এইচএম এরশাদের মন্তব্য নিয়ে কিছু কথা by মোহাম্মদ মতিন উদ্দিন
বিগত ১৯ এবং ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে যে সহিংস ঘটনা ঘটেছে সে সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে ১ মার্চ বনানীতে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় যুব সংহতির বর্ধিত সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ বলেছেন, সেনাবাহিনী না থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অংশ থাকত না। পাহাড়ি এলাকা অশান্ত হওয়ার পেছনের কারণগুলো জানা থাকলেও কৌশলগত কারণে তিনি তা স্পষ্টভাবে বলছেন না।
পার্বত্য এলাকায় কর্মরত বিভিন্ন এনজিওর কার্যক্রম নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন। এরশাদ বলেন, জনগণ এদেশে আইএমএফ, এডিবি, বিশ্বব্যাংক দেখতে চায় না। ওদের মাতব্বরি মানুষ সহ্য করতে রাজি নয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ওরা যা বলে তা রীতিমতো ধৃষ্টতা। বাংলাদেশের মানুষ ওদের অনুদান আর চায় না। তারা মুক্তিযুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করেছে। তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়।
তিনি বলেন, এসব সংস্থা যেসব অনুদান দেয় এর পাঁচ শতাংশও বাংলাদেশের কাজে লাগে না। নিজেদের লোকজনের বেতন-ভাতা ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাবদ ওরাই অনুদানের অর্ধেক অর্থ খেয়ে ফেলে। বিদেশি অনুদান না নিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে সাবেক এই রাষ্ট্রপতি বলেন, বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ আছে। যুব সমাজই এদেশের বড় সম্পদ। এ সম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে অন্যের দ্বারগ্রস্ত হতে হবে না। (সূত্র : ‘আমাদের সময়’, ২ মার্চ ২০১০)
সম্ভবত পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংস ঘটনায় সেনাবাহিনী জড়িত বলে যে অভিযোগ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) তার প্রেক্ষিতেই সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের এ মন্তব্য। ২৬ ফেব্রুয়ারি ইইউ-এর পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি ক্যাথারিন অইনের পক্ষে তার মুখপাত্র ব্রাসেলসে এক বিবৃতিতে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সহিংস ঘটনায় সেনাবাহিনী জড়িত। এ সহিংস ঘটনায় সেনাবাহিনীর সদস্য এবং সেনাবাহিনীর নিয়োগ করা ব্যক্তিরা জড়িত থাকার অভিযোগের ব্যাপারে আমরা পুরোপুরি অবহিত আছি। এ সহিংস ঘটনায় সেনাবাহিনীর জড়িত থাকার অভিযোগ দ্রুত ও স্বাধীনভাবে তদন্তের জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। বাংলাদেশ সরকারকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, এ লজ্জাজনক ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা বাংলাদেশ সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কোনো সহনশীল সমাজে এ ধরনের ঘটনার স্থান হতে পারে না।
পার্বত্য (চট্টগ্রামের) অঞ্চলের স্থিতিশীলতা এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ক্ষেত্রে এ ঘটনা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করে অবিলম্বে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়। (সূত্র : ‘আমার দেশ’, ১ মার্চ, ২০১০)
ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপরোক্ত বিবৃতিকে ‘ভূতের মুখে রামনাম’ বললে মনে হয় অযৌক্তিক কিছু বলা হবে না। কেননা এসব মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো আফগানিস্তান ও ইরাকের মতো দেশে আমেরিকার সঙ্গে যৌথভাবে মিলে সামরিক অভিযান চালিয়েছে, হাজার হাজার নিরপরাধ নাগরিককে হত্যা করেছে, এক কথায় গণহত্যা চালিয়েছে এবং এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। গণহত্যার দায়ে এসব দেশের বা দেশের কর্ণধারদের বিচার করা যেখানে জরুরি হয়ে পড়েছে, তারা যখন আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ শুরু করেছে তখন মনে হয় পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে তাদের বিশেষ কোনো পরিকল্পনা কাজ করছে। হয়তোবা নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রামে মহাশক্তিধরদের সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের বিষয়টিও এ পরিকল্পনার মধ্যে থাকতে পারে।
সম্প্রতি কলকাতা প্রেসক্লাবে ৩ মার্চ বুধবার ‘চট্টগ্রাম হিল ট্রাক্টস সাপোর্ট গ্রুপ কলকাতা’ নামে একটি সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাঙালিদের কথিত হামলার প্রতিবাদে এক সংবাদ সম্মেলন করে। এ সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন কবি তরুণ সান্যাল। কলকাতা প্রেসক্লাবে এ সংবাদ সম্মেলনের চারদিকে বুকে ছবি সংবলিত ও স্লোগানে লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে চাকমা তরুণ-তরুণীরা দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্ল্যাকার্ডে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে লেখা ছিল, শান্তিচুক্তির জন্য আমরা অস্ত্র সমর্পণ করেছি, যদি সেই চুক্তি বাস্তবায়িত না হয়, ‘আমরা আবার অস্ত্র ধরতে বাধ্য হব।’ এ সংবাদ সম্মেলনের সভাপতি তরুণ সান্যাল বলেন, চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে পরমাণু শক্তি তৈরির খনিজ রয়েছে সে জন্য চাকমাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা চলছে।’
তেলসম্পদ লুণ্ঠনের জন্য ইরাকে একটি বৈধ সরকারকে সশস্ত্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে উত্খাত করে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে সে দেশের খনিজসম্পদ যেভাবে লুটপাট করা চলছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরমাণু শক্তি তৈরির খনিজ সম্পদের উপর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বিদেশি মহাশক্তিধররা পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত উস্কে দিয়ে নিজেদের সামরিক অবস্থান নিশ্চিত করার পথ পরিষ্কার যে করছে না একথা বলা যায় না। এ পরিকল্পনার বিষয়টি সম্ভবত সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ জানেন বিধায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তার বক্তব্যে। তবে লুকোচুরি না খেলে পরিষ্কার ভাষায় কথা বলে দেশবাসীকে প্রকৃত তথ্য জানাতে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের সচেষ্ট হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। সবকিছু জানা সত্ত্বেও কৌশলগত কারণে চুপচাপ থাকার অর্থ হচ্ছে দেশের স্বার্থকে ঊর্ধ্বে স্থান না দেয়া। একে দেশপ্রেমহীন মানসিকতা বললে মনে হয় বেশি বলা হবে না। আশা করি, সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ বিষয়টির মর্ম বুঝার চেষ্টা করবেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে বিদেশিদের খেলার বিষয়টি দেশবাসীর সামনে পরিষ্কার করবেন। এটাই হবে প্রকৃত সৈনিকের পরিচয়। তাছাড়া তিনি শুধু একজন সৈনিক ছিলেন না, ছিলেন একজন সেনাপ্রধান। এ ক্ষেত্রে তার দায়িত্ব অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সবকিছু জেনেশুনে দেশের জনগণকে অন্ধকারে রাখা দেশপ্রেমেরও পরিচয় নয়। এখানেই প্রমাণ হবে তার কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা বড় না দেশপ্রেম বড়। বিদেশি মহাশক্তিধরদের তোষামোদী করে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদারিত্বে বহাল থাকার মানসিকতায় আচ্ছন্ন থাকলে কৌশলগত কারণ তার কাছে বড় হয়ে দেখা দেবে এটাই স্বাভাবিক। আশা করি, এ ধারণা ভুল সেটা তিনি প্রমাণ করবেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সহিংস ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ প্রশ্নে বিদেশিদের নগ্ন হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা নিয়ে যখন কথা বলছি তখন হয়তোবা অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন আমাদের দেশে বিদ্যমান ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ সমান অধিকার নিশ্চিত করা কি গুরুত্বপূর্ণ নয়? দেশে বিদ্যমান ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ সমান অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করা অবশ্যই প্রয়োজন, তবে তার জন্য যে পথে অগ্রসর হতে হবে সেপথ হচ্ছে অন্যান্য জাতিসত্তার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সঙ্গে মিলে দেশে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশে বিদ্যমান রাষ্ট্রটি তেমন গণতান্ত্রিক নয়। রাষ্ট্র ও সংবিধানের গণতান্ত্রিক চরিত্র প্রতিষ্ঠার পথেই দেশে বিদ্যমান জাতিগুলোর সমান অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব। কোনো বিদেশি শক্তির ছত্রছায়ায় সেটা সম্ভব নয়।
বিদেশি মহাশক্তিধরদের ছত্রছায়ায় আমাদের দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোকে আদিবাসী বানানোর চেষ্টা চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এ প্রচেষ্টার সঙ্গে যেমন এদেশে অনেক এনজিও জড়িত, তেমনিভাবে কিছু বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার গ্রুপসহ রাজনৈতিক দলও এসবের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোকে আদিবাসী হিসাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হলে তাদের স্বার্থে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ সহজ হয়ে পড়ে। জানা যায়, জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক চার্টারে ‘আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত যে কোনো দেশে জাতিসংঘ সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারবে’—এমন ক্লজ আছে। এ দিক থেকে বিচার করলে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতকে কেন্দ্র করে আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষার নামে জাতিসংঘের মাধ্যমে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই এদেশে চলছে। শান্তি রক্ষার নামে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে আমাদের সেনাসদস্যদের পাঠিয়ে আমরা যেমন জাতীয় গৌরবের ঢাকঢোল বাজাই, পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিসংঘের নেতৃত্বে অন্য কোনো দেশের সৈনিকরা যদি শান্তি রক্ষার নামে এদেশে এসে ঘাঁটি গাড়ে তখন কী আমরা গৌরবের ঢাক-ঢোল বাজাবো? বিষয়টি বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। তাহলে একটা বিষয় পরিষ্কার হবে, যে সব ব্যক্তি, এনজিও ও রাজনৈতিক দল এদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাসমূহকে আদিবাসী বানানোর চেষ্টা করছেন, তারা কার স্বার্থে কাজ করে চলেছেন।
বাংলাদেশে বিদ্যমান ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অসংখ্য মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করেছে। এই সশস্ত্র লড়াইয়ের পরিণতিতে বাংলাদেশ নামক সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অসংখ্য মানুষের অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সমস্যাটা অন্যত্র। সশস্ত্র লড়াইয়ের পরিণতিতে যে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা পেল তার চরিত্র যদি গণতান্ত্রিক হতো তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আজকে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তা কোনোদিনই হতো না। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যে সংবিধান নিয়ে যাত্রা শুরু সেই সংবিধানে বাংলাদেশে বিদ্যমান ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি। সমস্যার বীজ এখানেই নিহিত। তাইতো দেখি, ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর জনসাধারণকে ‘বাঙালি হয়ে যাওয়ার’ কথা বলেন। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে রচিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানেও সব নাগরিককে ‘বাঙালি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বিষয়টি অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর মানুষের কাছে অবমাননাকর মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিভেদের বীজ রচনা হয়েছে এখান থেকেই। প্রতিটি জাতিসত্তা তার আপন জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বোধের স্বাতন্ত্র্যকে কেন্দ্র করেই চলতে চায়। প্রতিটি জাতিসত্তার এই চাওয়াকে রাষ্ট্রীয় সংবিধানে মর্যাদা দান করার মধ্য দিয়েই সব জাতিসত্তার মিলেমিশে চলার রাস্তা পরিষ্কার হয়। এর অন্যথা হলে জাতিগুলোর মধ্যে ব্যবধান বেড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর বাংলাদেশে এটাই হয়েছে। আর এই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে সক্রিয় হয়েছে বিদেশি আধিপত্যবাদী শক্তিসমূহ। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সামরিক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা হিতে বিপরীত হওয়াটাই স্বাভাবিক। বরং এই সমস্যা থেকে উদ্ধার পেতে হলে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ সমান অধিকার নিশ্চিত করার পথেই আমাদের এগুনো দরকার। এই পথে অগ্রসর হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে এই কারণে বলছি যে, বিষয়টি সমাধানের প্রশ্নে সময় অনেক পার হয়ে গেছে, এ সময়ের মাঝে আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো সক্রিয় হয়েছে অনেক বেশি। তাছাড়া নতুন যে বিশ্ব পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সেই পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বৃহত্ শক্তিগুলোর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। তাইওয়ানে আমেরিকার অস্ত্র বিক্রয়, তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাইলামার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার বৈঠক, হাইতিতে ভূমিকম্পকে কেন্দ্র করে সাহায্যকারী হিসেবে এসে মার্কিন ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা, রাশিয়াকে লক্ষ্য করে ইউরোপে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের মার্কিনী তত্পরতা, পারস্য উপসাগরে নতুন করে মার্কিন সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং পারমাণবিক শক্তিধর রাশিয়ার জাতীয় স্বার্থে পরমাণু বোমা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা ইত্যাদি ঘটনা নতুন করে বিশ্বে বৃহত্ শক্তিগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্বের বিষয়টিকে প্রকট করে তুলেছে। সবকিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, অর্থনৈতিক মন্দার কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমেরিকা বড় ধরনের কোনো যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছে। আমেরিকার এ প্রচেষ্টার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সখ্য বৃদ্ধি পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই অবস্থায় বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে বঙ্গোপসাগর এলাকায় আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি আমেরিকার জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। উল্লিখিত বিষয়গুলো লক্ষ্য করলে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় শান্তি রক্ষিবাহিনীর ছদ্মাবরণে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির পরিকল্পনার বিষয়টি থাকতেই পারে। এসব বিষয় হিসাবের মধ্যে নিলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংস ঘটনাকে আরও উস্কে দিয়ে পরিকল্পনামাফিক সামরিক অবস্থান গ্রহণের বিষয়টিকে নিশ্চিত করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের কোন কোন ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দল তাদের সহযোগিতায় মেতে উঠতে পারে। অবস্থা যখন এরকম তখন সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদকে বলতে চাই, (পাহাড়ি এলাকার) অশান্তির পেছনে যেসব কারণ আপনি জানেন তা খোলামেলাভাবে দেশের জনগণের সামনে তুলে ধরুন, কৌশলগত কারণে বলতে পারছেন না— এ অজুহাত তুলে বাংলাদেশের জনগণকে বিপদগ্রস্ত করবেন না। এতে করে আপনার মর্যাদা বাড়বে না, বরং এদেশের জনগণ আপনাকে সংকীর্ণ স্বার্থের প্রতিভূ হিসেবেই চিহ্নিত করবে।
তিনি বলেন, এসব সংস্থা যেসব অনুদান দেয় এর পাঁচ শতাংশও বাংলাদেশের কাজে লাগে না। নিজেদের লোকজনের বেতন-ভাতা ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাবদ ওরাই অনুদানের অর্ধেক অর্থ খেয়ে ফেলে। বিদেশি অনুদান না নিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে সাবেক এই রাষ্ট্রপতি বলেন, বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ আছে। যুব সমাজই এদেশের বড় সম্পদ। এ সম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে অন্যের দ্বারগ্রস্ত হতে হবে না। (সূত্র : ‘আমাদের সময়’, ২ মার্চ ২০১০)
সম্ভবত পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংস ঘটনায় সেনাবাহিনী জড়িত বলে যে অভিযোগ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) তার প্রেক্ষিতেই সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের এ মন্তব্য। ২৬ ফেব্রুয়ারি ইইউ-এর পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি ক্যাথারিন অইনের পক্ষে তার মুখপাত্র ব্রাসেলসে এক বিবৃতিতে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সহিংস ঘটনায় সেনাবাহিনী জড়িত। এ সহিংস ঘটনায় সেনাবাহিনীর সদস্য এবং সেনাবাহিনীর নিয়োগ করা ব্যক্তিরা জড়িত থাকার অভিযোগের ব্যাপারে আমরা পুরোপুরি অবহিত আছি। এ সহিংস ঘটনায় সেনাবাহিনীর জড়িত থাকার অভিযোগ দ্রুত ও স্বাধীনভাবে তদন্তের জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। বাংলাদেশ সরকারকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, এ লজ্জাজনক ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা বাংলাদেশ সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কোনো সহনশীল সমাজে এ ধরনের ঘটনার স্থান হতে পারে না।
পার্বত্য (চট্টগ্রামের) অঞ্চলের স্থিতিশীলতা এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ক্ষেত্রে এ ঘটনা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করে অবিলম্বে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়। (সূত্র : ‘আমার দেশ’, ১ মার্চ, ২০১০)
ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপরোক্ত বিবৃতিকে ‘ভূতের মুখে রামনাম’ বললে মনে হয় অযৌক্তিক কিছু বলা হবে না। কেননা এসব মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো আফগানিস্তান ও ইরাকের মতো দেশে আমেরিকার সঙ্গে যৌথভাবে মিলে সামরিক অভিযান চালিয়েছে, হাজার হাজার নিরপরাধ নাগরিককে হত্যা করেছে, এক কথায় গণহত্যা চালিয়েছে এবং এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। গণহত্যার দায়ে এসব দেশের বা দেশের কর্ণধারদের বিচার করা যেখানে জরুরি হয়ে পড়েছে, তারা যখন আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ শুরু করেছে তখন মনে হয় পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে তাদের বিশেষ কোনো পরিকল্পনা কাজ করছে। হয়তোবা নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রামে মহাশক্তিধরদের সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের বিষয়টিও এ পরিকল্পনার মধ্যে থাকতে পারে।
সম্প্রতি কলকাতা প্রেসক্লাবে ৩ মার্চ বুধবার ‘চট্টগ্রাম হিল ট্রাক্টস সাপোর্ট গ্রুপ কলকাতা’ নামে একটি সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাঙালিদের কথিত হামলার প্রতিবাদে এক সংবাদ সম্মেলন করে। এ সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন কবি তরুণ সান্যাল। কলকাতা প্রেসক্লাবে এ সংবাদ সম্মেলনের চারদিকে বুকে ছবি সংবলিত ও স্লোগানে লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে চাকমা তরুণ-তরুণীরা দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্ল্যাকার্ডে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে লেখা ছিল, শান্তিচুক্তির জন্য আমরা অস্ত্র সমর্পণ করেছি, যদি সেই চুক্তি বাস্তবায়িত না হয়, ‘আমরা আবার অস্ত্র ধরতে বাধ্য হব।’ এ সংবাদ সম্মেলনের সভাপতি তরুণ সান্যাল বলেন, চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে পরমাণু শক্তি তৈরির খনিজ রয়েছে সে জন্য চাকমাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা চলছে।’
তেলসম্পদ লুণ্ঠনের জন্য ইরাকে একটি বৈধ সরকারকে সশস্ত্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে উত্খাত করে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে সে দেশের খনিজসম্পদ যেভাবে লুটপাট করা চলছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরমাণু শক্তি তৈরির খনিজ সম্পদের উপর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বিদেশি মহাশক্তিধররা পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত উস্কে দিয়ে নিজেদের সামরিক অবস্থান নিশ্চিত করার পথ পরিষ্কার যে করছে না একথা বলা যায় না। এ পরিকল্পনার বিষয়টি সম্ভবত সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ জানেন বিধায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তার বক্তব্যে। তবে লুকোচুরি না খেলে পরিষ্কার ভাষায় কথা বলে দেশবাসীকে প্রকৃত তথ্য জানাতে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের সচেষ্ট হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। সবকিছু জানা সত্ত্বেও কৌশলগত কারণে চুপচাপ থাকার অর্থ হচ্ছে দেশের স্বার্থকে ঊর্ধ্বে স্থান না দেয়া। একে দেশপ্রেমহীন মানসিকতা বললে মনে হয় বেশি বলা হবে না। আশা করি, সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ বিষয়টির মর্ম বুঝার চেষ্টা করবেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে বিদেশিদের খেলার বিষয়টি দেশবাসীর সামনে পরিষ্কার করবেন। এটাই হবে প্রকৃত সৈনিকের পরিচয়। তাছাড়া তিনি শুধু একজন সৈনিক ছিলেন না, ছিলেন একজন সেনাপ্রধান। এ ক্ষেত্রে তার দায়িত্ব অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সবকিছু জেনেশুনে দেশের জনগণকে অন্ধকারে রাখা দেশপ্রেমেরও পরিচয় নয়। এখানেই প্রমাণ হবে তার কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা বড় না দেশপ্রেম বড়। বিদেশি মহাশক্তিধরদের তোষামোদী করে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদারিত্বে বহাল থাকার মানসিকতায় আচ্ছন্ন থাকলে কৌশলগত কারণ তার কাছে বড় হয়ে দেখা দেবে এটাই স্বাভাবিক। আশা করি, এ ধারণা ভুল সেটা তিনি প্রমাণ করবেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সহিংস ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ প্রশ্নে বিদেশিদের নগ্ন হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা নিয়ে যখন কথা বলছি তখন হয়তোবা অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন আমাদের দেশে বিদ্যমান ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ সমান অধিকার নিশ্চিত করা কি গুরুত্বপূর্ণ নয়? দেশে বিদ্যমান ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ সমান অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করা অবশ্যই প্রয়োজন, তবে তার জন্য যে পথে অগ্রসর হতে হবে সেপথ হচ্ছে অন্যান্য জাতিসত্তার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সঙ্গে মিলে দেশে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশে বিদ্যমান রাষ্ট্রটি তেমন গণতান্ত্রিক নয়। রাষ্ট্র ও সংবিধানের গণতান্ত্রিক চরিত্র প্রতিষ্ঠার পথেই দেশে বিদ্যমান জাতিগুলোর সমান অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব। কোনো বিদেশি শক্তির ছত্রছায়ায় সেটা সম্ভব নয়।
বিদেশি মহাশক্তিধরদের ছত্রছায়ায় আমাদের দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোকে আদিবাসী বানানোর চেষ্টা চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এ প্রচেষ্টার সঙ্গে যেমন এদেশে অনেক এনজিও জড়িত, তেমনিভাবে কিছু বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার গ্রুপসহ রাজনৈতিক দলও এসবের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোকে আদিবাসী হিসাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হলে তাদের স্বার্থে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ সহজ হয়ে পড়ে। জানা যায়, জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক চার্টারে ‘আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত যে কোনো দেশে জাতিসংঘ সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারবে’—এমন ক্লজ আছে। এ দিক থেকে বিচার করলে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতকে কেন্দ্র করে আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষার নামে জাতিসংঘের মাধ্যমে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই এদেশে চলছে। শান্তি রক্ষার নামে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে আমাদের সেনাসদস্যদের পাঠিয়ে আমরা যেমন জাতীয় গৌরবের ঢাকঢোল বাজাই, পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিসংঘের নেতৃত্বে অন্য কোনো দেশের সৈনিকরা যদি শান্তি রক্ষার নামে এদেশে এসে ঘাঁটি গাড়ে তখন কী আমরা গৌরবের ঢাক-ঢোল বাজাবো? বিষয়টি বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। তাহলে একটা বিষয় পরিষ্কার হবে, যে সব ব্যক্তি, এনজিও ও রাজনৈতিক দল এদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাসমূহকে আদিবাসী বানানোর চেষ্টা করছেন, তারা কার স্বার্থে কাজ করে চলেছেন।
বাংলাদেশে বিদ্যমান ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অসংখ্য মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করেছে। এই সশস্ত্র লড়াইয়ের পরিণতিতে বাংলাদেশ নামক সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অসংখ্য মানুষের অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সমস্যাটা অন্যত্র। সশস্ত্র লড়াইয়ের পরিণতিতে যে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা পেল তার চরিত্র যদি গণতান্ত্রিক হতো তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আজকে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তা কোনোদিনই হতো না। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যে সংবিধান নিয়ে যাত্রা শুরু সেই সংবিধানে বাংলাদেশে বিদ্যমান ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি। সমস্যার বীজ এখানেই নিহিত। তাইতো দেখি, ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর জনসাধারণকে ‘বাঙালি হয়ে যাওয়ার’ কথা বলেন। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে রচিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানেও সব নাগরিককে ‘বাঙালি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বিষয়টি অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর মানুষের কাছে অবমাননাকর মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিভেদের বীজ রচনা হয়েছে এখান থেকেই। প্রতিটি জাতিসত্তা তার আপন জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বোধের স্বাতন্ত্র্যকে কেন্দ্র করেই চলতে চায়। প্রতিটি জাতিসত্তার এই চাওয়াকে রাষ্ট্রীয় সংবিধানে মর্যাদা দান করার মধ্য দিয়েই সব জাতিসত্তার মিলেমিশে চলার রাস্তা পরিষ্কার হয়। এর অন্যথা হলে জাতিগুলোর মধ্যে ব্যবধান বেড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর বাংলাদেশে এটাই হয়েছে। আর এই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে সক্রিয় হয়েছে বিদেশি আধিপত্যবাদী শক্তিসমূহ। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সামরিক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা হিতে বিপরীত হওয়াটাই স্বাভাবিক। বরং এই সমস্যা থেকে উদ্ধার পেতে হলে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ সমান অধিকার নিশ্চিত করার পথেই আমাদের এগুনো দরকার। এই পথে অগ্রসর হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে এই কারণে বলছি যে, বিষয়টি সমাধানের প্রশ্নে সময় অনেক পার হয়ে গেছে, এ সময়ের মাঝে আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো সক্রিয় হয়েছে অনেক বেশি। তাছাড়া নতুন যে বিশ্ব পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সেই পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বৃহত্ শক্তিগুলোর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। তাইওয়ানে আমেরিকার অস্ত্র বিক্রয়, তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাইলামার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার বৈঠক, হাইতিতে ভূমিকম্পকে কেন্দ্র করে সাহায্যকারী হিসেবে এসে মার্কিন ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা, রাশিয়াকে লক্ষ্য করে ইউরোপে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের মার্কিনী তত্পরতা, পারস্য উপসাগরে নতুন করে মার্কিন সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং পারমাণবিক শক্তিধর রাশিয়ার জাতীয় স্বার্থে পরমাণু বোমা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা ইত্যাদি ঘটনা নতুন করে বিশ্বে বৃহত্ শক্তিগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্বের বিষয়টিকে প্রকট করে তুলেছে। সবকিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, অর্থনৈতিক মন্দার কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমেরিকা বড় ধরনের কোনো যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছে। আমেরিকার এ প্রচেষ্টার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সখ্য বৃদ্ধি পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই অবস্থায় বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে বঙ্গোপসাগর এলাকায় আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি আমেরিকার জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। উল্লিখিত বিষয়গুলো লক্ষ্য করলে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় শান্তি রক্ষিবাহিনীর ছদ্মাবরণে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির পরিকল্পনার বিষয়টি থাকতেই পারে। এসব বিষয় হিসাবের মধ্যে নিলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংস ঘটনাকে আরও উস্কে দিয়ে পরিকল্পনামাফিক সামরিক অবস্থান গ্রহণের বিষয়টিকে নিশ্চিত করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের কোন কোন ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দল তাদের সহযোগিতায় মেতে উঠতে পারে। অবস্থা যখন এরকম তখন সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদকে বলতে চাই, (পাহাড়ি এলাকার) অশান্তির পেছনে যেসব কারণ আপনি জানেন তা খোলামেলাভাবে দেশের জনগণের সামনে তুলে ধরুন, কৌশলগত কারণে বলতে পারছেন না— এ অজুহাত তুলে বাংলাদেশের জনগণকে বিপদগ্রস্ত করবেন না। এতে করে আপনার মর্যাদা বাড়বে না, বরং এদেশের জনগণ আপনাকে সংকীর্ণ স্বার্থের প্রতিভূ হিসেবেই চিহ্নিত করবে।
No comments