টিপাইমুখে যৌথ সমীক্ষা- দিল্লিতে বিশেষজ্ঞ কমিটির বৈঠক সোমবার by রাহীদ এজাজ

টিপাইমুখ প্রকল্পের যৌথ সমীক্ষার বিষয়ে দুই দেশের বিশেষজ্ঞ কমিটির বৈঠক আগামী সোমবার দিল্লিতে শুরু হচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের বিশেষজ্ঞদের প্রথম বৈঠকে মণিপুরে নির্মাণাধীন বহুমুখী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সমীক্ষার কার্যপরিধি চূড়ান্ত করা হবে।


এর ভিত্তিতে ভারতের মণিপুরে নির্মাণাধীন বৃহদায়তনের ওই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে সমীক্ষা শুরু হবে।
ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে জানিয়েছে, দুই প্রতিবেশী দেশের বিশেষজ্ঞ কমিটির দুই দিনের বৈঠকে বাংলাদেশকে নানা তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করার কথা জানাবে ভারত। এর ভিত্তিতেই আগামী দিনে সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণের মাধ্যমে সমীক্ষা শুরু হবে। বৈঠকে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবেন যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) সদস্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন। ভারতের নেতৃত্ব দেবেন সে দেশের জেআরসির সদস্য দেবেন্দ্র শর্মা।
জানতে চাইলে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জেআরসির আওতাধীন উপকমিটির (বিশেষজ্ঞ কমিটি) প্রথম বৈঠকে টিপাইমুখ প্রকল্পের যৌথ সমীক্ষার কার্যপরিধি চূড়ান্ত হবে। কার্যপরিধির আওতায় বাংলাদেশকে তথ্য-উপাত্ত দেওয়ার পাশাপাশি সমীক্ষায় কীভাবে সহযোগিতা দেওয়া হবে, সেটিও জানাবে ভারত।
জানা গেছে, দিল্লির বৈঠকে ভারতের মণিপুরে নির্মাণাধীন বৃহদায়তনের এ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে বাংলাদেশকে অবহিত করবে ভারত। অর্থাৎ বর্তমানে প্রকল্পের কাজ কী পর্যায়ে রয়েছে, তা জানানো হবে। এ ছাড়া প্রকল্পটিতে বাংলাদেশকে অংশীদার করার বিষয়ে দুই দেশের বিশেষজ্ঞরা কথা বলবেন।
টিপাইমুখ প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাবসংক্রান্ত সমীক্ষা শুধু প্রকল্পের জলাধারসংলগ্ন ১০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে করা হয়েছে। অন্যদিকে, ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে করা সমীক্ষায়ও বিবেচিত হয়েছে প্রকল্প এলাকার আশপাশ। আর বাঁধে ফাটলসংক্রান্ত সমীক্ষা চালানো হয়েছে প্রকল্পসংলগ্ন বদরহাট এলাকা পর্যন্ত। ফলে টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে কি না, তা উপেক্ষিত থেকেছে ভারতের পরিচালিত সমীক্ষায়। এ প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যৌথ সমীক্ষার প্রস্তাব দেওয়া হয়, যাতে শেষ পর্যন্ত সায় দেয় ভারত।
সমীক্ষার অগ্রাধিকারগুলো: পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভারতের কাছে তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার পর সমীক্ষা পরিচালনার সময় টিপাইমুখ বাঁধের পরিপ্রেক্ষিতে বরাক অববাহিকার পানিসম্পদ, পরিবেশ, প্রতিবেশ, ভূমিকম্প, আর্থসামাজিক, কৃষি, মৎস্য চাষ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোতে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
কার্যপরিধি অনুযায়ী, টিপাইমুখ প্রকল্প নির্মিত হলে বাংলাদেশ ও ভারতে পানি, পরিবেশ ও ভূমিকম্পসহ ভূ-প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটে কী ধরনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তা সমীক্ষা দল তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করবে। পাশাপাশি প্রকল্পটি আর্থসামাজিক ও জনসংখ্যার প্রেক্ষাপটে কী প্রভাব ফেলে, তা-ও খতিয়ে দেখা হবে। টিপাইমুখ প্রকল্পের প্রস্তাবিত জলাধার নির্মিত হলে বরাক-সুরমা-কুশিয়ারা নদী অববাহিকার পানিসম্পদে কী পরিবর্তন হবে, তা যাচাই করা হবে যৌথ সমীক্ষায়। টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তা দুই দেশের কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, পানিতে লবণাক্ততা, নদীর নাব্যতা এবং মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের প্রভাব খতিয়ে দেখা হবে। পাশাপাশি প্রকল্পের কারণে বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমে উজান ও ভাটির সমতল ও জলাভূমির জীববৈচিত্র্যে এ প্রকল্পের প্রভাব যাচাই করা হবে। বিশেষ করে, দুই দেশের নদীগুলো এবং হাওরাঞ্চলে পানি চলাচল বোরো আবাদে বাধা সৃষ্টি করে কি না এবং উজানের ঢলের মাধ্যমে আকস্মিক বন্যায় কী প্রভাব রাখছে, তা সমীক্ষায় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিভিন্ন বিষয়ে সমীক্ষার পর প্রকল্পের ফলে কী কী উপকার হতে পারে এবং বিরূপ প্রভাব কীভাবে প্রশমন করা যায়, এ বিষয়ে অভিযোজনের পরিকল্পনা তৈরি করবে। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা একটি পরিকল্পনাসংবলিত প্রতিবেদন তৈরি করতে বছর দুয়েক সময় নিতে পারেন।
যা থাকছে টিপাইমুখ প্রকল্পে: ভারতের মণিপুর রাজ্যের বরাক নদের ওপর বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ২১০ কিলোমিটার উজানে তুইভাই নদীর মোহনায় এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। গত বছরের ২২ অক্টোবর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ন্যাশনাল হাইড্রো পাওয়ার করপোরেশন (এনএইচপিসি) ও সালতুজ জলবিদ্যুৎ নিগমের (এসজেভিএন) সঙ্গে মণিপুর রাজ্য সরকার একটি যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি সই করেছে।
টিপাইমুখ প্রকল্পের নেতৃত্বদানকারী সংস্থা এনএইচপিসির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেড় হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রায় ২০০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত টিপাইমুখের প্রকল্পটিতে ২২ হাজার হেক্টর জমিতে পানি সংরক্ষণ করা হবে। ১৬২ দশমিক ৮ মিটার উঁচু বাঁধের মাধ্যমে এ পানি সংরক্ষণের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে প্রায় ৯০০ কোটি কিউবিক মিটার পানি ধরে রাখা হবে মূলত বন্যার সময়। তবে পানির প্রাপ্যতা অর্থাৎ যে পরিমাণ ধরে রাখা হবে, তার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। প্রকল্পটিতে সেচের ব্যবস্থা না থাকায় পানির গতিরোধের কোনো সুযোগ থাকছে না।
এনএইচপিসির কর্মকর্তাদের মতে, বন্যা নিয়ন্ত্রণের অনুষঙ্গ থাকায় টিপাইমুখ প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে গেছে। তাই এ প্রকল্পের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি হবে। ফলে প্রকল্পের আর্থিক লাভ-ক্ষতি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.