কবিগুরুর স্মৃতিমাখা বজরা
শিলাইদহে পদ্মার সাথে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিল এক নিবিড় সম্পর্ক। ওই সময় পদ্মার বুকে পাল তোলা নৌকা, একটু দূরে গড়াই নদীর সৌন্দর্য তাঁকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। পদ্মাকে তিনি বড় ভালবাসতেন। তাই তো কবি লিখেছেন, ‘হে পদ্মা আমার/তোমায় আমায় দেখা শত শতবার’।
চৈতালী কাব্যগ্রন্থের ‘পদ্মা’ শিরোনামের এই কবিতায় তিনি ব্যক্ত করেন জন্মান্তরে পদ্মাতীরে ফিরে আসার আকুতিও। কবিগুরুর যখন ভরা যৌবন এবং কাব্য সৃষ্টির প্রকৃষ্ট সময়; তখনই তিনি বিচরণ করেছেন এই শিলাইদহে। জমিদারীর কাজে কিংবা ব্যবসার কাজে এসময় তিনি কখনও স্বল্প সময়, কখনও দীর্ঘ সময় অবস্থান করেছেন এই শিলাইদহে। কখনও একাকী, কখনও স্ত্রী, পুত্র-কন্যা নিয়ে পেতেছেন ক্ষণিকের সংসার। ঘুরে বেড়িয়েছেন ‘হাউজ বোট পদ্মা’ নামের নৌকা বা বজরায়। কিংবা পালকীতে।
জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারীর কাজে শিলাইদহে এসে প্রায় বজরায় চেপে সপরিবারে পদ্মা ভ্রমণে বের হতেন। যে বজরাটিতে চড়ে তিনি ভ্রমণ করতেন; তার নাম ছিল ‘হাউজ বোট পদ্মা’। তাঁর এ রকম আরও তিনটি বড় নৌকা ছিল। এগুলোর নাম ছিল ‘লালডিঙ্গি’, ‘চপলা’ ও ‘চঞ্চলা’। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিল ‘হাউজ বোট পদ্মা’। এ বজরা বা বোটের এখন কোন অস্তিত্ব নেই। শুধু এর একটি সিঁড়ির অংশ সংরক্ষিত আছে শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির দোতলায়। আজও সেই সিঁড়িটি বেশ মজবুত, সবল ও চকচকে। এ নৌকায় চড়ে ১৮৯১ সালে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন তার অমর কাব্যগ্রন্থ ‘সোনার তরী’। এছাড়া তিনি অসংখ্য সাহিত্য রচনা করেন ওই নৌকায় নদীর বুকে ঘুরে ঘুরে। শুধু পদ্মা নয়। ইছামতী, গড়াই, আত্রাই ও নাগরসহ নদীকেন্দ্রিক গ্রামবাংলার নিসর্গ-সৌন্দর্য ও শৈল্পিক বর্ণনা আছে তাঁর ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে। বিশ্বকবি এসব নদীতেও ঘুরে বেড়াতেন নৌকা বা বজরায় চেপে। কিন্তু সংরক্ষণ করা হয়নি সেই নৌকাগুলো। তাই কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে কবির স্মৃতিমাখা সেই বজরা বা বোটগুলো। রবীন্দ্রনাথের সেই নৌকাগুলো কেমন ছিল? তা দেশী-বিদেশী পর্যটকদের জানার আগ্রহ দীর্ঘদিনের। পর্যটকদের সেই আগ্রহ থেকেই ‘হাউজ বোট পদ্মা’র আদলে কবির স্মৃতিধন্য শিলাইদহে বিশাল একটি নৌকা তৈরির উদ্যোগ নেয় প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত বজরার ছবি দেখে কোনোরকম বিকৃতি ছাড়াই এ নৌকাটির নকশা প্রণয়ন করে বিআইডব্লিউটিএ। তাদের সরবরাহ করা নকশা অনুযায়ী বজরাটি তৈরি করেন খুলনার আটজন নৌকার কারিগর। প্রায় ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে মিয়ানমার প্রজাতির টিক চাম্বল কাঠের ৬০ ফুট দীর্ঘ বিশাল এ বজরাটি তৈরিতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ মাস। এরপর এটি পানিতে ভাসানো হয়। তবে পদ্মাতে নয়। সেটি ভাসানো হয়েছে শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির পাশে ঐতিহাসিক বকুলতলার শান বাঁধানো পুকুরঘাটে। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য একটি স্পট হচ্ছে এ পুকুরঘাট। এক সময় এ ঘাটের সামনে ছিল দুটি বড় বকুলগাছ। এর মধ্যে বয়সের ভারে একটি গাছ মরে গেছে। এখন বেঁচে আছে একটি। শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ যেসব গান-কবিতা রচনা করেছেন, তার অন্যতম এই বকুলতলার ঘাটে বসে লেখা ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’, গড়াই নদীতে ‘বজরায়’ বসে লেখা ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর’, শিলাইদহে বসে লেখা ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’, ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ প্রভৃতি। এছাড়া শিলাইদহে অবস্থানকালে যে সকল বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে এখানে এসেছিলেন; তাঁরাও দর্শন দিয়েছেন বকুলতলার এই শান বাঁধানো পুকুরঘাটে। এঁদের মধ্যে ছিলেন, কবি ও নাট্যকার ডিএল রায়, শিল্পী নন্দলাল বসু, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু, নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়, দীনবন্ধু মিত্র, অক্ষয় কুমার মৈত্র, এনড্রুজ সাহেব, সিস্টার নিবেদিতা ও সুরেন্দ্রনাথ আচার্য। কবির স্মৃতিধন্য এই পুকুরঘাটেই ফিতা কেটে আনুষ্ঠানিকভাবে নৌকাটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করেন কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক। রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির কাস্টোডিয়ান মোঃ মহিদুল ইসলাম জানান, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় ২০ লাখ টাকা দিয়েছে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর। মিয়ানমার প্রজাতির টিক চাম্বল কাঠ দিয়ে ৬০ ফুট দীর্ঘ ও ১৫ ফুট প্রস্থের বজরাটি তৈরিতে সময় লেগেছে প্রায় ৫ মাস। নৌকার প্রধান কারিগর রেজাউল জানান, ৬০০ সিএফটি কাঠ লেগেছে এর পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে। নৌকাটি অত্যন্ত মজবুত। এটি পানির ওপর দীর্ঘদিন পড়ে থাকলেও নষ্ট হবে না বলে আশা করি। রবীন্দ্রনাথের বহু রচনায়, বিশেষ করে কবিতায় ও গানে নদীকেন্দ্রিক বর্ণনা রয়েছে। পদ্মাপারের কবিতাবলি ও গান রবীন্দ্র সাহিত্যধারায় এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। সেখানেও নদীর বর্ণনা রয়েছে। বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক ড. আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, ‘অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় যে আমরা রবীন্দ্রনাথের পদ্মা বোট সংরক্ষণ করতে পারিনি। প্রকৃত নৌকাটি থাকলে রবীন্দ্রভক্ত-অনুরাগীরা তা দেখতে পারতেন। তবে এর আদলে একটি নৌকা যে তৈরি হয়েছে এটি আনন্দের বিষয়’। তিনি বলেন, অসংখ্য কবিতা, গান তিনি ‘পদ্মা বোটে’ চড়ে লিখেছেন। কিন্তু তাঁর সেই বোটের এখন আর কোন অস্তিত্ব নেই। পদ্মা বোটের আদলে তৈরি বিশাল এ নৌকাটি দেখতে প্রতিদিন দেশী-বিদেশী পর্যটকরা ভিড় জমাচ্ছে শিলাইদহের ঐতিহাসিক বকুলতলার পুকুরঘাটে।
-এমএ রকিব, কুষ্টিয়া
জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারীর কাজে শিলাইদহে এসে প্রায় বজরায় চেপে সপরিবারে পদ্মা ভ্রমণে বের হতেন। যে বজরাটিতে চড়ে তিনি ভ্রমণ করতেন; তার নাম ছিল ‘হাউজ বোট পদ্মা’। তাঁর এ রকম আরও তিনটি বড় নৌকা ছিল। এগুলোর নাম ছিল ‘লালডিঙ্গি’, ‘চপলা’ ও ‘চঞ্চলা’। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিল ‘হাউজ বোট পদ্মা’। এ বজরা বা বোটের এখন কোন অস্তিত্ব নেই। শুধু এর একটি সিঁড়ির অংশ সংরক্ষিত আছে শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির দোতলায়। আজও সেই সিঁড়িটি বেশ মজবুত, সবল ও চকচকে। এ নৌকায় চড়ে ১৮৯১ সালে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন তার অমর কাব্যগ্রন্থ ‘সোনার তরী’। এছাড়া তিনি অসংখ্য সাহিত্য রচনা করেন ওই নৌকায় নদীর বুকে ঘুরে ঘুরে। শুধু পদ্মা নয়। ইছামতী, গড়াই, আত্রাই ও নাগরসহ নদীকেন্দ্রিক গ্রামবাংলার নিসর্গ-সৌন্দর্য ও শৈল্পিক বর্ণনা আছে তাঁর ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে। বিশ্বকবি এসব নদীতেও ঘুরে বেড়াতেন নৌকা বা বজরায় চেপে। কিন্তু সংরক্ষণ করা হয়নি সেই নৌকাগুলো। তাই কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে কবির স্মৃতিমাখা সেই বজরা বা বোটগুলো। রবীন্দ্রনাথের সেই নৌকাগুলো কেমন ছিল? তা দেশী-বিদেশী পর্যটকদের জানার আগ্রহ দীর্ঘদিনের। পর্যটকদের সেই আগ্রহ থেকেই ‘হাউজ বোট পদ্মা’র আদলে কবির স্মৃতিধন্য শিলাইদহে বিশাল একটি নৌকা তৈরির উদ্যোগ নেয় প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত বজরার ছবি দেখে কোনোরকম বিকৃতি ছাড়াই এ নৌকাটির নকশা প্রণয়ন করে বিআইডব্লিউটিএ। তাদের সরবরাহ করা নকশা অনুযায়ী বজরাটি তৈরি করেন খুলনার আটজন নৌকার কারিগর। প্রায় ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে মিয়ানমার প্রজাতির টিক চাম্বল কাঠের ৬০ ফুট দীর্ঘ বিশাল এ বজরাটি তৈরিতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ মাস। এরপর এটি পানিতে ভাসানো হয়। তবে পদ্মাতে নয়। সেটি ভাসানো হয়েছে শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির পাশে ঐতিহাসিক বকুলতলার শান বাঁধানো পুকুরঘাটে। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য একটি স্পট হচ্ছে এ পুকুরঘাট। এক সময় এ ঘাটের সামনে ছিল দুটি বড় বকুলগাছ। এর মধ্যে বয়সের ভারে একটি গাছ মরে গেছে। এখন বেঁচে আছে একটি। শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ যেসব গান-কবিতা রচনা করেছেন, তার অন্যতম এই বকুলতলার ঘাটে বসে লেখা ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’, গড়াই নদীতে ‘বজরায়’ বসে লেখা ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর’, শিলাইদহে বসে লেখা ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’, ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ প্রভৃতি। এছাড়া শিলাইদহে অবস্থানকালে যে সকল বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে এখানে এসেছিলেন; তাঁরাও দর্শন দিয়েছেন বকুলতলার এই শান বাঁধানো পুকুরঘাটে। এঁদের মধ্যে ছিলেন, কবি ও নাট্যকার ডিএল রায়, শিল্পী নন্দলাল বসু, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু, নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়, দীনবন্ধু মিত্র, অক্ষয় কুমার মৈত্র, এনড্রুজ সাহেব, সিস্টার নিবেদিতা ও সুরেন্দ্রনাথ আচার্য। কবির স্মৃতিধন্য এই পুকুরঘাটেই ফিতা কেটে আনুষ্ঠানিকভাবে নৌকাটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করেন কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক। রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির কাস্টোডিয়ান মোঃ মহিদুল ইসলাম জানান, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় ২০ লাখ টাকা দিয়েছে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর। মিয়ানমার প্রজাতির টিক চাম্বল কাঠ দিয়ে ৬০ ফুট দীর্ঘ ও ১৫ ফুট প্রস্থের বজরাটি তৈরিতে সময় লেগেছে প্রায় ৫ মাস। নৌকার প্রধান কারিগর রেজাউল জানান, ৬০০ সিএফটি কাঠ লেগেছে এর পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে। নৌকাটি অত্যন্ত মজবুত। এটি পানির ওপর দীর্ঘদিন পড়ে থাকলেও নষ্ট হবে না বলে আশা করি। রবীন্দ্রনাথের বহু রচনায়, বিশেষ করে কবিতায় ও গানে নদীকেন্দ্রিক বর্ণনা রয়েছে। পদ্মাপারের কবিতাবলি ও গান রবীন্দ্র সাহিত্যধারায় এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। সেখানেও নদীর বর্ণনা রয়েছে। বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক ড. আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, ‘অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় যে আমরা রবীন্দ্রনাথের পদ্মা বোট সংরক্ষণ করতে পারিনি। প্রকৃত নৌকাটি থাকলে রবীন্দ্রভক্ত-অনুরাগীরা তা দেখতে পারতেন। তবে এর আদলে একটি নৌকা যে তৈরি হয়েছে এটি আনন্দের বিষয়’। তিনি বলেন, অসংখ্য কবিতা, গান তিনি ‘পদ্মা বোটে’ চড়ে লিখেছেন। কিন্তু তাঁর সেই বোটের এখন আর কোন অস্তিত্ব নেই। পদ্মা বোটের আদলে তৈরি বিশাল এ নৌকাটি দেখতে প্রতিদিন দেশী-বিদেশী পর্যটকরা ভিড় জমাচ্ছে শিলাইদহের ঐতিহাসিক বকুলতলার পুকুরঘাটে।
-এমএ রকিব, কুষ্টিয়া
No comments