গণপ্রশাসনে অস্থিরতা সৃষ্টি কার স্বার্থে? by সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা
রাষ্ট্রযন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো গণপ্রশাসন। যে দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা যত গতিশীল, সে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানও ততই গতিশীল। তাই সভ্যজগতের প্রতিটি দেশেই বিশেষ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মেধাবীদের গণপ্রশাসন পরিচালনার জন্য নিয়োজিত করা হয়। একই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশেও পিএসসির মাধ্যমে বিসিএস পরীক্ষা গ্রহণ করে চৌকস ও যোগ্য লোক বাছাই করে প্রশাসনে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে।
প্রার্থী নির্বাচনে যোগ্যতাকেই মানদণ্ড হিসাবে বিবেচনা করা হয়। দল-মত-পথ-আদর্শ এসব বিবেচনা করা হয় না। করা উচিতও নয়। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব চিন্তা-দর্শন-আদর্শ অবশ্যই আছে, থাকবে এবং এটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মানবিক অধিকার। এ অধিকার থেকে কেউ তাকে বঞ্চিত করতে পারে না। কেউ যখন গণপ্রশাসন তথা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসাবে নিয়োগ পান তখন তার ব্যক্তিগত চিন্তাচেতনা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। আর এটিই হচ্ছে প্রেক্ষাপটের দাবি। তিনি হয়ে ওঠেন নিছক প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, প্রজাতন্ত্রের স্বার্থই তার ধ্যান ও জ্ঞানে পরিণত হয়। তিনি আর দলবাজি, আদর্শবাজি করতে পারেন না, করা উচিতও নয়। আর এর ব্যত্যয় ঘটলেই গণপ্রশাসনে নেমে আসে অস্থিরতা। গণমুখী প্রশাসন হয়ে ওঠে গণবিরোধী।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী রাজনৈতিক আদর্শ থাকে সুপ্ত-মুক্ত বিহঙ্গের মতো উন্মুক্ত নয়। তাই একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীকে সব দল, মত, পথ ও আদর্শের ঊর্ধ্বে ওঠে শুধু প্রজাতন্ত্রের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই দায়িত্ব পালন করতে হয়। স্মর্তব্য যে, কোন দেশেই গণপ্রশাসনেই রাজনীতির গন্ধ নেই। নিকট অতীতে আমাদের দেশেও ছিল না। তবে গণপ্রশাসনে রাজনীতি বিষয়টি বিশেষ একটি রাজনৈতিক দল আমদানি করেছে। প্রশাসনে এমন দুষ্ট প্রবণতার সূচনা হয় ১৯৯৬ সালে কথিত জনতার মঞ্চের নামে। সে সময়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন চলাকালে এক শ্রেণীর অতি উত্সাহী আমলা তাদের হীন রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা চরিতার্থ ও সরকারবিরোধী আন্দোলনের পালে হাওয়া দেয়ার জন্য এমন অপকর্মটি করেছিলেন, যা ছিল সরকারি চাকরি বিধির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আইনের দৃষ্টিতে তা রীতিমতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চের মাধ্যমে যে আমলা বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল তা আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রকে অনেকখানি দুর্বল করে ফেলেছিল। যারা এ আমলা বিদ্রোহের নেপথ্যের কুশীলব ছিলেন তারা অবশ্য পরবর্তীকালে ক্ষমতায় এসেছিলেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ১৯৯৬ সালের আমলা বিদ্রোহ সফলই হয়েছিল। আমলারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বিধায় তাদের কোনো রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ ছিল না। তাই পরবর্তী সরকারের সময় এসব বিদ্রোহী আমলাদের বিচার হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের পুরস্কৃত করে আমলা বিদ্রোহকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিয়েছে। বিদ্রোহী জনতার মঞ্চের আমলারা নানাভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন। এমনকি এদের মধ্যে একজন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সাংবিধান পদ, নির্বাচন কমিশনারের পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন।
এবারও ডিজিটাল কারচুপির মাধ্যমে জনতার মঞ্চের বেনিফিশিয়ারিরা ক্ষমতায় এসেছে। বিগত ৪ দলীয় সরকারের সময়ে গণপ্রশাসনে কোনোরকম দলবাজি ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় এসে গণপ্রশাসনকে বহুধাবিভক্ত করার জন্য অপতত্পরতা শুরু করে দিয়েছে। ১৯৯৬ সালে যেসব আমলা জনতার মঞ্চে যায়নি তাদের সবাইকে তারা সন্দেহের চোখে দেখছে। যেসব আমলা আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত তাদেরই প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বসানো হচ্ছে। আর যারা ১৯৯৬ সাল পরবর্তী সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন তাদের ব্যাপারে জনতার মঞ্চের নায়কদের কাছেই সুপারিশ গ্রহণ করা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে জনতার মঞ্চের কুশীলবরা রীতিমত বাণিজ্যিক তত্পরতা শুরু করে দিয়েছেন। তাদের সুপারিশ ছাড়া কারও ভালো কোনো পদায়ন হচ্ছে না বা কোনো পদোন্নতিও পাওয়া যাচ্ছে না। আর টাকা ছাড়া তো সুপারিশের প্রশ্নই আসে না। ফলে জনপ্রশাসনে সীমাহীন বিশৃংখলা দেখা দিয়েছে।
বস্তুত যেসব আমলা সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না, তাদেরই আওয়ামী লীগ সরকার প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করছে। কিন্তু তারা একবারও মনে করছেন না যে, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের দলীয় সদস্য নন বরং রাষ্ট্রের কর্মচারী। তাদের যথাযথভাবে নিরপেক্ষতা অনুসরণ করেই এই মহান দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু সরকার এসব আপ্তবাক্য মানতে একেবারেই নারাজ। যেসব কর্মকর্তা সরকারের গৃহভৃত্যের মতো আচরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন, তারাই সরকারের রোষানলে পড়ছেন। তাদের পদোন্নতি বঞ্চিত করা হচ্ছে। গণহারে করা হচ্ছে ওএসডি, অপরপক্ষে সরকারের সেবাদাস কর্মকর্তাদের পদোন্নতিসহ অতিগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত করা হচ্ছে। জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত তথ্য জ্ঞাত হওয়া গেছে যে, আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসনে দলবাজির কারণে ১১শ’ চৌকস ও যোগ্যতর কর্মকর্তাকে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করেছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে ওএসডি করা হয়েছে ৮৪০ জনকে। অপরদিকে জনতার মঞ্চের ৭০ জন কর্মকর্তাকে অতিগুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। আওয়ামী আদর্শে বিশ্বাসী ১৫০ জনকে অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে, যা গণপ্রশাসনে অস্থিরতা ও অসন্তুষ্টি সৃষ্টি করেছে।
সরকার এখানেই থেমে থাকেনি। এবার তারা প্রশাসনে কথিত স্বাধীনতাবিরোধী তালাশ করা শুরু করেছে। গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে নাকি এরই মধ্যে তারা ১১৭ জনের একটা তালিকাও প্রস্তুত করে ফেলেছেন। আর এ তালিকা নাকি আমাদের দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো করেনি। কারণ বর্তমান সরকার দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থার ওপর খুব একটা আস্থাশীল নয়। তাই তারা প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে এই তালিকা প্রণয়ন করেছেন। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, গোয়েন্দা সংস্থাটি একটি বিশেষ মানদণ্ডে এই তালিকা প্রণয়ন করেছে। যেসব কর্মকর্তা ধর্মপ্রাণ, নিয়মিত নামাজ-রোজাসহ ধর্মচর্চা করেন, যাদের মুখে দাড়ি আছে, তাদেরই স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকর্তা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। এছাড়াও জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যাদের দূরতম আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে তাদেরও এই ১১৭ জনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে যারা প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন না এমনসব কর্মকর্তাদেরও স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকর্তার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এমনকি ১৯৭৫/৭৬ সালে জন্ম এমন তিনজন কর্মকর্তাকেও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
২০০৯ সালের পিলখানা ট্রাজেডি এবং বর্তমানে গণশুদ্ধি অভিযান একই সূত্রে গাঁথা। ভারত পিলখানা ট্রাজেডির মাধ্যমে একঢিলে দুই পাখি মেরেছে। এর মাধ্যমে তারা আমাদের সুরক্ষিত সীমান্তকে অরক্ষিত করেছে এবং বিপুলসংখ্যক সেনা কর্মকর্তার প্রাণহানি আমাদের দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অনেকখানি দুর্বল করে দিয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার এ অভাবনীয় সাফল্য তাদের আরও অতি উত্সাহী করে তুলেছে। তারা এখন আমাদের দেশের সুশৃংখল প্রশাসন ব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে চায়। আর উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিনিয়ত সরকারের কান ভারি করছে। তারা পরামর্শ দিচ্ছে যে, যদি প্রশাসন ব্যবস্থায় শুদ্ধি না করা যায় তাহলে যে কোনো মুহূর্তে সরকারের পতন হতে পারে। তাই একান্ত দাসানুদাস দিয়েই প্রশাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এর মাধ্যমে তারা আমাদের গণপ্রশাসনকে বহুধাবিভক্ত করে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করতে চায়। প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দেশে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধের কুমন্ত্রণা দিচ্ছে সরকারকে। তাদের ধারণা, দেশে নিয়মতান্ত্রিক ইসলামী রাজনীতির পথ যদি বন্ধ করা যায় তাহলে তারা সহিংস পথ বেছে নেবে। আর জঙ্গিবাদ দমনের অজুহাতে তারা এদেশে আস্তানা গাড়তে সক্ষম হবে।
এর মধ্যে আওয়ামী বিভীষণরাও বেশ সক্রিয় রয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের যেসব নেতা মন্ত্রিত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তারা শেখ হাসিনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রেখেছেন। তারা নিজেদের নেত্রীর একান্ত আস্তাভাজন ও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে জাহির করছেন। আর ভেতরে ভেতরে সরকারকে ব্যর্থ ও গণবিচ্ছিন্ন করার জন্য কুমন্ত্রণা দিচ্ছে। আসলে তারা সরকারকে ব্যর্থ করতে চায়। তারা সরকারে থাকবেন না, আর সরকার দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করবে তা তো হতে পারে না। আওয়ামী লীগের এসব বিভীষণের খুব একটা অভাব নেই। এসব বিভীষণই স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো অবিসংবাদিত নেতাকে বিভ্রান্ত করেছিলেন, আর শেখ হাসিনা তো আর কী?
সরকার ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলছে। মূলত আওয়ামী লীগ সরকার তাদের বাম মিত্রদের খপ্পরে পড়েছে। এসব বামরাই শেখ মুজিবকে বিভ্রান্ত করে বাকশাল কায়েমে প্ররোচিত করেছিল। ফল ভালো হয়নি। এর জন্য শেখ মুজিবকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। আর জামায়াত-শিবির নির্মূল ও গণপ্রশাসনে কথিত শুদ্ধি অভিযানের পেছনেও এসব রামপন্থী বামদের হাত রয়েছে। যারা প্রতিনিয়ত সরকারকে বিভ্রান্ত করছেন। তারা ভাবছে, জনগণতো তাদের কখনই ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠাবে না, তাই আওয়ামী লীগের ঘাড়ে সওয়ার হয়েই তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ইসলামী রাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠাতে চায়। সরকার কথিত শুদ্ধি অভিযানের নামে প্রশাসনে যে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে তা কারও জন্যই কল্যাণকর হবে না। সরকারকে মনে রাখতে হচ্ছে, রাষ্ট্রের প্রধান চালিকাশক্তিই হচ্ছে গণপ্রশাসন। এর মধ্যে দলবাজি ঢুকানো, ভিন্নমতাবলম্বীর তালাশ করা নিছক আহাম্মকি বৈ কিছু নয়। ক্ষমতা কারও স্থায়ী নয়। তাই সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের কথা বাদ দিয়ে দেশের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। শুধু যোগ্যতার মানদণ্ডে প্রশাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। দলবাজি না করে সত্ ও যোগ্যতর লোককে যথাযথ দায়িত্ব প্রদানের মাধ্যমেই একটি গতিশীল প্রশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সরকার বোধহয় এসব কথা কানে তুলবে না। কিন্তু দেশের মানুষের প্রশ্ন—গণপ্রশাসনে অস্থিরতা কার স্বার্থে?
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী রাজনৈতিক আদর্শ থাকে সুপ্ত-মুক্ত বিহঙ্গের মতো উন্মুক্ত নয়। তাই একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীকে সব দল, মত, পথ ও আদর্শের ঊর্ধ্বে ওঠে শুধু প্রজাতন্ত্রের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই দায়িত্ব পালন করতে হয়। স্মর্তব্য যে, কোন দেশেই গণপ্রশাসনেই রাজনীতির গন্ধ নেই। নিকট অতীতে আমাদের দেশেও ছিল না। তবে গণপ্রশাসনে রাজনীতি বিষয়টি বিশেষ একটি রাজনৈতিক দল আমদানি করেছে। প্রশাসনে এমন দুষ্ট প্রবণতার সূচনা হয় ১৯৯৬ সালে কথিত জনতার মঞ্চের নামে। সে সময়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন চলাকালে এক শ্রেণীর অতি উত্সাহী আমলা তাদের হীন রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা চরিতার্থ ও সরকারবিরোধী আন্দোলনের পালে হাওয়া দেয়ার জন্য এমন অপকর্মটি করেছিলেন, যা ছিল সরকারি চাকরি বিধির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আইনের দৃষ্টিতে তা রীতিমতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চের মাধ্যমে যে আমলা বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল তা আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রকে অনেকখানি দুর্বল করে ফেলেছিল। যারা এ আমলা বিদ্রোহের নেপথ্যের কুশীলব ছিলেন তারা অবশ্য পরবর্তীকালে ক্ষমতায় এসেছিলেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ১৯৯৬ সালের আমলা বিদ্রোহ সফলই হয়েছিল। আমলারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বিধায় তাদের কোনো রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ ছিল না। তাই পরবর্তী সরকারের সময় এসব বিদ্রোহী আমলাদের বিচার হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের পুরস্কৃত করে আমলা বিদ্রোহকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিয়েছে। বিদ্রোহী জনতার মঞ্চের আমলারা নানাভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন। এমনকি এদের মধ্যে একজন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সাংবিধান পদ, নির্বাচন কমিশনারের পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন।
এবারও ডিজিটাল কারচুপির মাধ্যমে জনতার মঞ্চের বেনিফিশিয়ারিরা ক্ষমতায় এসেছে। বিগত ৪ দলীয় সরকারের সময়ে গণপ্রশাসনে কোনোরকম দলবাজি ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় এসে গণপ্রশাসনকে বহুধাবিভক্ত করার জন্য অপতত্পরতা শুরু করে দিয়েছে। ১৯৯৬ সালে যেসব আমলা জনতার মঞ্চে যায়নি তাদের সবাইকে তারা সন্দেহের চোখে দেখছে। যেসব আমলা আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত তাদেরই প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বসানো হচ্ছে। আর যারা ১৯৯৬ সাল পরবর্তী সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন তাদের ব্যাপারে জনতার মঞ্চের নায়কদের কাছেই সুপারিশ গ্রহণ করা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে জনতার মঞ্চের কুশীলবরা রীতিমত বাণিজ্যিক তত্পরতা শুরু করে দিয়েছেন। তাদের সুপারিশ ছাড়া কারও ভালো কোনো পদায়ন হচ্ছে না বা কোনো পদোন্নতিও পাওয়া যাচ্ছে না। আর টাকা ছাড়া তো সুপারিশের প্রশ্নই আসে না। ফলে জনপ্রশাসনে সীমাহীন বিশৃংখলা দেখা দিয়েছে।
বস্তুত যেসব আমলা সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না, তাদেরই আওয়ামী লীগ সরকার প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করছে। কিন্তু তারা একবারও মনে করছেন না যে, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের দলীয় সদস্য নন বরং রাষ্ট্রের কর্মচারী। তাদের যথাযথভাবে নিরপেক্ষতা অনুসরণ করেই এই মহান দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু সরকার এসব আপ্তবাক্য মানতে একেবারেই নারাজ। যেসব কর্মকর্তা সরকারের গৃহভৃত্যের মতো আচরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন, তারাই সরকারের রোষানলে পড়ছেন। তাদের পদোন্নতি বঞ্চিত করা হচ্ছে। গণহারে করা হচ্ছে ওএসডি, অপরপক্ষে সরকারের সেবাদাস কর্মকর্তাদের পদোন্নতিসহ অতিগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত করা হচ্ছে। জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত তথ্য জ্ঞাত হওয়া গেছে যে, আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসনে দলবাজির কারণে ১১শ’ চৌকস ও যোগ্যতর কর্মকর্তাকে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করেছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে ওএসডি করা হয়েছে ৮৪০ জনকে। অপরদিকে জনতার মঞ্চের ৭০ জন কর্মকর্তাকে অতিগুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। আওয়ামী আদর্শে বিশ্বাসী ১৫০ জনকে অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে, যা গণপ্রশাসনে অস্থিরতা ও অসন্তুষ্টি সৃষ্টি করেছে।
সরকার এখানেই থেমে থাকেনি। এবার তারা প্রশাসনে কথিত স্বাধীনতাবিরোধী তালাশ করা শুরু করেছে। গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে নাকি এরই মধ্যে তারা ১১৭ জনের একটা তালিকাও প্রস্তুত করে ফেলেছেন। আর এ তালিকা নাকি আমাদের দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো করেনি। কারণ বর্তমান সরকার দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থার ওপর খুব একটা আস্থাশীল নয়। তাই তারা প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে এই তালিকা প্রণয়ন করেছেন। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, গোয়েন্দা সংস্থাটি একটি বিশেষ মানদণ্ডে এই তালিকা প্রণয়ন করেছে। যেসব কর্মকর্তা ধর্মপ্রাণ, নিয়মিত নামাজ-রোজাসহ ধর্মচর্চা করেন, যাদের মুখে দাড়ি আছে, তাদেরই স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকর্তা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। এছাড়াও জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যাদের দূরতম আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে তাদেরও এই ১১৭ জনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে যারা প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন না এমনসব কর্মকর্তাদেরও স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকর্তার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এমনকি ১৯৭৫/৭৬ সালে জন্ম এমন তিনজন কর্মকর্তাকেও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
২০০৯ সালের পিলখানা ট্রাজেডি এবং বর্তমানে গণশুদ্ধি অভিযান একই সূত্রে গাঁথা। ভারত পিলখানা ট্রাজেডির মাধ্যমে একঢিলে দুই পাখি মেরেছে। এর মাধ্যমে তারা আমাদের সুরক্ষিত সীমান্তকে অরক্ষিত করেছে এবং বিপুলসংখ্যক সেনা কর্মকর্তার প্রাণহানি আমাদের দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অনেকখানি দুর্বল করে দিয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার এ অভাবনীয় সাফল্য তাদের আরও অতি উত্সাহী করে তুলেছে। তারা এখন আমাদের দেশের সুশৃংখল প্রশাসন ব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে চায়। আর উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিনিয়ত সরকারের কান ভারি করছে। তারা পরামর্শ দিচ্ছে যে, যদি প্রশাসন ব্যবস্থায় শুদ্ধি না করা যায় তাহলে যে কোনো মুহূর্তে সরকারের পতন হতে পারে। তাই একান্ত দাসানুদাস দিয়েই প্রশাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এর মাধ্যমে তারা আমাদের গণপ্রশাসনকে বহুধাবিভক্ত করে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করতে চায়। প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দেশে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধের কুমন্ত্রণা দিচ্ছে সরকারকে। তাদের ধারণা, দেশে নিয়মতান্ত্রিক ইসলামী রাজনীতির পথ যদি বন্ধ করা যায় তাহলে তারা সহিংস পথ বেছে নেবে। আর জঙ্গিবাদ দমনের অজুহাতে তারা এদেশে আস্তানা গাড়তে সক্ষম হবে।
এর মধ্যে আওয়ামী বিভীষণরাও বেশ সক্রিয় রয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের যেসব নেতা মন্ত্রিত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তারা শেখ হাসিনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রেখেছেন। তারা নিজেদের নেত্রীর একান্ত আস্তাভাজন ও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে জাহির করছেন। আর ভেতরে ভেতরে সরকারকে ব্যর্থ ও গণবিচ্ছিন্ন করার জন্য কুমন্ত্রণা দিচ্ছে। আসলে তারা সরকারকে ব্যর্থ করতে চায়। তারা সরকারে থাকবেন না, আর সরকার দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করবে তা তো হতে পারে না। আওয়ামী লীগের এসব বিভীষণের খুব একটা অভাব নেই। এসব বিভীষণই স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো অবিসংবাদিত নেতাকে বিভ্রান্ত করেছিলেন, আর শেখ হাসিনা তো আর কী?
সরকার ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলছে। মূলত আওয়ামী লীগ সরকার তাদের বাম মিত্রদের খপ্পরে পড়েছে। এসব বামরাই শেখ মুজিবকে বিভ্রান্ত করে বাকশাল কায়েমে প্ররোচিত করেছিল। ফল ভালো হয়নি। এর জন্য শেখ মুজিবকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। আর জামায়াত-শিবির নির্মূল ও গণপ্রশাসনে কথিত শুদ্ধি অভিযানের পেছনেও এসব রামপন্থী বামদের হাত রয়েছে। যারা প্রতিনিয়ত সরকারকে বিভ্রান্ত করছেন। তারা ভাবছে, জনগণতো তাদের কখনই ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠাবে না, তাই আওয়ামী লীগের ঘাড়ে সওয়ার হয়েই তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ইসলামী রাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠাতে চায়। সরকার কথিত শুদ্ধি অভিযানের নামে প্রশাসনে যে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে তা কারও জন্যই কল্যাণকর হবে না। সরকারকে মনে রাখতে হচ্ছে, রাষ্ট্রের প্রধান চালিকাশক্তিই হচ্ছে গণপ্রশাসন। এর মধ্যে দলবাজি ঢুকানো, ভিন্নমতাবলম্বীর তালাশ করা নিছক আহাম্মকি বৈ কিছু নয়। ক্ষমতা কারও স্থায়ী নয়। তাই সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের কথা বাদ দিয়ে দেশের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। শুধু যোগ্যতার মানদণ্ডে প্রশাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। দলবাজি না করে সত্ ও যোগ্যতর লোককে যথাযথ দায়িত্ব প্রদানের মাধ্যমেই একটি গতিশীল প্রশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সরকার বোধহয় এসব কথা কানে তুলবে না। কিন্তু দেশের মানুষের প্রশ্ন—গণপ্রশাসনে অস্থিরতা কার স্বার্থে?
No comments