আজকের ভাবনা ॥ আদিবাসীদের প্রতি সামাজিক বৈষম্যই উন্নয়নের অন্তরায় by এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

রাস্তার পাশে এক দোকান ঘর। দোকানের সামনে বেশ কিছু মানুষ বসে গল্প করছে। কয়েক নারী মাটিতে বসেই শিশুকে বুকের দুধ পান করাচ্ছে। শিশুদের শরীরে কোন কাপড় নেই। শিশুর শরীরের অর্ধাংশ মাটির সঙ্গে গড়াগড়ি খাচ্ছে। শিশুটির শরীরে বাসা বেঁধেছে পাঁচড়া নামক ছোঁয়াচে ঘা। মাছি তার ঘায়ে বারে বারে আক্রমণ করছে।


এই চিত্রটি কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার আদিবাসী বুনোপাড়া কলোনির। কলোনিটি প্রায় ৬৬ শতাংশ জমির ওপর অবস্থিত। ঘরের সাথে ঘর লাগানো। ৪০০-৫০০ জনের বসবাসের এই কলোনি স্যাঁতসেঁতে ও ঘিঞ্জি পরিবেশ বিদ্যমান এবং যেখানে সেখানে মলমূত্র ছড়ানো। এখানকার মানুষদের দেখলেই বোঝা যায় যে, এরা পুষ্টিহীনতাসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে ভুগছে। সকলেরই কঙ্কালসার চেহারা।
কুষ্টিয়ার ৬টি উপজেলায় সর্দার, কোল, বাগদী, বুনো, রাজবংশী, হরিজন, বাঁশফোঁড় ও বিন্দী এই আট সম্প্রদায়ের বসবাস। স্থানীয় গবেষকদের তথ্য মতে, এরা আসামের পাহাড়ী এলাকায় উপজাতি গারো সম্প্রদায়ের অধীনে বসবাস করত। কিন্তু আদিবাসী ও গারো সম্প্রদায়ের মধ্যে কলহের কারণে আদিবাসীরা সুবিধা করতে না পেরে এ দেশে চলে আসে। সভ্যতার এ ক্রান্তি লগ্নে অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। হয়েছে শুধু জীবিকার। সেই পূর্বের জীবিকা তাদের আর নেই। আদিবাসীরা আজ বিভিন্ন কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। জীবিকা নির্বাহে কাজ করে যে পরিমাণ আয় হয়, তা দিয়ে তাদের জীবন চালানো খুবই কষ্টকর। তাদের দৈনিক আয় ৫০-৬০ টাকার মধ্যে। আদিবাসী মহিলারা খুবই কর্মঠ। বর্তমানে এ সব সম্প্রদায়ের আদি পেশা বিলুপ্তির পথে। আদিবাসীরা আইনের আশ্রয় নিলে উল্টো তাদেরকেই পুলিশ দিয়ে হয়রানি এবং ভয়ভীতি দেখানো হয় এবং শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা হয়। কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর থানার রেল স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় আদিবাসী পরিবারের সংখ্যা প্রায় ১০০। এখানকার আদিবাসীরা যৌন নির্যাতনসহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। সেখানে বাইরের কোন লোক গেলে স্থানীয় প্রভাবশালীরা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে লাঞ্ছিত বা হয়রানি করে। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভয়ে আদিবাসীরা কেউ মুখ খুলতে চায় না। তাদের মতে, আমাদের সমস্যা শুনে কি লাভ হবে? আমরা যা তাই থাকব। আদিবাসীদের মধ্যে যে সব সমস্যা দেখা যায় তাহলো মেলামেশার সমস্যা, মজুরির সমস্যা, শিশুদের লেখাপড়া, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, জ্ঞান ও মানসিকতা, নিরাপত্তা না থাকা, ভোটের সময় নিজের ইচ্ছানুযায়ী ভোট দিতে না পারা, বাল্যবিবাহ, জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অসচেতনতা, নিরক্ষরতা, কুসংস্কার, অধিকার সম্পর্কে অসচেতনতা, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা, বিশুদ্ধ পানি ও বিদ্যুতসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা না পাওয়া ইত্যাদি। আদিবাসী সম্প্রদায়ের এক পরিবারের কাছে জানা যায় যে, এদের দৈনন্দিন আয় খুবই সামান্য। যে দিন কাজ থাকে না, সেদিন তাদের উপোস থাকতে হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের কোন নাগরিকের প্রতি বৈষম্য না করার কথা, আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান, ধর্ম-গোষ্ঠী-বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বৈষম্য না করা এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন করার কথা থাকলেও কুষ্টিয়ার আদিবাসীদের ক্ষেত্রে তার উল্টো প্রমাণ মেলে।
আশির দশকেও কুষ্টিয়ার অনেক আদিবাসী পরিবারের জমিজমা ছিল, সংসারে ছিল সুখ-শান্তি। সেসব জমি এরা বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। অভাবের তাড়নায় বন্ধক রাখলেও পরে আর উদ্ধার হয়নি। জাল দলিল করে প্রভাবশালীরা জমি দখল করে নিয়েছে। বছর দুয়েক আগে আওয়ামী লীগ নেতারা দখল করে নিয়েছে খোকসা শমোসপুর আদিবাসী মন্দির। সে সময় তারা ভাঙচুর করে শিবমূর্তি। সরেজমিন আদিবাসী পল্লী বুনোপাড়াতে গিয়ে দেখা যায় সেখানকার বুনোদের জীবন ও জীবিকা। শিক্ষার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নেই এই পল্লীতে। অশিক্ষা আর কুশিক্ষার মধ্যেই বেড়ে উঠছে ভবিষ্যত প্রজন্ম। পুরো পাড়াতে দেড় শতাধিক শিশু রয়েছে যারা কোনদিন স্কুলের দরজা স্পর্শ করেনি। প্রায় এক কিলোমিটার দূরে স্কুল থাকলেও এদের ভাষাগত সমস্যার কারণে শিশুরা পড়াশোনায় আগ্রহ দেখায় না। রোগবালাইয়ে ঝাড়ফুঁক, গাছ-গাছড়ার রস এবং শেষ পর্যন্ত হাতুড়ে চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হতে হয় এদের। ভুল চিকিৎসার কারণে মারা যাওয়ার ঘটনাও আছে। অভাব-অনটনের কারণে ধর্মান্তরিতও হচ্ছে। হারাতে বসেছে নিজেদের জাতিসত্তা। খোকসা উপজেলার হেলালপুর খালের ধারে এখনও টিকে আছে আদিবাসী বিন্দি সম্প্রদায়ের প্রায় ৫০টি পরিবার। বিন্দিদের দাবিÑতাদের আদি প্রধান পেশা সবজি চাষ, সবজি ব্যবসা। তবে নিতান্তই বাধ্য হয়ে মাছ ধরা, দিনমজুরি, মাঠে ফসল কুড়ানো প্রভৃতি পেশায় জীবন নির্বাহের চেষ্টা করে থাকে তারা। মহিলারা শামুক, ঝিনুক, সংগ্রহ করে বিক্রি করে; কিন্তু প্রাকৃতিক উৎস বিল, ঝিল, মাঠ থেকে আয় উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। কুষ্টিয়ার আদিবাসীদের নিয়ে কথা হয় আদিবাসী গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কে. সি বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে জানান, বাংলাদেশের সংবিধান অসংখ্যবার সংশোধন হলেও এমনকি খুনিদের বিচার করা যাবে নাÑএ ধরনের ইনডেমনিটি বিল পর্যন্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হলেও, বিশাল সংবিধানে কোথাও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষকে নিয়ে একটি শব্দ বা একটি লাইনও লিপিবদ্ধ নেই।
সমতল এই আদিবাসীদের উন্নয়নে সরকারের বিশেষ বরাদ্দ থাকলেও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সরকারী কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে এর সুফল আদিবাসীদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতার অভাবে কুষ্টিয়া অঞ্চলের আদিবাসীরা তাদের সব মৌলিক অধিকার ও চাহিদা থেকে বঞ্চিত। আদিবাসীদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় হলেও সমতল আদিবাসীরা এর আওতায় এখনও আসেনি। সমতল আদিবাসীদের এর আওতাভুক্ত করতে হবে। আবার অন্য অঞ্চলের সমতল আদিবাসীদের উন্নয়নে বিভিন্ন এনজিও কাজ করলেও কুষ্টিয়া অঞ্চলের আদিবাসীদের উন্নয়নে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে না। কুষ্টিয়ায় বসবাসরত আদিবাসীদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও বাসস্থান নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া অতি জরুরী হয়ে পড়েছে।
seraj.pramanik@gmail.com,

No comments

Powered by Blogger.