বাইশের লাল ঘোড়াঃ ১ by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
‘বাইশের লাল ঘোড়া’ আমার প্রিয় কবি আবিদ আনোয়ারের একটি কবিতার শিরোনাম। কবিতাটির প্রথম স্তরের শেষ দুটি পঙিক্ত এমন;
‘শহীদ মিনার নিমেষেই দেখে ফাঁকা তার বেদীমূল
একুশের ফুল খেয়ে চলে যায় বাইশের লাল ঘোড়া!’
‘শহীদ মিনার নিমেষেই দেখে ফাঁকা তার বেদীমূল
একুশের ফুল খেয়ে চলে যায় বাইশের লাল ঘোড়া!’
আমাদের জাতীয় জীবনে ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি-মার্চ, মাঝখানে জানুয়ারি বাদ দিলে প্রায় পরপর তিনটি মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিসেম্বরকে আমরা বলি বিজয়ের মাস। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের পর্দার উপরের এক কোনায় জাতীয় স্মৃতিসৌধ বা জাতীয় পতাকা শোভা পায় বিজয়ের মাসের প্রতীক হিসেবে। কিসের বিজয়? মুক্তিযুদ্ধের। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার আবেগ, তার প্রাণ বাজি রাখা পরাক্রম এবং বিপরীতে ভয়াবহ নৃশংসতা আমরা প্রতিদিন-প্রতিরাত অনুভব করেছি। কিন্তু ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দটা কারও মুখেই শুনিনি। যারা সরাসরি যুদ্ধ করেছেন এবং কতিপয় দালাল বাদ দিয়ে আমরা যারা কখনও কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিয়ে, কখনও কোনো সংবাদ পৌঁছে দিয়ে টুকটাক সহযোগিতা করেছি, দেশ আক্রান্ত, দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে— এটাই ছিল আমাদের তখনকার একমাত্র চেতনা। তবে মুক্তিযুদ্ধে একেক শ্রেণীর লক্ষ্য ছিল একেক রকম। উঠতি ও সম্ভাব্য পুঁজিপতির উদ্দেশ্য এবং সাধারণ, বিশেষত গ্রামীণ জনগণের উদ্দেশ্য যেমন এক ছিল না, তেমনি রাজনৈতিক ও রাজনীতিমনস্ক শিক্ষিতজনদের উদ্দেশ্যের কথাও জানতেন না গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। এ সর্ববৃহত্ সংখ্যক মানুষেরা যুদ্ধ শুরু করেন আক্রান্ত হয়ে বা তাদের আপনজন আক্রান্ত হয়েছে দেখে। তাদের মনে কোনো স্বপ্ন যদি উঁকি দিয়ে থাকে তবে তা ছিল ১৯৭০-এর নির্বাচনে গ্রামে-গঞ্জে-বাজারে-হাটে সেঁটে দেয়া সেই পোস্টার ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ যে পোস্টারে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের দ্রব্যমূল্যের বিশাল পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছিল! যে বৈষম্য দূর হবে মনে করে তাঁরা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলেন। তাঁদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ‘চেতনা’ ছিল সেই বঞ্চনা থেকে মুক্তির প্রত্যাশা। বস্তুতপক্ষে অন্যান্য শ্রেণীর ‘চেতনা’র বহুলাংশ পূরণ হলেও যে সাধারণ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে দেশ, তাঁদের বঞ্চনার কোনো অবসান হয়নি। ক্ষমতার রাজনীতির নানা হাতিয়ার-ব্যবসায়ী মজুতদার, মধ্যস্বত্বভোগী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, ভূমিদস্যু, এমপি, চেয়ারম্যান, মেম্বার, টাউটদের কূটচাকায় পিষ্ট হয়ে প্রতিদিন ভয়াবহ হারে বেড়ে চলেছে ভূমিহীন-ভাসমান মানুষ। যারা ‘চেতনা’ ‘চেতনা’ বলে মাঝে মাঝে আওয়াজ তোলেন, তারা নির্ধারিত মাস জুড়ে নগরকেন্দ্রিক কোনো কোনো টিভি চ্যানেলে অনেক বড় বড় কথা বলেন, মধ্যরাতের নির্জনতায়। জনতার জন্যে একথা নয় বলেই হয়তো এই নির্জনতার সময় নির্বাচন। তাছাড়া সে সব কথার বর্মভেদ করে মর্ম উপলব্ধি করাও যথেষ্ট কঠিন এবং তার শ্রোতাও সম্ভবত বক্তার আত্মীয়স্বজন-পরিজনবৃন্দই। এসব ‘চেতনা’র বহিঃপ্রকাশ টেলিভিশন সেটের কোনার ওই প্রতীক চিহ্নগুলোই, যা নির্ধারিত মাস শেষ হলেই অপসৃত হয়। বাইশের লাল ঘোড়ার মতোই ‘থার্টিফাস্টের’ মত্ত খচ্চর দলে পিষে দিয়ে যায় সব চেতনাকে। চেতনা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে সমগ্র জানুয়ারি জুড়ে।
ফেব্রুয়ারি মাসে আবার আমরা জেগে ওঠি। ওটি আমাদের ভাষার মাস। ১৯৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে তরুণ ছাত্রসমাজ আন্দোলন-সংগ্রাম করে, নিজেদের সিদ্ধান্তে পাকিস্তান সরকারের জারিকরা ১৪৪ ধারা ভেঙে, বুকের তাজা রক্তে ছিনিয়ে এনেছিল মাতৃভাষার অধিকার—বাংলা ভাষার অধিকার। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস। ভাষার সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমাদের কথায়, লেখায় ‘সংস্কৃতি’ বা ‘সাংস্কৃতিক’ শব্দ দুটি বহু ব্যবহৃত হলেও বোধ হয় মূল বাংলা শব্দ নয়। কারণ বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ঘেটে শব্দ দুটি মূল শব্দ হিসেবে পাইনি। সংস্কার আছে, ‘সংস্কৃত’ আছে, এমনকি সংস্কৃতিমান, সংস্কৃতিবান আছে, কিন্তু সংস্কৃতি নেই। এখন ‘জ্ঞান’ যার আছে তিনি ‘জ্ঞানবান’, বুদ্ধি থাকলে তিনি ‘বুদ্ধিমান’ কিন্তু ‘সংস্কৃতি’ যদি না-ই থেকে থাকে তবে সংস্কৃতিমান বা বান হবেন কি করে? অন্বিত সূচক প্রত্যয় ‘বান’ বা ‘মান’ যে শব্দের সঙ্গে অন্বিত হবে সেটি তো একটি মূল শব্দ। ‘সংস্কৃতি’ যদি তেমন কোনো শব্দ হতো, তাহলে ‘সংস্কার’ বা ‘সংস্কৃত’ যেমন স্পষ্টাক্ষরে (ইড়ষফষবঃঃবত্) আছে সেভাবেই থাকত। সংস্কৃতি শব্দটি দুই স্থানে খুঁজে পাওয়া গেছে। ‘সংস্কৃত’র অর্থ ও আনুষঙ্গিক বিবরণের মধ্যে এবং অন্যত্র ‘কালচার’ নামক শব্দের অর্থ হিসেবে। ‘সাংস্কৃতিক’ শব্দটি অবশ্য কোথাও নেই। আমরা, সংস্কৃতি শব্দটিকে মূল শব্দ হিসেবে না পাওয়ার কারণেই হয়তো ‘সংস্কৃতিবান’ হওয়ার চেয়ে ‘কালচার্ড’ হওয়ার চেষ্টা করছি বেশি এবং তারই ফাঁক গলে ভাষার মাসের মধ্যে শিং বাঁকিয়ে ঢুকে পড়েছে ‘ওয়েস্টার্ন কালচার’-এর ভ্যালেনটাইন ডে’র ভেড়া। এ যেন ভাষার চেতনার মধ্যে কৌশলে তামাশার রঙ্গ ঢুকিয়ে দেয়া। এই দুরাচার কবে আমাদের স্বভাবের মধ্যে ঢুকে গেছে, আমরা জানতেও পারিনি। ইংরেজ তামাশাবাজেরা-বাঙালি বাবুদের বোকা বানাবার জন্য ১ এপ্রিল যে ‘এপ্রিল ফুল’ প্রথা চালু করেছিল ইংরেজ বিদায়ের পরও তা আমরা ঘটা করে পালন করেছি বহুকাল। আমাদের আত্মসম্মানবোধের এ দৈন্যের কারণেই পাশ্চাত্যের সব পচনকেই ধারণ করার জন্যে আমরা ব্যগ্র হয়ে ওঠি। পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে ধারণ করতে পরিশ্রম এবং অনুশীলনের প্রয়োজন হয়, কিন্তু নষ্ট হয়ে যেতে চাইলেই হওয়া যায়। আত্মসম্মান ও জাতিত্ববোধহীন দুরাচারীদের দৌরাত্ম্যে আমাদের তরুণ সমাজ বিভ্রান্তির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে। তাই কোনো চেতনাই তাদের কাছে স্থায়ী হচ্ছে না। দুরাত্মারা প্রত্যাশায় আছে—এভাবেই সব চেতনা বিলুপ্ত হবে এবং আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্ম হয়ে উঠবে আত্মবিনাশী। আজ একুশের ফুল বাইশের লাল ঘোড়া খেয়ে যাচ্ছে। একদিন হয়তো শহীদ মিনারের বেদীমূলকে আবার রক্তফুলের আল্পনায় সাজাতে হবে। লাল ঘোড়ার জন্য এখনই যে লাগাম ও চাবুকের প্রয়োজন, তা নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে রইল আগামী বুধবার।
ফেব্রুয়ারি মাসে আবার আমরা জেগে ওঠি। ওটি আমাদের ভাষার মাস। ১৯৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে তরুণ ছাত্রসমাজ আন্দোলন-সংগ্রাম করে, নিজেদের সিদ্ধান্তে পাকিস্তান সরকারের জারিকরা ১৪৪ ধারা ভেঙে, বুকের তাজা রক্তে ছিনিয়ে এনেছিল মাতৃভাষার অধিকার—বাংলা ভাষার অধিকার। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস। ভাষার সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমাদের কথায়, লেখায় ‘সংস্কৃতি’ বা ‘সাংস্কৃতিক’ শব্দ দুটি বহু ব্যবহৃত হলেও বোধ হয় মূল বাংলা শব্দ নয়। কারণ বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ঘেটে শব্দ দুটি মূল শব্দ হিসেবে পাইনি। সংস্কার আছে, ‘সংস্কৃত’ আছে, এমনকি সংস্কৃতিমান, সংস্কৃতিবান আছে, কিন্তু সংস্কৃতি নেই। এখন ‘জ্ঞান’ যার আছে তিনি ‘জ্ঞানবান’, বুদ্ধি থাকলে তিনি ‘বুদ্ধিমান’ কিন্তু ‘সংস্কৃতি’ যদি না-ই থেকে থাকে তবে সংস্কৃতিমান বা বান হবেন কি করে? অন্বিত সূচক প্রত্যয় ‘বান’ বা ‘মান’ যে শব্দের সঙ্গে অন্বিত হবে সেটি তো একটি মূল শব্দ। ‘সংস্কৃতি’ যদি তেমন কোনো শব্দ হতো, তাহলে ‘সংস্কার’ বা ‘সংস্কৃত’ যেমন স্পষ্টাক্ষরে (ইড়ষফষবঃঃবত্) আছে সেভাবেই থাকত। সংস্কৃতি শব্দটি দুই স্থানে খুঁজে পাওয়া গেছে। ‘সংস্কৃত’র অর্থ ও আনুষঙ্গিক বিবরণের মধ্যে এবং অন্যত্র ‘কালচার’ নামক শব্দের অর্থ হিসেবে। ‘সাংস্কৃতিক’ শব্দটি অবশ্য কোথাও নেই। আমরা, সংস্কৃতি শব্দটিকে মূল শব্দ হিসেবে না পাওয়ার কারণেই হয়তো ‘সংস্কৃতিবান’ হওয়ার চেয়ে ‘কালচার্ড’ হওয়ার চেষ্টা করছি বেশি এবং তারই ফাঁক গলে ভাষার মাসের মধ্যে শিং বাঁকিয়ে ঢুকে পড়েছে ‘ওয়েস্টার্ন কালচার’-এর ভ্যালেনটাইন ডে’র ভেড়া। এ যেন ভাষার চেতনার মধ্যে কৌশলে তামাশার রঙ্গ ঢুকিয়ে দেয়া। এই দুরাচার কবে আমাদের স্বভাবের মধ্যে ঢুকে গেছে, আমরা জানতেও পারিনি। ইংরেজ তামাশাবাজেরা-বাঙালি বাবুদের বোকা বানাবার জন্য ১ এপ্রিল যে ‘এপ্রিল ফুল’ প্রথা চালু করেছিল ইংরেজ বিদায়ের পরও তা আমরা ঘটা করে পালন করেছি বহুকাল। আমাদের আত্মসম্মানবোধের এ দৈন্যের কারণেই পাশ্চাত্যের সব পচনকেই ধারণ করার জন্যে আমরা ব্যগ্র হয়ে ওঠি। পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে ধারণ করতে পরিশ্রম এবং অনুশীলনের প্রয়োজন হয়, কিন্তু নষ্ট হয়ে যেতে চাইলেই হওয়া যায়। আত্মসম্মান ও জাতিত্ববোধহীন দুরাচারীদের দৌরাত্ম্যে আমাদের তরুণ সমাজ বিভ্রান্তির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে। তাই কোনো চেতনাই তাদের কাছে স্থায়ী হচ্ছে না। দুরাত্মারা প্রত্যাশায় আছে—এভাবেই সব চেতনা বিলুপ্ত হবে এবং আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্ম হয়ে উঠবে আত্মবিনাশী। আজ একুশের ফুল বাইশের লাল ঘোড়া খেয়ে যাচ্ছে। একদিন হয়তো শহীদ মিনারের বেদীমূলকে আবার রক্তফুলের আল্পনায় সাজাতে হবে। লাল ঘোড়ার জন্য এখনই যে লাগাম ও চাবুকের প্রয়োজন, তা নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে রইল আগামী বুধবার।
No comments