বিশেষ সাক্ষাত্কার-ছাত্ররাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে হবে by আনিসুজ্জামান

মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ছাত্রসংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ ও পারস্পরিক সহিংসতায় ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন মেধাবী শিক্ষার্থী হত্যার শিকার হয়েছেন। শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য ও অসুস্থ ছাত্ররাজনীতির বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।


এ বিষয়ে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের দু’টি বিশেষ সাক্ষাত্কার ছাপা হলো
 সাক্ষাত্কার নিয়েছেন একেএম জাকারিয়া

প্রথম আলো  ছাত্ররাজনীতি আজ এ অবস্থায় এসে ঠেকল কীভাবে?
আনিসুজ্জামান  ছাত্ররাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন শুরু হয়েছে স্বাধীনতার পরপরই। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের একটি অংশ প্রতিদান চেয়েছে। একটি অংশ বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের লাভ খুঁজেছে। মুক্তিযুদ্ধে যায়নি, এমন ছাত্রদের অনেকেই নিজেদের শক্তি ব্যবহার করেছে নিজেদের স্বার্থে। ফলে প্রথমবারের মতো নীতি ও আদর্শের প্রশ্ন ছাড়াই ছাত্র সংগঠনে কোন্দল ও বিভাজন দেখা দেয়। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে একসঙ্গে সাতজন ছাত্র নিহত হওয়ার বিষয়টি এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যায়। প্রায় তখন থেকেই ছাত্ররাজনীতি ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথম আলো  তার পরে তো এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হয়েছে।
আনিসুজ্জামান  তখন অনেক ছাত্রকে নিঃস্বার্থভাবে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে দেখেছি। তবে সেই আন্দোলনের সাফল্যের পর তা আবার ব্যক্তিগত লাভের চোরাবালিতে হারিয়ে গেছে। পারস্পরিক হানাহানি, চাঁদবাজি, টেন্ডারবাজি—এগুলো ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা করলেও তা ছাত্ররাজনীতির বিকার মাত্র। এই বিকার থেকে ছাত্ররাজনীতিকে করার চেষ্টা রাজনৈতিক সংগঠনগুলো করেনি। আজকেও রাজনৈতিক নেতারা মুখে অনেক কিছুই বলছেন কিন্তু ছাত্র সংগঠনের নেতারা এই কলুষ থেকে সরে আসতে পারছেন না, বা চাইছেনও না।
প্রথম আলো  মানে, ছাত্র সংগঠনগুলো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে?
আনিসুজ্জামান  ছাত্র সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গসংগঠনে রূপ দেওয়ার বিধানটি খুবই মারাত্মক হয়েছিল। এর ফলে ছাত্র সংগঠনগুলো একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করেছে, অন্যদিকে সুযোগ-সুবিধা লাভের আশায় নিজেদের সংঘদ্ধ শক্তিকে নানাভাবে বিক্রি করতে চেয়েছে। এ অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলায় এখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব আর তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।
প্রথম আলো  এ অবস্থায় ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা জরুরি বলে মনে করেন কি?
আনিসুজ্জামান  ছাত্ররাজনীতির নামে যে সন্ত্রাস ও দুর্বৃত্তপনা ঘটছে, তা বন্ধ করা খুবই দরকার। কিন্তু এই সন্ত্রাস ও দুর্বৃত্তপনাকে আমি ছাত্ররাজনীতি বলে মনে করি না। সুতরাং সন্ত্রাস বন্ধ করতে গিয়ে যদি আমরা ছাত্ররাজনীতিকে বন্ধ করতে চাই, তাহলে তা হবে স্নানের জলের সঙ্গে শিশুকে ফেলে দেওয়ার সমতুল্য।
প্রথম আলো  ছাত্ররাজনীতির পক্ষে আপনার অবস্থানের পেছনে কোন যুক্তি কাজ করে?
আনিসুজ্জামান  আমাদের দেশে শিক্ষার হার কম। এখানে শিক্ষিতদের বিবেচনাই সাধারণ মানুষকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে পারে। ১৯৪৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত ছাত্ররাজনীতি এই ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। তখন দেশের মূল রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ছাত্র সংগঠনগুলোর সমর্থন থাকলেও লেজুড়বৃত্তি ছিল না। বরং রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সংগত চাপ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। পরবর্তী সময়ে লোভ-লালসা ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করেছে। আমাদের কাজ হবে ছাত্ররাজনীতিকে এই কলুষ থেকে মুক্ত করা, ছাত্ররাজনীতিকে নিষিদ্ধ করা নয়।
প্রথম আলো  এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। কী উদ্যোগ নেওয়া যায়?
আনিসুজ্জামান  রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব হবে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত সব ছাত্রকর্মীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া এবং তাদের সাজা দেওয়া। পশ্চিমে আমরা অনেক কাল আগে দেখেছি, এখন আমাদের দেশেও দেখছি, অনেক ক্ষেত্রে পিতামাতা মাদকাসক্ত বা দুর্বৃত্ত সন্তানকে পুলিশে ধরিয়ে দিচ্ছেন। এই বেদনাদায়ক পন্থা অবলম্বন করা ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব বলে মনে হয় না। যারা ক্ষমতায় আছে এবং যারা বিরোধী দলে আছে—দুই পক্ষকেই এই পথ বেছে নিতে হবে।
প্রথম আলো  রাজনৈতিক দলগুলো তো নিজেদের স্বার্থে ছাত্র সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে। তারা এ কাজ কতটুকু করতে পারবে?
আনিসুজ্জামান  রাজনৈতিক দলগুলোর নৈতিক অবস্থানেও পরিবর্তন আনতে হবে। ছাত্রদের শক্তিকে যতক্ষণ ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের প্রবণতা থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের পক্ষে ছাত্র সংগঠনগুলোর ওপর কোনো নৈতিক প্রভাব বিস্তার সম্ভব নয়।
প্রথম আলো  বিভিন্ন সময়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নৃশংস আচরণ, বিশেষত সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের বর্বরতার পর ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। আপনি কী মনে করেন?
আনিসুজ্জামান  সংবিধানে সংগঠন গড়ে তোলার যে বিধান রয়েছে, তার বিরোধী না হলে কোনো রাজনৈতিক বা ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা আমি সংগত মনে করি না। সংবিধান যখন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিল, তখন সরকার যে ব্যবস্থা নিতে পারত, সেই বিধানের অবলুপ্তির ফলে সরকারের পক্ষে এখন তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী হবে।

No comments

Powered by Blogger.