সাত মাসেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি লক্ষ্যমাত্রার প্রায় দ্বিগুণঃ অর্থনীতির জন্য সুখবর নয়
ক্ষমতাসীনদের মুখে প্রতিদিনই সাফল্যের কথা শোনা গেলেও দেশের অর্থনীতির খবর যে খুব ভালো নয়, সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। খাদ্যসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিনিয়োগ বন্ধ্যত্বের মতোই সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে রেকর্ড সৃষ্টিও সেটাই প্রমাণ করে। বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেই। স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির ফলে মানুষের আয় বেড়ে গেলে এমনটা হলে কথা ছিল না।
উদ্বেগের খবর হচ্ছে, উত্পাদন খাত বিশেষ করে শিল্প উত্পাদনে দীর্ঘমেয়াদি আমানত বিনিয়োগ করতে না পারায় ব্যাংক আমানতে সুদের হার কমে যাওয়াই এর প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। ফলে জমানো টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুবিধা সাধারণ মধ্যবিত্তের হাত থেকে চলে যাচ্ছে উচ্চবিত্ত ও ব্যবসায়ীদের হাতে। বিপদ বাড়ছে সাধারণ সঞ্চয়ীদের।
অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি স্থবির হয়ে পড়ায় ব্যাংকগুলোতে অলস টাকা জমে ওঠার খবর বেশ কিছুদিন থেকেই শোনা যাচ্ছে। বিনিয়োগ করতে না পারায় কোনো ব্যাংকই এখন আর নতুন করে আমানত নিতে আগ্রহী হচ্ছে না। একই কারণে ব্যাংক আমানতের সুদের হার কমে ৬-৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকেই। এক শতাংশ হারে আয়কর কেটে রাখাও শুরু হয়েছে। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রে মুনাফা পাওয়া যায় সাড়ে ১২ শতাংশ হারে। আয়কর দেয়ার ঝামেলা নেই। এখানে বিনিয়োগে কোনো ঝুঁকিও নেই। মধ্যবিত্ত, বিশেষ করে চাকরিজীবী, শিক্ষক, ক্ষুদে ব্যবসায়ীসহ পেশাজীবীদের সঞ্চয়ে টেনে আনার জন্যই এমনটা করা হয়েছে। এ স্তরের নারী-পুরুষের মধ্যে সঞ্চয়পত্র কেনা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এখন অধিক মুনাফা আর নিরাপদ হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিত্তবানরাও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে ঝুঁকে পড়েছে। এমনকি ব্যাংকিং খাত থেকে ব্যবসায়ীরাও বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে এখানে বিনিয়োগ করছে। শুধু ব্যক্তি নয়, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিনিয়োগের খবরও জানা গেছে। ফলে চলতি অর্থবছরে ৩ হাজার ২৭৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও প্রথম সাত মাসেই ৫ হাজার ৭৫০ কোটি টাকারও বেশি অর্থাত্ প্রায় দ্বিগুণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়ে গেছে। গত মাসেও ৬০০ কোটি টাকার মতো সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র ধারণা করছেন।
সঞ্চয়পত্র বিক্রির ক্ষেত্রে সঠিক নীতিমালা না থাকার ফলেই এমনটা ঘটছে বলে ধরে নেয়া যায়। নিম্নমধ্যবিত্ত ও সাধারণ পেশাজীবীসহ সীমিত আয়ের বিপুলসংখ্যক মানুষই নিজেদের দুঃসময়ের কথা চিন্তা করে জমানো অর্থ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে। অবসরপ্রাপ্তরাও পেনশনের টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনে থাকেন। সাধারণ গৃহবধূদের মধ্যেও এর জনপ্রিয়তা কম নয়। এখান থেকে প্রাপ্ত মাসিক লভ্যাংশ তুলেই অনেকে সন্তানদের লেখাপড়া ও সংসার খরচ নির্বাহ করেন। বর্তমানে সৃষ্ট অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এখন বিত্তবান এমনকি ব্যবসায়ীরাও এখানে ভিড় জমিয়েছেন। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সঞ্চয়পত্র কেনাই এর প্রমাণ। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের মাত্রাতিরিক্ত প্রবৃদ্ধির আর কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। এর পেছনে কাজ করছে দেশের অর্থনৈতিক স্থবিরতা বা বিনিয়োগ বন্ধ্যত্ব। তবে সরকারের জন্য এটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো হয়ে উঠেছে। এখন ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের বদলে সঞ্চয়পত্র, ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রির টাকা দিয়েই সে প্রয়োজন মিটছে। তবে অর্থনীতির জন্য একে মোটেই সুখবর বলা যাবে না।
বিষয়টির অস্বাভাবিকতা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়ায়নি বলেই বাংলাদেশ ব্যাংক এর মধ্যেই সঞ্চয়পত্রের সুদের হার পুনর্বিন্যাস করার পদক্ষেপ নিয়েছে। এজন্য গঠিত কমিটির রিপোর্টের ওপরই এখন সবকিছু নির্ভর করছে। যদি পরিস্থিতি সামাল দিতে অন্য কিছু না করে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে দেয়া হয় তবে সেটা হবে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের সঞ্চয়ীদের ওপর আঘাতস্বরূপ। সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের বিবেচনা থেকে বিষয়টি এড়িয়ে যাবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আয়-ব্যয়ের ফারাক বৃদ্ধি, বেকারত্ব প্রভৃতি কারণে মানুষের হিমশিম খাওয়ার দশা। তার ওপর যদি সঞ্চয়পত্রের সুবিধায় হাত পড়ে তবে সেটা অনেকের জন্যই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতোই হয়ে উঠবে।
No comments