সময়চিত্র-পঞ্চম সংশোধনী রায়: বিতর্ক ও বিভ্রান্তি by আসিফ নজরুল

পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় নিয়ে বিতর্ক চলছে দেশে। এই বিতর্ক সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে হলে ভালো হতো, সেখানে হওয়াই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু আপিল বিভাগ এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ শুনানি করতে রাজি নন। শুনানির জন্য দায়েরকৃত আবেদনগুলো তাঁরা ইতিমধ্যে খারিজ করে দিয়েছেন।


হাইকোর্ট বিভাগে নিষ্পত্তিকৃত কোনো মামলায় ‘সংবিধান-ব্যাখ্যা বিষয়ে আইনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন’ জড়িত থাকলে ওই মামলায় রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাওয়া যায়। সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে হাইকোর্ট বিভাগ নিজেই এ ধরনের মামলায় আপিল বিভাগে যাওয়ার পক্ষে সার্টিফিকেট প্রদান করতে পারেন। পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের ৩৪তম অংশের প্রথম অনুচ্ছেদে বিচারক বলেছেন, এই মামলায় যেসব বিষয়ের নিষ্পত্তি করা হচ্ছে, সেগুলো শাসনতান্ত্রিক ও জাতীয়ভাবে চরম গুরুত্বপূর্ণ (আটমোস্ট কনস্টিটিউশনাল অ্যান্ড ন্যাশনাল ইম্পোর্টেন্স)। এই চরম গুরুত্বপূর্ণ মামলার পূর্ণাঙ্গ আপিল শুনানি হলে দুই পক্ষের তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে বহু বিষয়ে বিভ্রান্তি দূর হতো। সেসব বিভ্রান্তি এখনো দূর করা সম্ভব। আপিল বিভাগ বলেছেন, তাঁরা হাইকোর্টের রায় পরিমার্জনা করবেন এবং কিছু বিষয়ে এর পর্যবেক্ষণ জানাবেন। এর মানে সম্ভবত এই যে হাইকোর্টের রায়টি অবিকৃতভাবে আপিল বিভাগ বহাল রাখবেন না এবং রায়ে হাইকোর্টের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণকে আপিল বিভাগ পূর্ণাঙ্গ বা নিখুঁত মনে করছেন না।

২.
পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় নিয়ে তাই বলে বিতর্ক থেমে নেই। এই বিতর্কের বহু কিছু করা হচ্ছে রায় না পড়ে, না বুঝে বা বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে। যেমন: কেউ কেউ বলছেন, এই রায়ের মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসন অর্থাত্ বাকশাল পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। রায়ে আসলে বঙ্গবন্ধুর আমলে প্রবর্তিত বাকশালের বাতিলকেই বরং সমর্থন করা হয়েছে। এতে পঞ্চম সংশোধনীকে পুরোপুরি অবৈধ বলা হয়েছে, চতুর্থ সংশোধনীর সরাসরি সমালোচনা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনী দ্বারা চতুর্থ সংশোধনীর যেসব বিধান বাতিল করা হয়েছে, তা বহাল রেখে প্রকারান্তরে দুই সংশোধনীর বিরোধের ক্ষেত্রগুলোতে পঞ্চমটির পক্ষে হাইকোর্ট মত দিয়েছে। কেন দিয়েছে, এর সপক্ষে তিনটি সুপ্রাচীন নীতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে—এক. যা অন্যভাবে আইনসম্মত নয়, প্রয়োজনীয়তা তাকে আইনসম্মত করে তোলে। দুই. জনগণের নিরাপত্তা হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। তিন. রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। অর্থাত্ বলা যায়, রায়ে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন এবং জনগণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার নিরিখে গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্বকারী চতুর্থ সংশোধনীকে বাতিল করার পদক্ষেপকে সমর্থন করা হয়েছে।
বাকশাল বা একদলীয় শাসন ফিরে আসার ভয় তাই যাঁরা দেখাচ্ছেন, তাঁরা হয়তো খুব সত্ উদ্দেশ্যে এসব বলছেন না। পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের এই দিকটি নিয়ে বিতর্ক অপ্রয়োজনীয়। আবার রায়ের অন্য যেসব বিষয় নিয়ে সমাজে আলোচনা বা বিতর্ক সুফলদায়ক হতে পারে, তা এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে কিছু ক্ষেত্রে। যেমন: রায়ে সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ (এবং আরও কিছু অনুচ্ছেদ) আদি বা মূল সংবিধানে যেমন ছিল, সেভাবেই বহাল রইল বলা হয়েছে। আমাদের আদি সংবিধান হচ্ছে ১৯৭২ সালের সংবিধান। এই সংবিধানের ১৪২ নম্বর অনুচ্ছেদে সংবিধান সংশোধনীর প্রক্রিয়া বর্ণনা করা আছে। এই অনুচ্ছেদের প্রথম পরিবর্তনগুলো আনা হয় ১৯৭৩ সালে দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে। এই পরিবর্তনগুলোকে পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে কিছু ছোটখাটো পরিবর্তন (সাম মাইনর চেঞ্জেস্) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আমার ধারণা, বহু মানুষের কাছে এগুলো সামান্য পরিবর্তন মনে হবে না। যেমন: দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ১৪২ অনুচ্ছেদে একটি নতুন অংশ যোগ করা হয়, যা জনগণের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। এই নতুন অংশে (১৪২.২) বলা হয় যে সংবিধান সংশোধনীর ক্ষেত্রে ২৬ অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই প্রযোজ্য হবে না। ২৬ অনুচ্ছেদ আদি সংবিধানের একটি মহান বিধান। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত সংবিধানের অনুচ্ছেদগুলোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে কোনো আইন বা সংবিধান সংশোধনী করা হলে তা যতটুকু অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততটুকু বাতিল হয়ে যাবে। দ্বিতীয় সংশোধনীতে ২৬ অনুচ্ছেদ সংবিধান সংশোধনীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, এটি অন্তর্ভুক্ত করে প্রকারান্তরে জাতীয় সংসদকে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে মৌলিক মানবাধিকার হরণ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই সংশোধনীতে ১৪২ অনুচ্ছেদের আরও কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে, যা মোটেও ছোটখাটো বা সামান্য পরিবর্তন নয়।
পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের সারাংশে মূল সংবিধানের (অর্থাত্ ১৯৭২ সালের সংবিধান) ১৪২ অনুচ্ছেদ অবিকৃতভাবে বহাল থাকবে বলা হয়েছে। অথচ রায়ের ৩৫তম পার্টে প্রদত্ত তালিকায় মূল সংবিধানের বিধান হিসেবে যেভাবে ১৪২ অনুচ্ছেদকে ছাপানো হয়েছে, তা আসলে মূল সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ নয়। এখন রায় পড়ে আমরা কী বুঝব? ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৪২, নাকি দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তিত ১৪২ অনুচ্ছেদ? কোনটি বহাল রাখার কথা বলেছে হাইকোর্ট?

৩.
পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে আরও কিছু অসংগতি বা অস্পষ্টতা রয়েছে। যেমন: রায় অনুসারে ধর্মনিরপেক্ষতা যদি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বা বিসিমল্লাহর উল্লেখ থাকে কীভাবে? বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্রমবিকাশকালে ধর্মনিরপেক্ষতা কখনো খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা বা সত্তরের নির্বাচনের ম্যানিফেস্টোতে ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখ নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের মানুষের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার কথা বলা আছে, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা নেই। অবশ্য স্বাধীনতা সংগ্রামকালের অভিজ্ঞতা বিবেচনা রেখেই হয়তো ১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং ৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা আছে। একই সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি হিসেবে রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদানের বিলোপ করার কথা বলা হয়েছে। অথচ এরশাদের আমলে সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের ৮ ও ১২ অনুচ্ছেদে পুনঃস্থাপিত হলে ২ক অনুচ্ছেদ সংবিধানে থাকতে পারে না। সংবিধানে উল্লিখিত থাকতে পারে না বিসিমল্লাহির রহমানির রহিম শব্দগুচ্ছও। পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে বলা আছে যে এই শব্দগুচ্ছ সংবিধানের প্রস্তাবনার আগে উল্লিখিত আছে বলে এটি সংবিধানের অংশ নয়। তার মানে কি এই যে, যা সংবিধানের অংশ নয়, তা বাদ দিয়েই সংবিধান ছাপানো যেতে পারে? এই প্রশ্নে কোনো স্পষ্টতা নেই রায়ে।
রায়ে পুরো পঞ্চম সংশোধনীর একটিমাত্র সামরিক ফরমানের পরিবর্তনকে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে Second Proclamation Order No. IV of 1976। এই প্রক্লেমেশনে চতুর্থ সংশোধনীর একটি বিধানকে বাতিল করে ১৯৭২ সালের সংবিধানের অনুরূপ একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিকে এককভাবে প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের প্রক্লেমেশনে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে অন্যান্য বিচারক নিয়োগ করতে হবে। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে যেসব সামরিক ফরমান, আদেশ, নির্দেশকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে, তার সবই হাইকোর্টের রায়ে পুরোপুরি অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। সবই যদি অবৈধ হয়, তাহলে উপরোক্ত প্রক্লেমেশন বা ফরমানটি দ্বারা সাধিত পরিবর্তন বৈধ (valid) হলো কীভাবে, তার কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা রায়ে নেই।

৪.
পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে পৃথিবীর বিভিন্ন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ও আইনবেত্তার অভিমত উল্লেখ করে বহু প্রয়োজনীয় বিষয়ের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সুশক্ত আইনগত অবস্থানকে তুলে ধরা হয়েছে। এই রায় সামরিক শাসনের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি রুদ্ধ না করতে পারলেও একে যতভাবে সম্ভব নিরুত্সাহিত করা হয়েছে। এতে সামরিক শাসন জারি করা, বহাল রাখা এবং একে বৈধতা দেওয়ার পদক্ষেপগুলোতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর এমনকি বিচারকদের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। এই রায় এত বেশি বিস্তৃত এবং সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে পারে যে, একে সমৃদ্ধতর করার যত বেশি প্রচেষ্টা থাকবে, ততই মঙ্গলজনক।
আশার কথা হলো, আপিল বিভাগের এই রায়ের পরিমার্জনা এবং এতে তার পর্যবেক্ষণ সংযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। আপিল বিভাগের চূড়ান্ত বা পূর্ণাঙ্গ আদেশ পাওয়ার পর এর ওপর ভিত্তি করে জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধনীর উদ্যোগ নেওয়া হলে অনেক আইনগত জটিলতার নিরসন হতে পারে। তা না করে আদালতের রায় নিজের মতো করে বুঝে নিয়ে আইন মন্ত্রণালয় সংবিধান ছাপানোর উদ্যোগ নিলে ভবিষ্যতে শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হবে। এ বিষয়ে কেউ কেউ অষ্টম সংশোধনী মামলার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সংসদে যাওয়ার প্রয়োজন নেই বলছেন। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ে অষ্টম সংশোধনীর একটি বিষয়কে (দেশের বিভিন্ন স্থানে হাইকোর্টকে বিকেন্দ্রীকরণসংক্রান্ত) বাতিল করা হয়েছিল। অন্যদিকে পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে একটি দীর্ঘ সময়কালের কিছু সংশোধনী বাতিল, কিছু রেখে দেওয়া, কিছু বিধানের তুলনামূলক গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে অভিমত দেওয়া হয়েছে। কিছু সংশোধনীর বিষয়ে (যেমন দ্বিতীয় সংশোধনী) হাইকোর্টের রায় খুব বোধগম্যও নয়।
আপিল বিভাগের চূড়ান্ত আদেশ প্রাপ্তির পর এ বিষয়ে সংসদে খোলামেলা আলোচনা তাই আমরা প্রত্যাশা করি। এই আলোচনার মাধ্যমে সংবিধানের পুরো পর্যালোচনা করে একটি সার্বিক সংশোধনীর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। বাংলাদেশের সংবিধানে এখন পর্যন্ত যেসব সংশোধনী আনা হয়েছে, তার অধিকাংশই মূল সংবিধানকে খর্বিত করেছে, জনগণের অধিকার ও আইনের শাসনকে দুর্বল করেছে। এমনকি মূল সংবিধানেও কিছু বিষয় রয়েছে (যেমন: ৭০ অনুচ্ছেদ), যার সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। সেই অধিকার ও ম্যান্ডেট সংসদের রয়েছে। সংসদই পারে পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়কে ইতিবাচক ও কল্যাণকর পরিবর্তনের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করতে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.