বিশ্বজনের কবি by করুণাময় গোস্বামী
১৯৩০ সালের ২৫ নভেম্বর নিউ ইয়র্কের বিল্টমোর হোটেলে রবীন্দ্রনাথকে নাগরিক সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। নিউ ইয়র্কের ৩৫০ জন গণ্যমান্য নাগরিকের উদ্যোগে এই সংবর্ধনার আয়োজন। আমেরিকার ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ ও মাত্র নোবেল পুরস্কার অর্জনকারী সিনক্লেয়ার লুইস তাঁদের মধ্যে ছিলেন।
কয়েক দিন আগে রবীন্দ্রনাথ মৃদু হার্ট-অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়েছিলেন। স্বভাবতই তিনি দুর্বল বোধ করছিলেন। ইয়েন বিশ্ববিদ্যালয়ে সে জন্য বক্তৃতা করতে পারেননি। কিন্তু বিল্টমোর হোটেলে নাগরিক সংবর্ধনা সভায় যখন এলেন, তাঁকে বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছিল। সংবর্ধনা জ্ঞাপক বক্তৃতাদির পর রবীন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়ালেন সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেবেন বলে। তিনি বললেন, 'আপনাদের অভিনন্দনের উত্তর দিতে আমি যখন দাঁড়িয়েছি, তখন আমার আরো তরুণ, আরো জোরদারি থাকা উচিত ছিল। বিশ্বমায়ের মহান সন্তানদের মধ্যে আছেন আপনারা। প্রাচ্যদেশে আমরা যে কী পরিমাণ যন্ত্রণা ভোগ করছি, সে আপনারা জানেন না বা বুঝতে পারবেন না। আপনাদের ও আমাদের মধ্যে সহায়-সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে একটা বিরাট ব্যবধান আছে। আমি পাশ্চাত্যকে ভালোবাসি ও এর প্রশংসা করি। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অসামান্য অর্জন দিয়ে পাশ্চাত্য সমগ্র মানবজাতির ভবিষ্যৎ উন্নয়নকে সুগম করছে।' ভারতবর্ষে এসে সেখানকার মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণার স্বরূপ অনুধাবনের জন্য সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন, 'যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভারতবর্ষে আসুন, সেখানকার অর্জনে আপনাদেরও ভাগ আছে। যেসব অর্জনের শাশ্বত মূল্য আছে, সেসব কোনো দেশে বা কালে সীমাবদ্ধ নয়, সেসব সকল কালের, সকল মানুষের। আমাদের কাছে আসুন, আমাদের গ্রহণ করুন, আমাদের প্রাপ্য মর্যাদা দিন এবং বুঝতে চেষ্টা করুন যে, সবাই আমরা ভাই।' সে বছর ১৪ ডিসেম্বর রাতে ব্রডওয়ে থিয়েটারে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। রবীন্দ্রনাথ সেখানে তাঁর কবিতা আবৃত্তি করবেন এবং বিখ্যাত আমেরিকান নৃত্যশিল্পী রুথ ডেনিস ও তাঁর দল নাচবেন। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করলেন স্বনামধন্য দার্শনিক উয়িল ডুরান্ট। তিনি উদ্বোধনী মন্তব্যে রবীন্দ্রনাথকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, 'আপনি যে একজন ভারতীয় সেটাই যথেষ্ট- ভারত কেন স্বাধীন হবে, সে জন্যে।' পরদিন পত্রিকার খবরে বেরোয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিপ্রায় অনুযায়ী অনুষ্ঠান থেকে অর্জিত যাবতীয় অর্থ নিউ ইয়র্কের বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য গঠিত তহবিলে দান করা হয়। মানুষ যে মানুষের ভাই, তা স্পষ্ট করে রবীন্দ্রনাথ বোঝালেন তাঁর এই দান অভিপ্রায় দিয়ে।
১৯৩১ সালের মে মাসে রবীন্দ্রনাথের সত্তরতম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের জন্য শান্তিনিকেতনে ও কলকাতায় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো। এর মধ্যে একটি ছিল রবীন্দ্রনাথকে জানেন ও ভালোবাসেন এমন বিশ্বমনীষীদের কাছ থেকে লেখা বা বার্তা নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ করা। সে সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। উয়িল ডুরান্ট, কয়েক মাসে যিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেছেন ও মতবিনিময় করেছেন, তাঁর বার্তায় বললেন, "আমরা মনে করি যে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারার সুযোগে আমরা পরিশুদ্ধ হয়েছি, আপনার দর্শন আমাদের মহত্ত্ব দিয়েছে। আপনাকে দেখা মাত্র আমাদের মনে হয়েছে, আমরা বিশ্বাসের একটি নতুন অবলম্বন পেলাম, আমাদের মনে হলো, যৌবনে আমরা যেসব মূল্যবোধকে সর্বোচ্চ গৌরবে আঁকড়ে ধরেছিলাম, সেগুলো অবলম্বন করে এখনো বাঁচা সম্ভব। আপনি এখানে আসার আগে আমরা সব শুভবোধ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে বলে মনে করতাম, মনে করতাম আদর্শ মিথ্যে, আশা মিথ্যে; কিন্তু আপনাকে দেখা মাত্র আমাদের মনে হলো, আমাদের সে ভাবনা সত্যি নয়, সত্য ও শক্তির যুদ্ধে সত্য এখনো পরাভূত হয়নি, এখনো বেঁচে থাকার অর্থ অবশিষ্ট আছে, আমাদের মৃত্যুর পরও জীবনের এই শাশ্বত অর্থ অবশিষ্ট থাকবে। আপনার কাব্যের গদ্য ও সংগীত প্রাচ্যের প্রাচীন আদর্শবাদকে আপনি আমাদের রক্তপ্রবাহে ঢেলে দিয়েছেন, আপনার জীবনের জমজমাট দৃষ্টান্ত আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে।' ব্যারট্র্যান্ড রাসেল বললেন, 'আমাদের সময়কালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজ, জাতিতে জাতিতে বোঝাপড়া গড়ে তোলা, তাতে তাঁর সমতুল্য অবদান কেউ রাখেননি। ভারতবর্ষে তাঁর কী অবদান, সেটি আমার বলার এখতিয়ারে নয়; কিন্তু ইউরোপ ও আমেরিকার ক্ষেত্রে তিনি কী করেছেন সে আমি বলতে পারি। এই আন্তর্জাতিক বোঝাপড়া গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি তাঁদের কুসংস্কারকে নমনীয় করার ও ভুল বোঝাবুঝি দূর করার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড অবদান রেখেছেন। আমি বিশ্বাস করি, এই একটি অবদানের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান তিনি পেতে পারেন।'
বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতির ভুক্তভোগী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ১৫১তম জন্মদিনে এই কয়েকটি কথা বরবার মনে পড়ছে। কথাগুলো বলেছিলেন বিশ শতকের অতিবিশিষ্ট দুই দার্শনিক ব্যারট্র্যান্ড রাসেল ও উয়িল ডুরান্ট। কোথায় নিউ ইয়র্ক, কোথায় কলকাতা বা শান্তিনিকেতন। কোথায় আমেরিকা, কোথায় ভারত। অথচ ডুরান্ট বলছেন, রবীন্দ্রনাথকে দেখেই তাঁর মনে হয়েছে, বেঁচে থাকার সব অর্থ নিঃশেষ হয়ে যায়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষের ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা ও বিজ্ঞানবুদ্ধিকে নিষ্ঠুরতার কাজে লাগানোর বিস্তার দেখে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনে হয়েছিল, এই পৃথিবী এখন আর বসবাসের উপযুক্ত থাকবে না, বৈজ্ঞানিক-দানবিক শক্তি যা খুশি তা করবে, সবাইকে নীরবে তা সহ্য করতে হবে। রবীন্দ্রনাথকে দেখা মাত্র ডুরান্টের মতো দার্শনিকের মনে হলো, সব আশা এখনো শেষ হয়নি, এখনো জীবনের মানে অবশিষ্ট আছে, তাঁর মৃত্যুর পরও থাকবে। সে কী এক মহান স্বীকার। কোথাকার কবি কোথায় গিয়ে নিজের উপস্থিতি দিয়েই বুঝিয়ে দিলেন, জীবনের সব শেষ হয়নি, দানবিকতা শেষ কথা নয়। রাসেল বললেন, অবশিষ্ট পৃথিবীর প্রতি ইউরোপীয় ও আমেরিকান দৃষ্টিভঙ্গিকে কুসংস্কারমুক্ত করতে ও নমনীয় করে জাতিতে জাতিতে বিভেদ ঘোচাতে তিনি যে অবদান রেখেছেন, তার জন্য রবীন্দ্রনাথকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সম্মান জানানো উচিত।
সে তো ১৯৩১ সালের কথা। এর পরে বিশ্বপ্রেক্ষাপটে কত পরিবর্তন এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেল। জাপানে আণবিক বোমা ফাটল। আণবিক শক্তির ভয়ংকরতায় মানুষ আতঙ্কিত হয়ে উঠল। তৃতীয় বিশ্বের পরাধীন দেশগুলো স্বাধীন হলো। কোথাও গণতন্ত্র, কোথাও স্বৈরতন্ত্র, কোথাও ধর্মতন্ত্র, কোথাও ছদ্মবেশী একনায়কতন্ত্রের মিছিল নিয়ে মানুষের ইতিহাস এক নতুন সহস্রাব্দের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ানো। সেই সঙ্গে স্থির হলো কিছু মিলেনিয়াম গোল। একদিকে খেতে-পরতে পায় না কিছু দেশ, আণবিক বোমা বানাতে শুরু করল, দেশে খাদ্য ঘাটতি থাকলে থাকতে পারে, কিন্তু মিসাইল ঘাটতি থাকতে পারবে না, এমন সংকল্পেও কেউ কেউ অটল থাকতে থাকলেন। অন্যদিকে দেখা গেল, এক বিশ্ব বানানোর মধুর প্রতিশ্রুতি। মুক্তির আযান উঠল ব্যবসায়ের গদি থেকে। মুক্তবাণিজ্য, মুক্ত আকাশ, পরস্পর কাছে আসার যাবতীয় উপায়-উপকরণ মুক্ত হয়ে গেল। ফলে এই সহস্রাব্দ হয়ে দাঁড়াল, স্লোগানে অন্তত মুক্তির ও যুক্তির। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বা অতি ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, মানুষের ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত করার যাবতীয় উপায়-উপকরণ মানুষের হাতে থাকা সত্ত্বেও মানুষ কোথাও পাচ্ছে না মুক্তি, কোথাও ঘটছে না যুক্তি এমন ব্যাপকভাবে যে মানুষ একত্রে নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারে। অথচ ভয়ংকরের মধ্যে বিজ্ঞানের শুভংকর যে অর্জন, তাতে শত শত বছর ধরে মানুষ অতিনিশ্চিন্তে হেসে-খেলে পৃথিবীতে থাকতে পারে। কিন্তু তেমন যে পারা যাবে না, সে বোধই দিন দিন দানা বাঁধছে। নিত্য-নিয়ত হিংসার সংবাদ অনিশ্চয়তাকে তীব্র থেকে তীব্র করে তুলছে।
এই পরিস্থিতিতে আমরা একজন বিশ্বকবি চাই। আমাদের কোনো বিশ্বকবি নেই, আমাদের বলতে আমি সারা পৃথিবীর মানুষকে বোঝাচ্ছি। এখন কোথাও কোনো বিশ্বমানের নেতা নেই, বিশ্বমানের সংস্কারক নেই। এমন কেউ নেই যে বোঝাবেন, আমরা সবাই ভাই, এমন কেউ নেই যে, যাঁকে দেখা মাত্র মনে হবে, পৃথিবী আবার বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। রবীন্দ্রনাথকে দেখলে এমন হতো, তাঁর রচনার উদ্দীপনা ও সংগীত পাঠককে আশ্বস্ত করত যে ভয়ের কিছু নেই, শাশ্বত মঙ্গল তার স্থান করে নেবেই। এখন মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের জন্য সশরীরে উপস্থিত থাকার এটিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। মানুষকে মিলিত করার আকঙ্ক্ষায় তিনি যে অমানবিক পরিশ্রম করেছেন, সে আর করতে হতো না। ঘরে বসে অনেক কাজ কতে পারতেন, যার জন্য তিনি মাসের পর মাস সমুদ্রে ভেসে বেরিয়েছেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর থেকে তিনি যে বিশ্ব অভিভাবকের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, সে ভূমিকা এখন আর কোনো কবি বা দার্শনিক গ্রহণ করছেন না। সর্বত্র এমন এক বামনের রাজত্ব কায়েম হয়েছে যে বড় কাউকে দেখাই যাচ্ছে না। পৃথিবীকে শেখাতে পারে এমন কোনো মহৎ আহ্বান নেই। অথচ এখনই তো সময় বলবার যে মানব জন্ম একটা অমূল্য ব্যাপার, তাকে সন্ত্রাসিত করে রাখার কোনো মানে নেই। সে এক মহাপাপ। এই বার্তা দিয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের প্রাণকে স্পর্শ করবেন কে, কে বলবেন উপনিষদের সেই কথা, লোভ করো না। আজ লাভের ও লোভের কবলে পড়ে ব্যবসায়িক শোষণ দানব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দানবকে পরাভূত করার জন্য চিরন্তন মানববুদ্ধিকে কে জাগাবে? এমন তো কেউ নেই এখন, যার কথা পৃথিবী শুনবে। এই জায়গাটা নিতান্তই শূন্য যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববার্তা নিয়ে এই শূন্যস্থান পূর্ণ করতে একটা বৈশ্বিক উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ নিজে বলেছেন, আমি পৃথিবীর কবি। কোনো অত্যুক্তি নেই তাতে। রবীন্দ্রনাথকে অনুধাবন করলে যে কেউ বুঝবেন, তিনি পৃথিবীর কবি, সত্যি সত্যি। একালে তিনিই একমাত্র কবি, যিনি মানুষের মধ্যকার যাবতীয় বিভেদ ঘোচাতে এবং শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে জীবনভর কাজ করেছেন। আজ তিনি নেই। তাঁকে নিয়েই একটি বিশ্বউদ্যোগ কামনা করি, মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন শুরু করার জন্য। সে উদ্যোগের সূচনা আমরাও করতে পারি।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
১৯৩১ সালের মে মাসে রবীন্দ্রনাথের সত্তরতম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের জন্য শান্তিনিকেতনে ও কলকাতায় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো। এর মধ্যে একটি ছিল রবীন্দ্রনাথকে জানেন ও ভালোবাসেন এমন বিশ্বমনীষীদের কাছ থেকে লেখা বা বার্তা নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ করা। সে সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। উয়িল ডুরান্ট, কয়েক মাসে যিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেছেন ও মতবিনিময় করেছেন, তাঁর বার্তায় বললেন, "আমরা মনে করি যে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারার সুযোগে আমরা পরিশুদ্ধ হয়েছি, আপনার দর্শন আমাদের মহত্ত্ব দিয়েছে। আপনাকে দেখা মাত্র আমাদের মনে হয়েছে, আমরা বিশ্বাসের একটি নতুন অবলম্বন পেলাম, আমাদের মনে হলো, যৌবনে আমরা যেসব মূল্যবোধকে সর্বোচ্চ গৌরবে আঁকড়ে ধরেছিলাম, সেগুলো অবলম্বন করে এখনো বাঁচা সম্ভব। আপনি এখানে আসার আগে আমরা সব শুভবোধ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে বলে মনে করতাম, মনে করতাম আদর্শ মিথ্যে, আশা মিথ্যে; কিন্তু আপনাকে দেখা মাত্র আমাদের মনে হলো, আমাদের সে ভাবনা সত্যি নয়, সত্য ও শক্তির যুদ্ধে সত্য এখনো পরাভূত হয়নি, এখনো বেঁচে থাকার অর্থ অবশিষ্ট আছে, আমাদের মৃত্যুর পরও জীবনের এই শাশ্বত অর্থ অবশিষ্ট থাকবে। আপনার কাব্যের গদ্য ও সংগীত প্রাচ্যের প্রাচীন আদর্শবাদকে আপনি আমাদের রক্তপ্রবাহে ঢেলে দিয়েছেন, আপনার জীবনের জমজমাট দৃষ্টান্ত আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে।' ব্যারট্র্যান্ড রাসেল বললেন, 'আমাদের সময়কালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজ, জাতিতে জাতিতে বোঝাপড়া গড়ে তোলা, তাতে তাঁর সমতুল্য অবদান কেউ রাখেননি। ভারতবর্ষে তাঁর কী অবদান, সেটি আমার বলার এখতিয়ারে নয়; কিন্তু ইউরোপ ও আমেরিকার ক্ষেত্রে তিনি কী করেছেন সে আমি বলতে পারি। এই আন্তর্জাতিক বোঝাপড়া গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি তাঁদের কুসংস্কারকে নমনীয় করার ও ভুল বোঝাবুঝি দূর করার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড অবদান রেখেছেন। আমি বিশ্বাস করি, এই একটি অবদানের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান তিনি পেতে পারেন।'
বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতির ভুক্তভোগী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ১৫১তম জন্মদিনে এই কয়েকটি কথা বরবার মনে পড়ছে। কথাগুলো বলেছিলেন বিশ শতকের অতিবিশিষ্ট দুই দার্শনিক ব্যারট্র্যান্ড রাসেল ও উয়িল ডুরান্ট। কোথায় নিউ ইয়র্ক, কোথায় কলকাতা বা শান্তিনিকেতন। কোথায় আমেরিকা, কোথায় ভারত। অথচ ডুরান্ট বলছেন, রবীন্দ্রনাথকে দেখেই তাঁর মনে হয়েছে, বেঁচে থাকার সব অর্থ নিঃশেষ হয়ে যায়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষের ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা ও বিজ্ঞানবুদ্ধিকে নিষ্ঠুরতার কাজে লাগানোর বিস্তার দেখে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনে হয়েছিল, এই পৃথিবী এখন আর বসবাসের উপযুক্ত থাকবে না, বৈজ্ঞানিক-দানবিক শক্তি যা খুশি তা করবে, সবাইকে নীরবে তা সহ্য করতে হবে। রবীন্দ্রনাথকে দেখা মাত্র ডুরান্টের মতো দার্শনিকের মনে হলো, সব আশা এখনো শেষ হয়নি, এখনো জীবনের মানে অবশিষ্ট আছে, তাঁর মৃত্যুর পরও থাকবে। সে কী এক মহান স্বীকার। কোথাকার কবি কোথায় গিয়ে নিজের উপস্থিতি দিয়েই বুঝিয়ে দিলেন, জীবনের সব শেষ হয়নি, দানবিকতা শেষ কথা নয়। রাসেল বললেন, অবশিষ্ট পৃথিবীর প্রতি ইউরোপীয় ও আমেরিকান দৃষ্টিভঙ্গিকে কুসংস্কারমুক্ত করতে ও নমনীয় করে জাতিতে জাতিতে বিভেদ ঘোচাতে তিনি যে অবদান রেখেছেন, তার জন্য রবীন্দ্রনাথকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সম্মান জানানো উচিত।
সে তো ১৯৩১ সালের কথা। এর পরে বিশ্বপ্রেক্ষাপটে কত পরিবর্তন এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেল। জাপানে আণবিক বোমা ফাটল। আণবিক শক্তির ভয়ংকরতায় মানুষ আতঙ্কিত হয়ে উঠল। তৃতীয় বিশ্বের পরাধীন দেশগুলো স্বাধীন হলো। কোথাও গণতন্ত্র, কোথাও স্বৈরতন্ত্র, কোথাও ধর্মতন্ত্র, কোথাও ছদ্মবেশী একনায়কতন্ত্রের মিছিল নিয়ে মানুষের ইতিহাস এক নতুন সহস্রাব্দের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ানো। সেই সঙ্গে স্থির হলো কিছু মিলেনিয়াম গোল। একদিকে খেতে-পরতে পায় না কিছু দেশ, আণবিক বোমা বানাতে শুরু করল, দেশে খাদ্য ঘাটতি থাকলে থাকতে পারে, কিন্তু মিসাইল ঘাটতি থাকতে পারবে না, এমন সংকল্পেও কেউ কেউ অটল থাকতে থাকলেন। অন্যদিকে দেখা গেল, এক বিশ্ব বানানোর মধুর প্রতিশ্রুতি। মুক্তির আযান উঠল ব্যবসায়ের গদি থেকে। মুক্তবাণিজ্য, মুক্ত আকাশ, পরস্পর কাছে আসার যাবতীয় উপায়-উপকরণ মুক্ত হয়ে গেল। ফলে এই সহস্রাব্দ হয়ে দাঁড়াল, স্লোগানে অন্তত মুক্তির ও যুক্তির। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বা অতি ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, মানুষের ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত করার যাবতীয় উপায়-উপকরণ মানুষের হাতে থাকা সত্ত্বেও মানুষ কোথাও পাচ্ছে না মুক্তি, কোথাও ঘটছে না যুক্তি এমন ব্যাপকভাবে যে মানুষ একত্রে নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারে। অথচ ভয়ংকরের মধ্যে বিজ্ঞানের শুভংকর যে অর্জন, তাতে শত শত বছর ধরে মানুষ অতিনিশ্চিন্তে হেসে-খেলে পৃথিবীতে থাকতে পারে। কিন্তু তেমন যে পারা যাবে না, সে বোধই দিন দিন দানা বাঁধছে। নিত্য-নিয়ত হিংসার সংবাদ অনিশ্চয়তাকে তীব্র থেকে তীব্র করে তুলছে।
এই পরিস্থিতিতে আমরা একজন বিশ্বকবি চাই। আমাদের কোনো বিশ্বকবি নেই, আমাদের বলতে আমি সারা পৃথিবীর মানুষকে বোঝাচ্ছি। এখন কোথাও কোনো বিশ্বমানের নেতা নেই, বিশ্বমানের সংস্কারক নেই। এমন কেউ নেই যে বোঝাবেন, আমরা সবাই ভাই, এমন কেউ নেই যে, যাঁকে দেখা মাত্র মনে হবে, পৃথিবী আবার বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। রবীন্দ্রনাথকে দেখলে এমন হতো, তাঁর রচনার উদ্দীপনা ও সংগীত পাঠককে আশ্বস্ত করত যে ভয়ের কিছু নেই, শাশ্বত মঙ্গল তার স্থান করে নেবেই। এখন মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের জন্য সশরীরে উপস্থিত থাকার এটিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। মানুষকে মিলিত করার আকঙ্ক্ষায় তিনি যে অমানবিক পরিশ্রম করেছেন, সে আর করতে হতো না। ঘরে বসে অনেক কাজ কতে পারতেন, যার জন্য তিনি মাসের পর মাস সমুদ্রে ভেসে বেরিয়েছেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর থেকে তিনি যে বিশ্ব অভিভাবকের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, সে ভূমিকা এখন আর কোনো কবি বা দার্শনিক গ্রহণ করছেন না। সর্বত্র এমন এক বামনের রাজত্ব কায়েম হয়েছে যে বড় কাউকে দেখাই যাচ্ছে না। পৃথিবীকে শেখাতে পারে এমন কোনো মহৎ আহ্বান নেই। অথচ এখনই তো সময় বলবার যে মানব জন্ম একটা অমূল্য ব্যাপার, তাকে সন্ত্রাসিত করে রাখার কোনো মানে নেই। সে এক মহাপাপ। এই বার্তা দিয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের প্রাণকে স্পর্শ করবেন কে, কে বলবেন উপনিষদের সেই কথা, লোভ করো না। আজ লাভের ও লোভের কবলে পড়ে ব্যবসায়িক শোষণ দানব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দানবকে পরাভূত করার জন্য চিরন্তন মানববুদ্ধিকে কে জাগাবে? এমন তো কেউ নেই এখন, যার কথা পৃথিবী শুনবে। এই জায়গাটা নিতান্তই শূন্য যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববার্তা নিয়ে এই শূন্যস্থান পূর্ণ করতে একটা বৈশ্বিক উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ নিজে বলেছেন, আমি পৃথিবীর কবি। কোনো অত্যুক্তি নেই তাতে। রবীন্দ্রনাথকে অনুধাবন করলে যে কেউ বুঝবেন, তিনি পৃথিবীর কবি, সত্যি সত্যি। একালে তিনিই একমাত্র কবি, যিনি মানুষের মধ্যকার যাবতীয় বিভেদ ঘোচাতে এবং শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে জীবনভর কাজ করেছেন। আজ তিনি নেই। তাঁকে নিয়েই একটি বিশ্বউদ্যোগ কামনা করি, মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন শুরু করার জন্য। সে উদ্যোগের সূচনা আমরাও করতে পারি।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
No comments