ডাকসু নির্বাচন-বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিবিধ বাহানা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মাননীয়’ উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক গত ২১ মার্চ বিবিসি বাংলার পরিক্রমা পর্বে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চলছে। এ অবস্থায় ডাকসু নির্বাচন দেওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষার কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
অর্থাৎ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দাবি করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ এখন সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় আছে। তাহলে এই সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় নির্বাচন না দিয়ে উপাচার্য কি মহামারিপূর্ণ দশায় নির্বাচন দিতে চান? নাকি শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে পাশ কাটিয়ে যেতে চান?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও তো মনোনীত; নির্বাচিত নন। উপাচার্য নির্বাচন হয় না কেন? উপাচার্য নির্বাচনে কি শিক্ষকদের মধ্যে লাঠিসোঁটা নিয়ে দৌড়াদৌড়ির আশঙ্কা কাজ করে? এই ভয়ে উপাচার্য নির্বাচন হয় না? এ রকম আরও অনেক কিছুই তুলে ধরা সম্ভব; কিন্তু আমরা সেদিকে যাচ্ছি না।
আমরা প্রশ্ন করতে চাই, শ্রেণীকক্ষের শিক্ষাই কি উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা? শ্রেণীকক্ষের শিক্ষাই উচ্চশিক্ষা নয়। উচ্চশিক্ষাকে পরিপূর্ণ করতে আরও কতগুলো অনুষঙ্গ জারি থাকা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান কাজ। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ মূলত সেই কাজগুলো করতেই সহায়তা করে।
পৃথিবীর সব শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র সংসদ আছে। বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইটগুলো ঘেঁটে দেখুন; ওদের ছাত্র সংসদ আছে নানান আকারে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়সহ ইউরোপ-আমেরিকার আরও বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ চালু আছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ সক্রিয় আছে। বিদেশি নামকরা বিশ্ববিদ্যাগুলোর ছাত্র সংসদ যেটা করে থাকে—স্বাধীনভাবে কথা বলা, ইতিবাচক পরিবর্তনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী একযোগে কাজ করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে ভূমিকা রাখা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক-সাংস্কৃতিক চর্চার বিকাশ ঘটানো, শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সোচ্চার থাকাসহ নানাবিধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা ইত্যাদি। নেই শুধু আমাদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষামান নিচে নামার কারণ এখানকার সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও তার বিকাশ বন্ধ হয়ে যাওয়া। ডাকসু সর্বশেষ কার্যকর ছিল ১৯৯০-১৯৯১ শিক্ষাবর্ষে। অর্থাৎ, স্বৈরাচার সরকার পতনের পর শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক বিকাশ বন্ধ হয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সিনেটে নির্বাচিত ডাকসু থেকে পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধি থাকার কথা। প্রতিনিধিত্বের এ ব্যবস্থার কারণ হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ শিক্ষার্থীদের তাবৎ সমস্যা সমাধানের নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি চালু রাখা। কিন্তু তা নেই ২১ বছর ধরে। বিশ্ববিদ্যালয় যদি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি যৌথ জ্ঞান বিকাশের প্রতিষ্ঠান হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা কেন সিনেটে থাকবে না? বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে চলবে না-চলবে—এই সব বিষয়ে কেন শিক্ষার্থীদের মতামত নেওয়া হবে না? অধ্যাদেশে যে পাঁচজন শিক্ষার্থী থাকার বিষয়ে বলা হয়েছে, সেটি ছাড়া সিনেটে গত ২১ বছরে যতগুলো বাজেট পাস হয়েছে, সেগুলো কি অবৈধ হয়ে যায় না?
সিনেটে আইন দ্বারা পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধির কথা থাকলেও সিন্ডিকেটে এর কোনো নামগন্ধও নেই। সিন্ডিকেটে ছাত্র প্রতিনিধি থাকার বিষয়টা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনেও নেই। এর মানে, বিশ্ববিদ্যালয় চলছে শুধু শিক্ষক এবং সরকারি কিছু আমলাদের দ্বারা। পুরোটাই একরোখা এবং অগণতান্ত্রিক সিনেট-সিন্ডিকেট দিয়েই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়।
ছাত্র সংসদ অচল থাকলেও কর্তৃপক্ষ বছর বছর ডাকসু ও হল সংসদ বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাঁদা নেয় ১২০ টাকা করে। প্রতিবছরে শিক্ষার্থী বিবেচনায় সেই টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪০ লাখ। সেই টাকা কোথায় যায়? বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে মঞ্জুরি কমিশন হতে পাওয়া টাকার হিসাব থাকলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা টাকার কোনো হিসাব কেন দেওয়া হয় না? ছাত্র সংসদ বাবদ টাকাপয়সা নিয়েও নির্বাচন না দেওয়ার আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি কী?
আজকে যখন সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সরকারি উদ্যোগে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন হয়, তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকাশের জন্য সরকারের সদিচ্ছা মিডিয়াতে জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়, তখন ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিকাংশ কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন স্থগিত থাকা এবং সে ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা দৃষ্টিগোচর না হওয়াটা রহস্যজনক ও হতাশাজনকও বটে! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচন হয়, কর্মচারী সমিতির নির্বাচন হয়; শুধু হয় না ছাত্র সংসদ নির্বাচন।
নাদিম মাহমুদ, সেঁজুতি নওরোজ, তারিফ হক, সাদমান সাকিব, সৌমিত্র শুভ্র, আমির খসরু, ইউনা ইসলাম, তৌফিক ইমাম, মাহির দায়ান, কামরুস সালাম, হারুণ-অর-রশিদ, নুর বাহাদুর, মওদুদ মিষ্টি ও নুরে আলম।
লেখকেরা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থী।
ducsu2012@hotmail.com
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও তো মনোনীত; নির্বাচিত নন। উপাচার্য নির্বাচন হয় না কেন? উপাচার্য নির্বাচনে কি শিক্ষকদের মধ্যে লাঠিসোঁটা নিয়ে দৌড়াদৌড়ির আশঙ্কা কাজ করে? এই ভয়ে উপাচার্য নির্বাচন হয় না? এ রকম আরও অনেক কিছুই তুলে ধরা সম্ভব; কিন্তু আমরা সেদিকে যাচ্ছি না।
আমরা প্রশ্ন করতে চাই, শ্রেণীকক্ষের শিক্ষাই কি উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা? শ্রেণীকক্ষের শিক্ষাই উচ্চশিক্ষা নয়। উচ্চশিক্ষাকে পরিপূর্ণ করতে আরও কতগুলো অনুষঙ্গ জারি থাকা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান কাজ। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ মূলত সেই কাজগুলো করতেই সহায়তা করে।
পৃথিবীর সব শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র সংসদ আছে। বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইটগুলো ঘেঁটে দেখুন; ওদের ছাত্র সংসদ আছে নানান আকারে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়সহ ইউরোপ-আমেরিকার আরও বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ চালু আছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ সক্রিয় আছে। বিদেশি নামকরা বিশ্ববিদ্যাগুলোর ছাত্র সংসদ যেটা করে থাকে—স্বাধীনভাবে কথা বলা, ইতিবাচক পরিবর্তনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী একযোগে কাজ করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে ভূমিকা রাখা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক-সাংস্কৃতিক চর্চার বিকাশ ঘটানো, শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সোচ্চার থাকাসহ নানাবিধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা ইত্যাদি। নেই শুধু আমাদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষামান নিচে নামার কারণ এখানকার সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও তার বিকাশ বন্ধ হয়ে যাওয়া। ডাকসু সর্বশেষ কার্যকর ছিল ১৯৯০-১৯৯১ শিক্ষাবর্ষে। অর্থাৎ, স্বৈরাচার সরকার পতনের পর শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক বিকাশ বন্ধ হয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সিনেটে নির্বাচিত ডাকসু থেকে পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধি থাকার কথা। প্রতিনিধিত্বের এ ব্যবস্থার কারণ হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ শিক্ষার্থীদের তাবৎ সমস্যা সমাধানের নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি চালু রাখা। কিন্তু তা নেই ২১ বছর ধরে। বিশ্ববিদ্যালয় যদি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি যৌথ জ্ঞান বিকাশের প্রতিষ্ঠান হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা কেন সিনেটে থাকবে না? বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে চলবে না-চলবে—এই সব বিষয়ে কেন শিক্ষার্থীদের মতামত নেওয়া হবে না? অধ্যাদেশে যে পাঁচজন শিক্ষার্থী থাকার বিষয়ে বলা হয়েছে, সেটি ছাড়া সিনেটে গত ২১ বছরে যতগুলো বাজেট পাস হয়েছে, সেগুলো কি অবৈধ হয়ে যায় না?
সিনেটে আইন দ্বারা পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধির কথা থাকলেও সিন্ডিকেটে এর কোনো নামগন্ধও নেই। সিন্ডিকেটে ছাত্র প্রতিনিধি থাকার বিষয়টা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনেও নেই। এর মানে, বিশ্ববিদ্যালয় চলছে শুধু শিক্ষক এবং সরকারি কিছু আমলাদের দ্বারা। পুরোটাই একরোখা এবং অগণতান্ত্রিক সিনেট-সিন্ডিকেট দিয়েই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়।
ছাত্র সংসদ অচল থাকলেও কর্তৃপক্ষ বছর বছর ডাকসু ও হল সংসদ বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাঁদা নেয় ১২০ টাকা করে। প্রতিবছরে শিক্ষার্থী বিবেচনায় সেই টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪০ লাখ। সেই টাকা কোথায় যায়? বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে মঞ্জুরি কমিশন হতে পাওয়া টাকার হিসাব থাকলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা টাকার কোনো হিসাব কেন দেওয়া হয় না? ছাত্র সংসদ বাবদ টাকাপয়সা নিয়েও নির্বাচন না দেওয়ার আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি কী?
আজকে যখন সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সরকারি উদ্যোগে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন হয়, তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকাশের জন্য সরকারের সদিচ্ছা মিডিয়াতে জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়, তখন ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিকাংশ কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন স্থগিত থাকা এবং সে ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা দৃষ্টিগোচর না হওয়াটা রহস্যজনক ও হতাশাজনকও বটে! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচন হয়, কর্মচারী সমিতির নির্বাচন হয়; শুধু হয় না ছাত্র সংসদ নির্বাচন।
নাদিম মাহমুদ, সেঁজুতি নওরোজ, তারিফ হক, সাদমান সাকিব, সৌমিত্র শুভ্র, আমির খসরু, ইউনা ইসলাম, তৌফিক ইমাম, মাহির দায়ান, কামরুস সালাম, হারুণ-অর-রশিদ, নুর বাহাদুর, মওদুদ মিষ্টি ও নুরে আলম।
লেখকেরা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থী।
ducsu2012@hotmail.com
No comments