জাতীয় উন্নয়ন ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় by জাতীয় উন্নয়ন ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় by ফজলুল হক সৈকত
বিশ্ববিদ্যালয় নামক উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি গবেষণার দায়িত্ব পালন করে থাকে; বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশও অগ্রসর হচ্ছে এ ধরনের গবেষণা ও উন্নয়নমূলক চিন্তাধারায়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দরকারি বিষয়গুলো সম্বন্ধে পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং উন্নয়নের সুপারিশমালা প্রণয়ন করছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী।
এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ধাপগুলো অতিক্রম করতে যে নিরীক্ষা ও পদক্ষেপ গ্রহণের দরকার তা নির্ধারণ করতে সহায়তা করে থাকে অ্যাকাডেমিক গবেষণার বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ। বাংলাদেশে যে প্রতিষ্ঠানটির কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল, জাতীয় পরিস্থিতি ও অগ্রগতি বিষয়ে পরামর্শমালা তৈরি করবার, তার কার্যক্রম একেবারে হতাশাব্যঞ্জক পর্যায়ে পড়ে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নাম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। মূল চিন্তা ও কাজের জায়গাটিতে আজও পৌঁছতে পারেনি এর অ্যাকাডেমিক ও গবেষণার ক্ষেত্রগুলো।
প্রসঙ্গত, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক গ্রুপবিন্যাস করা হয়েছে এভাবে : গ্রুপ ক—ভাষা, মানবিকবিদ্যা, সামাজিক বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও ব্যবসা প্রশাসন এবং শিক্ষা; গ্রুপ খ—প্রকৃতি বিজ্ঞান, গাণিতিক বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, কম্পিউটার ও প্রযুক্তি বিজ্ঞান এবং আইন। দুঃখের বিষয়, আইনের নির্দেশনা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল ও কেন্দ্রগুলো দায়িত্ব পালন করতে কিংবা বলা যায় কর্মসূচি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে।
শুরুর কথা হলো, ভাষা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি এখনও কোনো কাজ আরম্ভ করতে পারেনি। অথচ, বাংলা ভাষার আভিজাত্য, বাঙালির ভাষাবোধ সারা দুনিয়ায় প্রশংসিত। আমার মনে হয়, আমাদের ভাষার ইতিহাস, ভাষা-পরিক্রমা, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভাষার প্রয়োগবিধি, ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, ভাষা সংরক্ষণে পদক্ষেপ গ্রহণ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষাকে মর্যাদা প্রদানসহ পৃথিবীর যাবতীয় ভাষাবিষয়ক তথ্য-উপাত্ত ও পরিস্থিতি সম্বন্ধে গবেষণা এবং অ্যাকাডেমিক লেখাপড়া নিশ্চিত করতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারত। তবে হয়নি বলে যে আর হবে না—এমন চিন্তায় আমি বিশ্বাসী নই; কাজেই কাজগুলো শুরু করতে পারে এই বিদ্যাপীঠ। অনুরূপভাবে অবহেলিত রয়েছে মানবিক বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞানের পাঠ ও গবেষণার জায়গাগুলো। আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি, মানবিক চিন্তাবিকাশের স্তরবিন্যাস এবং ললিতকলার চর্চার যে প্রয়োজন মানুষ অনুভব করে, তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করলে, আমরা হয়তো পেয়ে যেতাম অনেক অনেক প্রত্যাশিত পরামর্শ বা দিকনির্দেশনা; আবার ব্যক্তি-পরিবার-রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিরাজমান সামাজিক জটিলতা নির্ধারণ এবং উত্তরণের জন্যও তৈরি হতে পারতো কিছু নীতিমালা। কিন্তু কেবল উদ্যোগ গ্রহণের ইচ্ছার অভাবে আর কর্তাব্যক্তিদের অদূরদর্শিতা, ও দক্ষতার অভাবে জাতি বঞ্চিত হচ্ছে কিছু নাগরিক সুবিধা ও অধিকার থেকে।
আমরা জানি, জাতির ভাগ্য পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে ব্যবসায় সম্পর্কিত চিন্তা ভাবনা। অর্থনৈতিক জটিলতা নিরূপণ এবং তার প্রাসঙ্গিকতা পর্যালোচনা, কৃষিপরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও উন্নয়নের ধাপনির্মাণ, কৃষিজাত পণ্যের মূল্য নির্ধারণ ও বাজারজাতকরণ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন যে কতটা জরুরি, তা অনুধাবন করা যায় প্রতিদিনের দ্রব্যমূল্যবিষয়ক খবরাদির দিকে নজর রাখলে। উত্পাদন ও বিপণন নীতিমালার এক ভয়াবহ সঙ্কটের মধ্যে ডুবে আছে বাংলাদেশের বাণিজ্য পরিসর। অন্যদিকে, ব্যবসাপ্রশাসন শিক্ষা বিষয়ে জেঁকে বসেছে ভূতের বাড়ির অন্ধকার। হাজার হাজার মানুষকে ব্যবসাপ্রশাসনে [বিবিএ/এমবিএ প্রভৃতি] শিক্ষিত করে তোলার পেছনে যে রাষ্ট্রীয় কোনো পরিকল্পনা নেই, তা বুঝতে পারা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠকার্যক্রম আর চাকরি বাজার পরিস্থিতিতে চোখ রাখলে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আরও অনেক প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে ব্যবসাপ্রশাসনকে এতটা গুরুত্ব দেয়ার কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার গবেষণা কর্মের আওতার মধ্যে থেকে মানবসম্পদ তৈরি ও ব্যবহার নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি ব্যবসাপ্রশাসনবিষয়ক শিক্ষাকে পরিমিতিদানের পরামর্শ প্রদান করে রাষ্ট্রকে সহায়তা করতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, কেবল শিক্ষার্থীকে শ্রেণীকক্ষে বসিয়ে পাঠদান করাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নয়; কাদেরকে পড়াতে হবে, কেন পড়াতে হবে, কতটা পড়ানো যায়—এসব বিষয় ঠিক করে তবেই পাঠদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বিশ্ববিদ্যালয়। আবার তাদের অর্জিত চিন্তার ফসল কেবল নির্দিষ্ট কর্মপরিসরের মধ্যে আবদ্ধও রাখবে না; ছড়িয়ে দেবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে।
অন্যদিকে, শিক্ষাব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষাপরিকল্পনার দিক থেকে আমরা অতিমাত্রায় পিছিয়ে আছি। সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বরূপ ও প্রকৃতি পর্যালোচনা করে, শিক্ষার পরিবেশ এবং কাঠামো ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সুপারিশমালা প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করতে পারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। নির্ধারিত অ্যাকাডেমিক কাজের পাশাপাশি গবেষণাকর্মের অংশ হিসেবে এটি হবে অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যেহেতু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাকাঠামো উচ্চশিক্ষার ভিত তৈরি করে, তাই সব পূর্বস্তরের [বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের আগের স্তরসমূহ] শিক্ষাপরিস্থিতি পর্যালোচনা করা এ প্রতিষ্ঠানটির অবশ্য কর্তব্য বলে বিবেচিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।
সচেতন মানুষমাত্রেই অবগত আছেন, প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব নিয়ে এখন বিস্তর কথাবার্তা হচ্ছে দুনিয়াজুড়ে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার আসন্ন প্রভাব বিষয়েও কথা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহলে। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংশ্লিষ্ট গবেষণাগারগুলো দিনরাত কাজ করে চলছে। আমি মনে করি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তার কর্মপরিধির মধ্যে অবস্থান করেও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃতি বিজ্ঞান, গণিত, জীববিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং বিজ্ঞানকর্মীদের কাজে লাগিয়ে প্রাসঙ্গিক আবিষ্কারে অবদান রাখতে পারে। উদ্ভিদ এবং প্রাণিবিষয়ক বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব তৈরির জন্য প্রত্যাশিত পদক্ষেপ গ্রহণ বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একটি অতি জরুরি প্রসঙ্গ। জীবজন্তু এবং মত্স্য সম্পদ উন্নয়ন সম্পর্কে তৈরী করতে পাবে নতুন নতুন পরিকল্পনা। এছাড়া খাদ্য-পুষ্টি-স্বাস্থ্য সম্পর্কিত চিন্তায়ও সহযোগিতা করতে পারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ইউনিট। মোদ্দাকথা হলো—জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নয়নে ব্যাপক পরিসরে ভূমিকা পালন করতে পারে বাংলাদেশের সর্ববৃহত্ শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আর জনবল নিয়োগ করে নতুন এক অভিযাত্রা শুরু করতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। সময় অনেক পেরিয়ে গেছে; আর বিলম্ব না করে, বাংলাদেশে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করতে পারে তার এতদিনের না করা কিংবা খাতার আড়ালে পড়ে থাকা কাজগুলো। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির জন্য আধুনিক সুবিধা সংবলিত একাধিক ল্যাবরেটরি স্থাপন অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাজীপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে প্রধান গ্রন্থাগার ও ল্যাবরেটরি স্থাপন করে সহযোগী বা শাখা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের অন্যান্য স্থানে, বিজ্ঞানশিক্ষার জন্য নির্বাচিত বিশেষ বিদ্যাপীঠে সমপ্রসারিত হতে পারে কার্যক্রম। এছাড়া কম্পিউটার ও প্রযুক্তি সুবিধা কীভাবে জাতীয় অগ্রগতিতে সহায়তা করতে পারে, সে বিষয়েও দায়িত্ব পালন করতে পারে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি।
বর্তমানে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গ হলো, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা। অগণন মানুষের কাছে আইনের শিক্ষা পৌঁছে দেয়া এক অসম্ভব ব্যাপার। আবার জনগোষ্ঠীকে অবগত না করে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাও কঠিন। আর সে কারণে আইনের প্রচলিত অবস্থা, আইন সেবা পরিস্থিতি, আইনের প্রয়োগ প্রভৃতি বিষয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা হতে পারে, হতে পারে জনমুখী প্রচার-ব্যবস্থার প্রবর্তন। আর অনায়াসে সে কাজের দায়িত্ব নিতে পারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সারাদেশের অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাছাই করে নির্বাচিত কেন্দ্রকে ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা যায় প্রচারমূলক কার্যক্রম; আর এভাবে জনগণের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া সম্ভব আইনবিষয়ক সাধারণ ও অতিপ্রয়োজনীয় ধারণা। কেবল আইন বিষয়ে পড়াশোনার জন্য পাঠক্রম আর অধিভুক্ত কিছু আইন কলেজে এ চিন্তার ক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ না রেখে জাতির বৃহত্ চাহিদাকে বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করতে হবে প্রাসঙ্গিক কর্মপরিকল্পনা।
জাতিকে কোটি কোটি নিরক্ষর-অসহায় মানুষকে জিম্মি করে অনেক রাজনীতি তো আমরা করেছি; করে চলেছি। পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আর নিজের প্রশংসার গীত গাইতে গাইতে আমরা দক্ষ অভিনেতার আসনগুলো এক এক করে অধিকার করে ফেলেছি। সামনে এগিয়েছে আমাদের লোভের গাড়ি—সবার চোখে ধুলো দিয়ে। আর পেছনে পড়ে আছে ভোটার নামক মানুষ; তাদের চিরচেনা হাততোলা-মাথানত করা ভঙ্গি আমাদের কখনও ভাবিয়ে তোলেনি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন! চারিদিকে ঘনিয়ে আসা অমানিশা দেখে আমরা বোধ হয় অনুধাবন করতে পারছি যে, ভোটকে, খ্যাতিকে, টাকাকে টার্গেট না করে মানুষকে তাদের শিক্ষা-চিকিত্সা-শান্তি এবং অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তির বিষয়কে ধর্তব্যের মধ্যে আনতে হবে— কালবিলম্ব না করে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং আহ্বায়ক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।
No comments