রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-রহস্যঘেরা সেই এক ঘণ্টার জবাব কী? by মলয় ভৌমিক

সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গনের স্বপ্ন-পর্দায় ভুসি-কালো রং ছিটিয়ে এবার চলে গেলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্র ফারুক হোসেন। ফারুকের মা-বাবা জয়পুরহাটের গ্রামে বসে তাঁর মেধাবী সন্তানকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখছিলেন, তার ওপরও ছাই রং চাপিয়ে দিল শিবিরের বর্বর বাহিনী।


আগে থেকেই পথে বসা এই পরিবারকে ফারুকের লাশের মতোই যেন এবার সেপটিক ট্যাংকের আঁধারে ঠেলে ফেলে দেওয়া হলো। অথচ আমরা আগের মতো এবারও নির্বিকার; মিনমিন করে সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গনের চিত্কার করে যাচ্ছি, অন্যদিকে প্রতিনিয়ত একেকটি পরিবারের স্বপ্ন হচ্ছে বিবর্ণ।
শিক্ষাঙ্গনে শিবির কী করছে, তাদের নৃশংস কৌশলের গতিপ্রকৃতি কী, তা তো সবার জানা। কিন্তু প্রতিকারের ব্যবস্থাতেই কেবল ফাঁকা বুলি। ফারুকের বেলায় যা ঘটল, তাকে কী বলা যাবে? সে কি কেবল ফ্যাসিস্ট শিবিরের বর্বর জিঘাংসারই শিকার, নাকি এর আড়ালে আমাদের রাজনীতির ভেতরের কদর্য চেহারারও দায় আছে কিছুটা?
১০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনে পুলিশের আইজির উপস্থিতিতে ঘটনার আড়ালের ঘটনার যে বর্ণনা মেলে, তাতে তো বলা যায় ফারুককে হত্যাকারীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। হল প্রাধ্যক্ষ, হাউস টিউটর, প্রক্টর, সহকারী প্রক্টরসহ প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষকেরা ঘটনার যে বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তাতে গোটা ব্যাপারটি যেমন রহস্যময় হয়ে ওঠে, তেমনি সেই রহস্যের গিঁটগুলো কিছুটা আলগাও হয়ে পড়ে।
৮ ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে আটটায় বঙ্গবন্ধু হলে শিবিরের ছাত্ররা ছাত্রলীগের দুজন কর্মীর ওপর চড়াও হলো। হলের সিট দখলকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা। সিটের বিষয়টি ছুতোমাত্র, যা পরে বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধু হলে ছাত্রলীগের দুজন কর্মী আহত হলে পুলিশ ছাত্রশিবিরের কয়েকজনকে আটক করে। এতে অন্যান্য হলে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। প্রশাসনের লোকজন হলে হলে যান। অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাবও মোতায়েন করা হয়। হল প্রাধ্যক্ষ ও প্রক্টর, সহকারী প্রক্টররা জানাচ্ছেন, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বিনোদপুর, বুধপাড়ার কাছে গণকবর এবং স্টেশন এলাকায় ছাত্রশিবির ও তাদের বহিরাগত ক্যাডাররা অস্ত্রসস্ত্রসহ সমবেত হতে থাকে। ক্যাম্পাসে উপস্থিত রাজশাহীর পুলিশ কমিশনারকে তখনই প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই তথ্য লিখিতভাবে জানানো হয়। কিন্তু পুলিশ কমিশনার সবকিছু তাঁদের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে সবাইকে আশ্বস্ত করেন। তাঁর আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে রাত ১২টার দিকে হল প্রশাসনের লোকজন চলে যান বাসায়। এর আগে এস এম হলের প্রাধ্যক্ষ ও কয়েকজন সহকারী প্রক্টর ওই হলে পাহারারত পুলিশ সদস্যদের কাছে নিহত ফারুকসহ ছাত্রলীগের ১১ জন কর্মীকে রেখে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলেছিলেন। পুলিশও তাঁদের আশ্বস্ত করে জানিয়েছিল, যেকোনো মূল্যে ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
‘সবকিছু নিয়ন্ত্রণে’, ‘যেকোনো মূল্যে ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে’—পুলিশের এমন বক্তব্যের পর সেই রাতে যা ঘটতে থাকে তা রহস্যে ঢাকা। পুলিশ কমিশনার ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাওয়ার কিছু সময় পরেই অর্থাত্ রাত একটার পরপর বাইরে থেকে সশস্ত্র শিবিরকর্মীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। তারা বিনা বাধায় হলে হলে ঢুকে তাণ্ডব চালায়। প্রায় সব হলের প্রাধ্যক্ষ একই সুরে অভিযোগ করেছেন, হলগেটের তালাগুলো শিবিরের ক্যাডারদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল এবং প্রায় একই সঙ্গে সবগুলো হলের পাহারারত পুলিশও হল ছেড়ে অনত্র চলে গিয়েছিল। ফারুক হোসেনকে যে হলে হত্যা করা হয়েছে, সেই এস এম হল ছাত্রলীগের ১১ জন কর্মী অভিযোগ করেছে, পুলিশ চলে যাওয়ার সময় তাদের পা জড়িয়ে ধরে চলে না যাওয়ার জন্য আকুতি জানিয়েছিল অনেকেই। কিন্তু পুলিশ তাতে কর্ণপাত করেনি।
এস এম হল, লতিফ হল ও আমির আলী হল তিনটির সম্মুখ ফটক একই চত্বরের তিন দিকে। ঘটনার মাত্র কয়েক মিনিট আগে ওই চত্বরে পুলিশ ও র্যাবের বিপুলসংখ্যক সদস্য টহল দিচ্ছিলেন বলে সহকারী প্রক্টররা জানিয়েছেন। এই তিন হলেই তাণ্ডব চলে সব থেকে বেশি। কোন কারণে এই তিন হল এলাকা থেকে টহলরত বিপুলসংখ্যক পুলিশ একটি নির্দিষ্ট সময়ে উধাও হয়ে গেল, সেটিও একটি প্রশ্ন বটে। একাধিক হলপ্রাধ্যক্ষ এ অভিযোগও করেছেন যে ঘটনার শেষে হলে পাহারারত পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে তাঁরা জানতে পেরেছেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশের কারণেই তাঁরা হল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এবং হলের গেট খুলে দিয়েছিলেন। এই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কে বা কারা, তার হদিস কিন্তু এখন পর্যন্ত মেলেনি। প্রায় সব হল-প্রাধ্যক্ষের বক্তব্য থেকে আরও একটি অদ্ভুত তথ্য মেলে। প্রায় সব হলেই একটি নির্দিষ্ট সময় পর হল ছেড়ে চলে যাওয়া পুলিশ আবার একই সাথে ফিরে আসে।
বিভিন্ন তথ্য থেকে দেখা যায়, পুলিশের হল ছেড়ে চলে যাওয়া এবং পুনরায় হলে প্রবেশ করার এই সময়টা মোটামুটি রাত দেড়টা থেকে আড়াইটা। অর্থাত্ এক ঘণ্টা বা তার কিছু বেশি। এই এক ঘণ্টা বা সোয়া ঘণ্টায় আরও কটি ঘটনা ঘটে। উপাচার্য ও প্রক্টর জানাচ্ছেন, এই সময়ে অনেকবার টেলিফোনে যোগাযোগ করেও পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে তাঁরা কোনো কথা বলতে পারেননি। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এই একই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো কৌশলগত পয়েন্ট ছিল অরক্ষিত। আবার শহীদ শামসুজ্জোহা হল, সোহরাওয়ার্দী হল ও জিয়া হলের প্রাধ্যক্ষরা জানাচ্ছেন, তাঁদের হলগুলোতে প্রহরারত পুলিশের সাহসী ভূমিকার কারণে অনেক চেষ্টা করেও শিবিরের ক্যাডাররা এই সময়ে ভেতরে ঢুকতে পারেনি। আরও একটি ঘটনার কথাও জানা যায়। শহর থেকে গাড়ি পাঠিয়ে এই সময়ে কোনো কোনো হল থেকে আক্রান্ত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হয়েছে।
এখন গোটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো গুরুতর প্রশ্ন উঠে আসছে। প্রথমত, শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা ক্যাম্পাসের নানা পয়েন্টে সমবেত হয়েছে—এ তথ্য জানার পরও ‘সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে’ বলে পুলিশ কী করে সবাইকে আশ্বস্ত করল? দ্বিতীয়ত, কী কারণে একটি নির্দিষ্ট সময়ে অধিকাংশ হল থেকে পুলিশ গেট খুলে রেখে বেরিয়ে গেল এবং নির্দিষ্ট সময় পরে ফিরে এল? তৃতীয়ত, পুলিশ কনস্টেবলদের হল ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশদাতা কে বা কারা? চতুর্থত, কেন ওই নির্দিষ্ট সময়ে উপাচার্য বারবার চেষ্টা করেও পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলতে পারলেন না? পঞ্চমত, কয়েকটি হলে পুলিশ সাহসী ভূমিকা পালন করলেও অন্য হল থেকে পুলিশের চলে যাওয়ার রহস্যই বা কী? ষষ্ঠত, কোনো কোনো হল থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উদ্ধার করা গেলেও, সব হল থেকে তাদের উদ্ধার করা গেল না কেন? এসব প্রশ্ন যেমন গুরুতর, তেমনি এর উত্তর পাওয়াটাও জরুরি।
প্রশ্ন আছে আরও। আইজিপি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ঘটনাটি ছিল পরিকল্পিত। কিন্তু এই পরিকল্পনা তো এক দিনে বসে হয়নি। জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের মেসগুলোকে প্রায় এক মাস আগে থেকেই শিবিরের কর্মীরা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল। প্রশ্ন হলো, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কি এই খবর রাখতেন না? উপাচর্যের বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে রাজশাহীর পুলিশ কমিশনার আইজিপিকে জানান, শিবিরের ক্যাডারদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন ছিল। টিয়ার গ্যাস ছাড়াও তাঁরা শর্টগান থেকে অসংখ্য গুলি ছুড়েছেন। এ সময় আইজিপি পুলিশ কমিশনারকে প্রশ্ন করেন, তাহলে শিবিরের কেউ আহত হলো না কেন? কেন গভীর রাতের ওই ঘটনার সময় শিবিরের কাউকেই গ্রেপ্তার করা গেল না? (অবশ্য ঘটনার পরদিন দুপুরে পুলিশ সংস্কৃতিকর্মীসহ অনেক সাধারণ ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে, যাদের অনেককেই এখনো ছেড়ে দেওয়া হয়নি।) অন্যান্য প্রশ্নের মতো আইজিপির এই তাত্পর্যপূর্ণ প্রশ্নের জবাব খোঁজাও খুবই জরুরি।
সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনায় বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া তথা দেশে যখন সামপ্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের রায় যখন কার্যকর হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর ব্যাপারটি যখন প্রক্রিয়াধীন, তখন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি মরিয়া হয়ে মাঠে নামবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই শক্তিকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে যদি কোনো রহস্যময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যদি থাকে ভেতরের কোনো গলদ অথবা এসব ঘটনাকে কেউ যদি ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করে, তাহলে লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে না কখনোই।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে মানুষকে ভয় দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। চেষ্টা হয়েছে ক্ষমতাসীন সরকারকে নিজেদের শক্তি সম্পর্কে জানান দেওয়ার। কিন্তু এতে তারা লাভবান হয়েছে বলে মনে হয় না, বরং মানুষ ওই অপশক্তির বিরুদ্ধে আজ অনেক বেশি সোচ্চার হয়েছে। এখন প্রয়োজন মানুষের এই সাহস ও শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার, প্রয়োজন ঐক্যের। আর ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ যেন এই ঐক্যকে বিনষ্ট করতে না পারে, তার জন্যই দরকার ভেতরে কোনো গলদ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা। সরকার এ ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দেবে, এটাই প্রত্যাশা।
মলয় ভৌমিক: শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।

No comments

Powered by Blogger.