার রাতে তিনি বাসার দু’তলায় ছিলেন। তিনি আমাশয়ে ভুগছিলেন। বার বার বাথরুমে যাওয়ার কারণে ঘুমাতে দেরি হচ্ছিল। বিছানায় শুয়ে থেকেও রাত প্রায় ৩টা পর্যন্ত সজাগ ছিলেন। রাত সোয়া ৩ থেকে পৌনে ৪টার মধ্যে কোন এক সময় তাদের বাসার দেড়শ’ গজ দূরে অবস্থিত ডা. মাসুম তাঁকে ফোন দেন। তার কাছেই ডা. নিতাই খুনের বিষয়টি জানতে পারেন। পরবর্তীতে ডা. নিতাইয়ের মায়ের সঙ্গে কথা হয় তার। নিতাইয়ের মায়ের বরাত দিয়ে তিনি আরও জানান, নিতাইয়ের মা আমাদের ডেকেছেন। কিন্তু আমরা দু’তলায় থাকায় ভাল করে শোনা যায়নি। এরপর নিতাইয়ের মা দৌড়ে ডাক্তার মাসুমের বাসায় যান। মাসুম তার সহপাঠী বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে একসঙ্গে পড়াশুনা করেছেন। মাসুমের বাসায় নিচ তলায় গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করলে মাসুম বেরিয়ে আসে। এরপর মাসুম ও ডা. নিতাইয়ের মা দু’জন বাসায় ফেরেন। ইতোমধ্যেই তিনিও সেখানে হাজির হন। দেখা যায় বাড়ির সামনের সিঁড়ির কাছে ডা. নিতাই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। তার গলায় লুঙ্গি পেঁচানো। সারাশরীরে রক্ত। এ সময় নিতাইয়ের মা দু’তলায় ডাকাত রয়েছে বলে চিৎকার করছিলেন।
দ্রুত তাকে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালে নেয়ার আগেই সম্ভবত ডা. নিতাই স্বর্গীয় হন। হাসপাতালে দেখা গেছে, ডা. নিতাইয়ের ঘাড়ে, পাঁজরে ও পেট ও বুকের মাঝ বরাবর গভীর ক্ষত। ক্ষত দেখে ধারণা করা যায়, এটি কোন চোর বা ডাকাতদের কাজ নয়। ছুরিকাঘাতের চিহ্ন দেখে ধারণা করা যায়, পেশাদার খুনীরা হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটাতে পারে। তবে ঠিক কি কারণে বা কি উদ্দেশ্যে তাকে হত্যা করা হতে পারে তা নিশ্চিত নয়। এ সম্পর্কে তার কোন ধারণাও নেই। তিনি আরও বলেন, এমনও হতে পারে খুনীরা তাকে প্রথমে শ্বাসরোধ করে হত্যার চেষ্টা করতে পারে। তাতে ব্যর্থ হয়ে ঘাড়ে ধারাল ছুরি দিয়ে আঘাত করে। এরপর দ্বিতীয় দফায় পাঁজরে আঘাত করতে পারে। এছাড়া বুক ও পেটের মাঝ বরাবর যে গভীর ক্ষত রয়েছে তা দেখে ধারণা করা যায়, ডা. নিতাইয়ের মৃত্যু নিশ্চিত করতেই খুনীরা শেষবারের মতো বুকে আঘাত করতে পারে। তবে ডা. নিতাই খুবই শক্তিশালী ও তেজি প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি অতীত স্মৃতি হাতড়ে বলেন, অস্ত্রের মুখে চোর বা ডাকাতদের বাধা দেয়ার মতো নির্বোধ ব্যক্তি তিনি ছিলেন না। কারণ একবছর আগে ডা. নিতাই তাঁর এক বন্ধু ডাক্তারের সঙ্গে রাতে মোহাম্মদপুর যাচ্ছিলেন। ওই সময় তাঁরা ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। ডা. নিতাই নিজের সঙ্গে থাকা সব মাল ছিনতাইকারীদের হাতে বিনা বাক্য ব্যয়ে তুলে দিয়ে তার বন্ধুকেও সঙ্গে থাকা মাল দিয়ে দেয়ার পরামর্শ দেন। এ ঘটনাটি ডা. নিতাই তাঁকে বলেছিলেন। কারণ সামান্য জিনিসের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। এছাড়া ডা. নিতাই নিঃসন্তান ছিলেন। এ কারণে নিজের জীবন বিপন্ন করে স্বর্ণালঙ্কার সামাল দেয়ার মতো নির্বোধ কাজ তিনি করতে পারেন বলে মনে হয় না।
ডা. আকতার আরও জানান, চোর বা ডাকাত বাড়িতে নিচতলা দিয়ে প্রবেশ না করে সরাসরি দু’তলায় প্রবেশ করার বিষয়টি বেশ রহস্যজনক। দুর্বৃত্তরা কি করে নিশ্চিত হলো ডা. নিতাই দু’তলায়ই রয়েছেন ? এতে স্পষ্ট বুঝা যায়, আগাম তথ্যের মাধ্যমে ডাক্তার নিতাইকে হত্যা করতে খুনীরা সরাসরি দু’তলায় গিয়ে হাজির হয়। নিতাইয়ের চিৎকারে নিচতলা থেকে নিতাইয়ের মা ওপরে যান। দরজায় ধাক্কাধাক্কি করতে থাকেন। এ সময় খুনীরা খুব সম্ভবত নিতাইকে বুকে শেষ আঘাত করে পালিয়ে যায়। নিতাই কোনমতে ঘরের ছিটকিনি খুলেন। এরপর মাকে ধরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন। মা ডা. নিতাইকে বাইরের মেঝেতে রেখে লোকজন ডাকতে যান। এদিকে ঘটনার পর পরই পুলিশ, র্যাব, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও সিআইডির উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত প্রয়োজনীয় আলামতের পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। এদিকে ডা. নিতাই খুনের প্রতিবাদে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এক ঘণ্টা কর্মবিরতি পালিত হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, নিয়োগ, অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানা বিষয়ের জের ধরে হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটতে পারে। তবে ডা. নিতাইকে হুমকি প্রদান বা নিয়োগ জটিলতা সম্পর্কে কোন কিছুই জানা নেই বলে সাংবাদিকদের জানান, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. বশির আহমেদ। তবে গত ১ আগস্ট তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী পদে ৫৫ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এরমধ্যে ডা. নারায়ণের ভাই গৌতম ও গৌতমের স্ত্রীও রয়েছেন। এদিকে হাসপাতালকেন্দ্রিক রাজনীতিতে কোন অভ্যন্তরীণ কোন্দল ছিল না বলে জনকণ্ঠের কাছে দাবি করেছেন জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. বরকতউল্লাহ। তবে তিনি জনকণ্ঠের কাছে দাবি করেছেন, যেসব কর্মচারী সম্প্রতি নিয়োগ পেয়েছেন ওইসব কর্মচারী ডা. নিতাই চন্দ্রের আমলেই নিয়োগ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে তা আর হয়ে উঠেনি। তিনি হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও জানান।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ জোনের উপ-কমিশনার মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, ডা. নিতাই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে কালাম ও মাসুমসহ ৪ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তবে জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকা- সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
No comments